২৩. নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী, সত্কর্মপরায়ণ এবং তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিনয়াবনত, তারাই জান্নাতবাসী, সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে।
২৪. উভয় পক্ষের দৃষ্টান্ত হচ্ছে অন্ধ ও বধির এবং চক্ষুষ্মান ও শ্রবণশক্তিসম্পন্নের মতো। তুলনায় উভয়ে কি সমান? তবু কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? (সুরা : হুদ, আয়াত : ২৩-২৪)
তাফসির : আগের কয়েকটি আয়াতে অবিশ্বাসীদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, অবিশ্বাসীরা পরকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আলোচ্য প্রথম আয়াতে ইমানদার ও বিশ্বাসী মানুষদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বাসী সত্কর্মপরায়ণ মুসলমানরা তাদের কর্মের পুরস্কার লাভ করবে এবং অনন্ত শান্তির আবাস জান্নাতে প্রবেশ করবে। আয়াতে জান্নাতবাসী মুমিনদের তিনটি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে—এক. তারা ইমানদার। দুই. তারা সত্কর্মপরায়ণ। তিন. তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিনয়াবনত। এ আয়াতে বিনয় প্রসঙ্গ এ জন্যই আনা হয়েছে, যাতে দ্বীনদারির কারণে মুমিনের মনে অহংকার জন্ম না নেয়। কারণ অহংকার ও গর্ব ইবাদত-বন্দেগি বিনষ্ট করে, মানুষকে ইবাদতবিমুখ করে। কাফির ও মুসলমানের মধ্যে এখানেই একটি বড় পার্থক্য। অবাধ্যতা, ঔদ্ধত্য ও দম্ভ—এসব হচ্ছে অবিশ্বাসী কাফিরদের বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে একজন মুমিন মুসলমান হচ্ছে আল্লাহর অনুগত ও বিনয়াবনত।
দ্বিতীয় আয়াতে ইমানদার ও বেইমানের পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। কাফির ও মুসলমানের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা একটি উপমা ব্যবহার করেছেন। অবিশ্বাসীরা সত্যকে দেখতে পায় না।
সত্যের বাণী তাদের কানে পৌঁছে না। ফলে তারা অন্ধ ও বধিরের মতো। কিন্তু মুমিন মুসলমানরা সত্যের বাণী বিবেচনা করে তা গ্রহণ করে। ফলে তারাই প্রকৃত অর্থে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী। মানুষ খুব কমই এই বাস্তবতার প্রতি লক্ষ করে। মানুষ অন্য সব প্রাণীর মতো ইন্দিয়গ্রাহ্য সব কিছু প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ অতীন্দ্রিয় বিষয় নিয়েও ভাবে, যা প্রাণীরা পারে না।
আল্লাহ তাআলা নিজ সৃষ্টিগুলোর মধ্যে প্রতিটি সৃষ্টির প্রয়োজন অনুপাতে তার জীবনের লক্ষ্য অনুযায়ী বুদ্ধি ও উপলব্ধি ক্ষমতা দান করেছেন। সবচেয়ে কম বুদ্ধি ও চেতনা-উপলব্ধি রয়েছে মাটি, পাথর প্রভৃতি জড় পদার্থের মধ্যে, যাদের না আছে প্রবৃদ্ধি, না আছে নিজের স্থান থেকে সরে যাওয়ার শক্তি। কিন্তু সেগুলোতেও আছে ক্ষীণ জীবনীশক্তি। এর চেয়ে সামান্য বেশি চেতনা আছে উদ্ভিদের মধ্যে। সেগুলোর রয়েছে প্রবৃদ্ধি, পাতা-ফল-ফসল দানের খোদা প্রদত্ত শক্তি। তারপর আসে পশুর স্তর। যাদের জীবনের কার্যক্রম চলাফেরা করে খাবার আহরণ, বংশবৃদ্ধি ও ক্ষতিকর বিষয় থেকে আত্মরক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে মানুষের বোধ-চেতনা ও উপলব্ধি শক্তি সবচেয়ে বেশি। পানাহার, জৈবিক চাহিদা পূরণ ও নিদ্রা-জাগরণের বাইরেও সে নিজ স্রষ্টাকে চিনতে পারে, স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে পারে, মঙ্গল-অমঙ্গল, ভালো-মন্দ, হেদায়েত-গোমরাহি, আলো-আঁধার, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ও আসল-মেকি পরখ করতে পারে। এ কারণেই মানবজাতি জীবনে উন্নতি লাভের এমন সুযোগ পেয়েছে, যা অন্য কেউ পায়নি। উন্নতি লাভ করে সে ফেরেশতাদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে শর্ত হলো, এ জন্য তাকে সৃষ্টিগত যোগ্যতা ও ক্ষমতার যথার্থ ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু মানুষ যদি তার বোধ-উপলব্ধি ও ভালো-মন্দ পার্থক্যের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, তখন সে মানবিকবোধ হারিয়ে পাশবিকতা কিংবা আরো নিম্নস্তরে পৌঁছে যেতে পারে। ‘মানুষ’ হিসেবে তখন তার দেহ-অবয়ব, সুরত-আকৃতি ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না।
গ্রন্থনা : মাওলানা কাসেম শরীফ