এ যেন একটা চক্র। স্বাভাবিক কোনো চক্র নয়, ক্রম ঘূর্ণমান এমন একটা চক্র, যা ফাঁদের থেকে কম কিছু নয়। কয়েক বছর ধরেই এই আবর্তে পড়েছে ভারতীয় অর্থনীতি। নরেন্দ্র মোদি সরকারের দ্বিতীয় পর্যায়ের শাসনকালে তা কার্যত হিমশিম খাচ্ছে।
দুঃসময়ে ভারতের অর্থনীতি
- সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
অন্যান্য

চক্রটি কী রকম? মানুষের হাতে টাকা না থাকায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা প্রায় লোপ পেতে বসেছে। এর ফলে বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে।
ঠিক এ বিষয়টিই সম্প্রতি উল্লেখ করেছিলেন অর্থনীতিবিদ অভিজিত্ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরপরই এমআইটিতে (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের অর্থনীতির হাল নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ভারতের অর্থনীতির এখন যা দিশাহীন হাল, তাতে মানুষের হাতে, বিশেষ করে গরিব মানুষের হাতে আরো টাকা আসার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ধনীদের হাতে আরো টাকা দিয়ে লাভ নেই। গরিব মানুষের হাতে টাকা এলেই আবার দেশীয় বাজার সচল হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি সতর্ক করে দিয়ে এ-ও বলেছিলেন, মন্দ অর্থনীতি দেশের মন্দই করে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ভারতের এবারের জটিল মন্দা পরিস্থিতি এবং তা আরো ঘোরালো হওয়ার সম্ভাবনার পেছনে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ রয়েছে।
আগেরবার পূর্ববর্তী শতকের শেষভাগে যখন ইউরোপের ব্যাপকতর অংশে মন্দা দেখা দিয়েছিল, তখন ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশ নিজেদের তখনকার মতো বাঁচাতে পেরেছিল। সেই সময় মন্দা গোটা বিশ্বকে গ্রাস করতে পারেনি। কিন্তু এবারের মন্দার ভয়ংকর চেহারা ও তার স্থায়িত্ব আরো পরিব্যাপ্ত। প্রথমত, এবারের মন্দা বিশ্বের কোনো একটা বিশেষ গোলার্ধে নয়। এবারের মন্দা বিশ্বব্যাপী। দ্বিতীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এই সার্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থা সবচেয়ে ভয়ংকর। তৃতীয়ত, বিগত আট ও নয়ের দশকে ইউরোপ তার মন্দা অবস্থা কাটাতে পেরেছিল তার কম জনসংখ্যার দৌলতে। কিন্তু ভারতের মতো স্ফীতকায় জনসংখ্যা অধ্যুষিত, কার্যত মহাদেশ বলা যায় এমন দেশে মহামন্দা যেভাবে শুরু হয়েছে, তার গতির চাকা ঘোরানো এত সহজ নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মন্দার ধকল উপশমের রাস্তা খুঁজতে এবার ভারতের পক্ষে দেশের বাইরে অন্য কোথাও আশ্রয় বা সাহায্য খোঁজা সম্ভব নয়। কারণ একই সঙ্গে মন্দা সেই সব দেশেও। বিশ্বমন্দার অনিবার্য ফল হিসেবেই রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার ক্রমেই দ্রুত হারে সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই একদিকে অভ্যন্তরীণ এবং অন্যদিকে বৈদেশিক বাজার—দুটি ক্ষেত্রই যখন ভারতীয় শিল্পপণ্যের সামনে বন্ধ হয়ে যায়, তখন দেশের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। পুরোপুরি ঝাঁপ বন্ধ এড়িয়ে যারা চলতে চাইবে, তাদের আশ্রয় নিতে হবে ছাঁটাই, বেতন হ্রাস, বাড়তি কাজের বোঝা চাপানোর মতো পদক্ষেপে। যার ফলে আগামী দিনে আরো নাভিশ্বাস উঠতে চলেছে শ্রমিক শ্রেণির।
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, গ্রাম-ভারতে বিপুল হারে ক্রয়ক্ষমতা কমার ঘটনা। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিক্রিও কমতে শুরু করেছে। বিস্কুট কম্পানি পার্লে তাদের কম দামের বিস্কুটের বিক্রি কমছে বলে আগেই জানিয়েছে। গ্রাম-ভারতের বাজারজুড়ে মন্দার আভাস ছিলই। এবার বাজার সমীক্ষা গবেষক সংস্থা নিয়েলসন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছে, গ্রাম-ভারতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিক্রি প্রবল হারে কমেছে, যা গত সাত বছরে দেখা যায়নি। কম সময়ের ব্যবধানে কেনাবেচা হয় এমন নিত্যপণ্যের ওপর সমীক্ষা চালায় সংস্থাটি। দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় গ্রামের একেকটি দোকানের বিক্রি চার ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে।
সম্পর্কিত খবর