৩৫. তারা কি বলে যে সে তা রচনা করেছে? বলে দাও, ‘আমি যদি এটি রচনা করে থাকি, তবে আমিই আমার অপরাধের জন্য দায়ী থাকব। তোমরা যে অপরাধ করছ, তা থেকে আমি দায়মুক্ত।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩৫)
তাফসির : আগের কয়েকটি আয়াতে হজরত নুহ (আ.) ও তাঁর জাতি সম্পর্কে আলোচনা ছিল। সব নবী-রাসুলকে নিজ নিজ যুগে কাফির-মুশরিকদের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে কাজ করতে হয়েছে।
কাফির-মুশরিকরা নবীদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার অভিযোগ তুলেছিল। হজরত নুহ (আ.)ও এ ধরনের অপপ্রচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সে যুগের কাফিররা বলত যে হজরত নুহ (আ.) আল্লাহর নামে যা প্রচার করছেন, প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহর বাণী নয়। এসবই তাঁর নিজের রচিত বাণী। এই আয়াতে এসব অপপ্রচারের জবাবে বলা হয়েছে, যদি ধরে নেওয়া হয়, হজরত নুহ (আ.)-এর দাবি অসত্য, তাহলে এর দায়দায়িত্ব তাঁরই। আল্লাহর আদালতে কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মের জন্য দায়ী থাকবে। কেউ অন্যের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। তারপর তোমাদের পালনকর্তার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি সেসব বিষয়ে বলে দেবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬৪)
আলোচ্য আয়াতে সাধারণ মুসলমানদেরও এ নীতি বলে দেওয়া হয়েছে যে কেয়ামতের আদালতের আইনকানুন দুনিয়ার মতো নয়। দুনিয়ায় কেউ অপরাধ করলে তার দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপানো যায়। কিন্তু আল্লাহর আদালতে এর কোনো অবকাশ নেই।
সেখানে একজনের পাপের জন্য অন্যকে দায়ী করা হবে না। দুনিয়ায় যে যেমন কাজ করবে, পরকালে সে তার কাজ অনুযায়ী ফল ভোগ করবে। ভালো কাজ করলে ভালো প্রতিদান পাবে। আর মন্দ কাজ করলে ফলও পাবে অনুরূপ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে, সে তার শাস্তি পাবে এবং সে আল্লাহ ছাড়া নিজের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। আর নারী-পুরুষের মধ্য থেকে যারাই সত্কর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। অণু পরিমাণও তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১২৩-১২৪)
অন্য আয়াতে এসেছে : ‘মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই। সুতরাং যে ক্ষমা করে ও আপস করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে আছে। নিশ্চয়ই তিনি অত্যাচারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ৪০)
অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : ‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সত্কর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অপকর্ম করলে তা-ও দেখতে পাবে।’ (সুরা : জিলজাল, আয়াত : ৭-৮)
তাই সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য কাফিরদেরই দায়ী থাকতে হবে। আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়ার পর কেউ তা গ্রহণ না করলে কোনো নবী-রাসুল এর দায়ভার বহন করবেন না।
কোনো কোনো তাফসিরবিদ বলেছেন, এ আয়াতে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে মহানবী (সা.) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নুহ (আ.)-এর কাহিনীর শেষ বিবরণের আগেই এই আয়াতে হঠাৎ করেই মহানবী (সা.)-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে যদিও তা ছন্দপতনের মতো মনে হয়; কিন্তু এখানে এই আয়াতের উল্লেখ উদ্দেশ্যমূলক। সম্ভবত নুহ (আ.)-এর জীবনের যে অভিজ্ঞতা, মহানবী (সা.)-এর জীবনেও অনেক ক্ষেত্রে সেসব অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এই ভাব ও বক্তব্য প্রকাশের জন্য কাহিনীর মাঝামাঝি স্থানে এই আয়াত সংযুক্ত করা হয়েছে।
গ্রন্থনা : মাওলানা কাসেম শরীফ