ঢাকা, শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫
৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫
৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ মহররম ১৪৪৭

দুঃসময়ে ভারতের অর্থনীতি

  • সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
দুঃসময়ে ভারতের অর্থনীতি

এ যেন একটা চক্র। স্বাভাবিক কোনো চক্র নয়, ক্রম ঘূর্ণমান এমন একটা চক্র, যা ফাঁদের থেকে কম কিছু নয়। কয়েক বছর ধরেই এই আবর্তে পড়েছে ভারতীয় অর্থনীতি। নরেন্দ্র মোদি সরকারের দ্বিতীয় পর্যায়ের শাসনকালে তা কার্যত হিমশিম খাচ্ছে।

আর এই চক্রের কেন্দ্রে যারা আছে, সেই কৃষক, শ্রমিক, গরিব, মধ্যবিত্ত সব শ্রেণির সাধারণ মানুষই বাস্তবে বন্দি হয়ে পড়েছে এই চক্রব্যূহের মধ্যে। ধীরে ধীরে ক্রয়ক্ষমতা কমছিলই। কারণ নোটবন্দি, জিএসটি পরবর্তী পর্যায়ে সাধারণ গরিব মানুষের হাতে টাকা আসা এক রকম বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় দফার সরকারে এই সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করায় ভারতীয় অর্থনীতি শ্বাসরোধকারী এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ সম্প্রতি একটি আলোচনাচক্রে মন্তব্য করেছেন, অর্থনৈতিক শর্তসাপেক্ষে ভারতের অর্থনীতিকে এখনই হয়তো পরিভাষায় মন্দা বলা যাবে না। কিন্তু ভারতের পরিস্থিতি মন্দার থেকে কম কিছুও নয়।

চক্রটি কী রকম? মানুষের হাতে টাকা না থাকায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা প্রায় লোপ পেতে বসেছে। এর ফলে বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে।

বিক্রিবাট্টা হচ্ছে কম, পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের ব্যবসাও যেভাবে চলার কথা, সেভাবে চলছে না। এভাবে এক শ্রেণির লোক প্রতিনিয়তই বাজার থেকে ছিটকে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই চক্র থামার কোনো লক্ষণ গত দুই বছরে অন্তত দেখা যায়নি। সে কারণে প্রতিবারই এই চক্রের আবর্তে কিছু কিছু করে মানুষ (ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষই) বাজারের আওতা থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল হলো বাজার ক্রমেই সংকুচিত হতে শুরু করা।
বাজার সংকোচনের ফল পড়ছে জিডিপি (মোট জাতীয় উৎপাদন) থেকে শুরু করে অর্থনীতির যাবতীয় সূচকে। প্রায় সব কয়েকটি সূচকই অধোগামী। বাজারের এই চরম দুর্দশায় ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এক গভীর স্থবিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে উৎপাদন শিল্প। ফলত দেশের মানুষ যাতে এই অস্থির পরিস্থিতিতে আরো প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে না পড়ে এবং সেই সুযোগ নিয়ে একদল সুযোগসন্ধানী মুনাফাবাজ ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষের ওপর শোষণের বোঝা চাপিয়ে দিতে না পারে, অনেকটা সেই কারণেও ভারতের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে এখনই মন্দা বলতে চাইছেন না অর্থনীতিবিদরাও। কিন্তু বাস্তবে ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসে স্মরণাতীত কালের মধ্যে এমন মহামন্দা দেখা যায়নি, যা দ্রুত ধেয়ে আসছে সমাজের ওপর।

ঠিক এ বিষয়টিই সম্প্রতি উল্লেখ করেছিলেন অর্থনীতিবিদ অভিজিত্ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরপরই এমআইটিতে (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের অর্থনীতির হাল নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ভারতের অর্থনীতির এখন যা দিশাহীন হাল, তাতে মানুষের হাতে, বিশেষ করে গরিব মানুষের হাতে আরো টাকা আসার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ধনীদের হাতে আরো টাকা দিয়ে লাভ নেই। গরিব মানুষের হাতে টাকা এলেই আবার দেশীয় বাজার সচল হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি সতর্ক করে দিয়ে এ-ও বলেছিলেন, মন্দ অর্থনীতি দেশের মন্দই করে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ভারতের এবারের জটিল মন্দা পরিস্থিতি এবং তা আরো ঘোরালো হওয়ার সম্ভাবনার পেছনে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ রয়েছে।

আগেরবার পূর্ববর্তী শতকের শেষভাগে যখন ইউরোপের ব্যাপকতর অংশে মন্দা দেখা দিয়েছিল, তখন ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশ নিজেদের তখনকার মতো বাঁচাতে পেরেছিল। সেই সময় মন্দা গোটা বিশ্বকে গ্রাস করতে পারেনি। কিন্তু এবারের মন্দার ভয়ংকর চেহারা ও তার স্থায়িত্ব আরো পরিব্যাপ্ত। প্রথমত, এবারের মন্দা বিশ্বের কোনো একটা বিশেষ গোলার্ধে নয়। এবারের মন্দা বিশ্বব্যাপী। দ্বিতীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এই সার্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থা সবচেয়ে ভয়ংকর। তৃতীয়ত, বিগত আট ও নয়ের দশকে ইউরোপ তার মন্দা অবস্থা কাটাতে পেরেছিল তার কম জনসংখ্যার দৌলতে। কিন্তু ভারতের মতো স্ফীতকায় জনসংখ্যা অধ্যুষিত, কার্যত মহাদেশ বলা যায় এমন দেশে মহামন্দা যেভাবে শুরু হয়েছে, তার গতির চাকা ঘোরানো এত সহজ নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মন্দার ধকল উপশমের রাস্তা খুঁজতে এবার ভারতের পক্ষে দেশের বাইরে অন্য কোথাও আশ্রয় বা সাহায্য খোঁজা সম্ভব নয়। কারণ একই সঙ্গে মন্দা সেই সব দেশেও। বিশ্বমন্দার অনিবার্য ফল হিসেবেই রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার ক্রমেই দ্রুত হারে সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই একদিকে অভ্যন্তরীণ এবং অন্যদিকে বৈদেশিক বাজার—দুটি ক্ষেত্রই যখন ভারতীয় শিল্পপণ্যের সামনে বন্ধ হয়ে যায়, তখন দেশের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। পুরোপুরি ঝাঁপ বন্ধ এড়িয়ে যারা চলতে চাইবে, তাদের আশ্রয় নিতে হবে ছাঁটাই, বেতন হ্রাস, বাড়তি কাজের বোঝা চাপানোর মতো পদক্ষেপে। যার ফলে আগামী দিনে আরো নাভিশ্বাস উঠতে চলেছে শ্রমিক শ্রেণির।

সম্প্রতি এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, গ্রাম-ভারতে বিপুল হারে ক্রয়ক্ষমতা কমার ঘটনা। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিক্রিও কমতে শুরু করেছে। বিস্কুট কম্পানি পার্লে তাদের কম দামের বিস্কুটের বিক্রি কমছে বলে আগেই জানিয়েছে। গ্রাম-ভারতের বাজারজুড়ে মন্দার আভাস ছিলই। এবার বাজার সমীক্ষা গবেষক সংস্থা নিয়েলসন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছে, গ্রাম-ভারতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিক্রি প্রবল হারে কমেছে, যা গত সাত বছরে দেখা যায়নি। কম সময়ের ব্যবধানে কেনাবেচা হয় এমন নিত্যপণ্যের ওপর সমীক্ষা চালায় সংস্থাটি। দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় গ্রামের একেকটি দোকানের বিক্রি চার ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ