০২. তিনিই আল্লাহ, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সব কিছুই তাঁর। অবিশ্বাসীদের জন্য কঠিন শাস্তির দুর্ভোগ রয়েছে। [সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ২ (প্রথম পর্ব)]
তাফসির : আগের আয়াতে বলা হয়েছিল, কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষকে আলোর পথে এবং পরাক্রমশালী সত্তার পথে নিয়ে আসার জন্য। আলোচ্য আয়াতে পরাক্রমশালী সত্তা মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
এখানে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ আসমান ও জমিনের সর্বময় ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এ আয়াতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
পবিত্র কোরআনই সর্বপ্রথম সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং একে রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলভিত্তি নির্ধারণ করেছে। মদিনা রাষ্ট্র ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কল্যাণরাষ্ট্র।
তখন থেকেই সার্বভৌমত্ব ধারণার প্রসার ঘটতে থাকে।
মধ্যযুগে ইসলামিক অর্থে কিংবা আধুনিক অর্থে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। তখন ছিল সামন্তব্যবস্থা। সামন্ত প্রভুরাই শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন।
প্রজারা তাঁদের নির্দেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে চলত। ইউরোপ ছিল হাজারো সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত। আর তা ছিল শাসক ও পোপের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে অশান্ত। মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা মূলত চার্চ ও শাসকের দ্বন্দ্বের ইতিহাস।
আধুনিক বিশ্বে সার্বভৌমত্বের ধারণা ইউরোপের নবজাগরণের ফলে প্রসার লাভ করেছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে পোপের নৈতিক অধঃপতন হলে তাঁর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ প্রতিক্রিয়ার সুযোগ গ্রহণ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজারা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ এবং ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনের ফলে সামন্ত প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। এভাবে রাজার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো ক্রমে অপসারিত হয়। আর রাজাকে কেন্দ্র করে সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম ‘সার্বভৌমত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন দার্শনিক জ্যাঁ বোঁদা (১৫৩০-৯৬)। তাঁর মতে, ‘সার্বভৌমত্ব হলো, নাগরিক ও প্রজাদের ওপর আইনের অধীনে রাষ্ট্রের অপ্রতিরোধ্য চূড়ান্ত ক্ষমতা।’ অন্য অর্থে, ‘নির্দেশ দান ও ক্ষমতা প্রয়োগের উচ্চতর ও স্বাধীন উৎসকেই সার্বভৌমত্ব বলা হয়, যা সবাই অকুণ্ঠভাবে মেনে নিতে বাধ্য।’ এ অর্থে সার্বভৌমত্ব এক ধরনের প্রভুত্বের মর্যাদা লাভ করেছে। ইসলামে এ সার্বভৌম প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য নির্ধারিত।
ইসলামে সার্বভৌমত্বের মূল কথা হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো দেশের অধিবাসীরাই দেশের প্রকৃত মালিক নয়। বরং মহান আল্লাহই হচ্ছেন পৃথিবীর প্রকৃত মালিক। আকাশ ও পৃথিবী তিনি নিজ ক্ষমতাবলে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির ওপর তাঁর একচ্ছত্র মালিকানা, কর্তৃত্ব ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অবিভাজ্য ও অংশীদারহীন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তুমি কি জানো না, আসমান ও জমিনের সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহরই?’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১০৭)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর ইলাহ বা উপাস্য।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৮৪)
পৃথিবীতে যা ইচ্ছা, তা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করেন।’ (সুরা : বুরুজ, আয়াত : ১৬)
পৃথিবীর কারো কোনো কথা বা কাজ প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু আল্লাহকে প্রশ্ন করার কেউ নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি যা করেন, সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না। বরং তাদেরই প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৩)
গ্রন্থনা : মাওলানা কাসেম শরীফ