জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহু জটিল রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকারে যত সাফল্য অর্জিত হয়েছে, সার্বিকভাবে ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তত হয়নি। তবে স্তন ক্যান্সারের বেলায় রোগীদের বেঁচে থাকার সময় বৃদ্ধিতে চিকিৎসা পদ্ধতির ক্রমোন্নতি বড় ভূমিকা রাখছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সাহায্যের দরকার হয়। চিকিৎসকদলে সাধারণত থাকেন একজন অনকোলজিস্ট বা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, ক্যান্সার সার্জন, রেডিওলজিস্ট, রেডিওগ্রাফার, বিশেষজ্ঞ নার্স, প্যাথলজিস্ট, সাইকোলজিস্ট, পুষ্টিবিদ, ফিজিওথেরাপিস্ট ও কেমোথেরাপিস্ট।
স্তন ক্যান্সার : প্রতিরোধ ও প্রতিকার
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ

স্তন ক্যান্সার চিকিৎসাকে মোটামুটি পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে সার্জারি, রেডিওথেরাপি, বায়োলজিক্যাল থেরাপি, হরমোন থেরাপি ও কেমোথেরাপি।
সেন্টিনেল নোড বায়োপসির মাধ্যমে একটি লিম্ফনোড সরিয়ে ফেলা হয়। ক্যান্সার কোষ লিম্ফনোডে পৌঁছে তার মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। সেন্টিনেল নোডে ক্যান্সার কোষ পাওয়া গেলে সার্জন বগলের নিচের একাধিক লিম্ফনোড সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একে বলা হয় অ্যাক্সিলারি লিম্ফনোড ডিসেকশন। স্তন পুনঃস্থাপন সার্জারি হলো এমন এক সার্জারি, যার মাধ্যমে স্তন কেটে বাদ দেওয়ার পর সেখানে স্তন পুনঃস্থাপন করা হয়। এটি করা হয় শরীরের অন্য জায়গা থেকে মাংসপেশি কেটে নিয়ে স্তনের আকার করে স্তনের জায়গায় পুনঃস্থাপন করার মাধ্যমে। অথবা স্তন ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করেও কাজটি করা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ব্রেস্ট রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি।
এবার রেডিয়েশন থেরাপি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রেডিয়েশন বা তাপবিকিরণ টিউমারে প্রয়োগ করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে রেডিওথেরাপিও বলা হয়। রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয় সাধারণত টিউমার সার্জারির পর। রেডিওথেরাপির সঙ্গে কেমোথেরাপিও প্রয়োগ করা হয় সার্জারির পর অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য। সার্জারির এক মাস পর রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। রেডিওথেরাপির প্রতি সেশন কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। রোগীকে প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচবার রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয় এবং তিন থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই থেরাপি চলতে পারে। কোন ধরনের স্তন কান্সারে রোগী আক্রান্ত তার ওপর নির্ভর করে কোন রেডিওথেরাপি বা কত দিনের রেডিওথেরাপি দরকার হবে। অনেক রোগীর জন্য রেডিওথেরাপি দরকার হয় না। লাম্পেক্টমির পর যে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়, তাকে বলা হয় চেস্টওয়াল রেডিয়েশন থেরাপি। উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হয় সেখানে, যেখানে টিউমারের অবস্থান ছিল। স্তনের আকার বড় হলে রেডিয়েশনের পর স্তনের আকার-আকৃতি বা চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ার রেডিয়েশনকে বলা হয় ব্রেস্ট বুস্ট। লিম্ফনোড রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে বগলের তলা ও আশপাশের সীমানায় রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হয়, যাতে লিম্ফনোডে পৌঁছে যাওয়া ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হলে অল্প মাত্রার স্বল্প সময়ের রেডিয়েশন ক্ষতিকর হয় না; বরং ফলপ্রসূ হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কষ্টদায়ক থেরাপি হলো কেমোথেরাপি। ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য শরীরে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ওষুধের দ্বারা ক্যান্সার চিকিৎসা করাকে বলা হয় কেমোথেরাপি। ক্যান্সার কোষ শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়লে বা ক্যান্সার কোষের পুনরাবির্ভাব হওয়ার ঝুঁকি অত্যধিক হলে তখন কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। একে বলা হয় অ্যাডজুভেন্ট কেমোথেরাপি। টিউমারের আকার বড় হলে সার্জারির আগেই কেমোথেরাপি প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়, যাতে টিউমারের আকার ছোট বা সংকুচিত করে আনা যায়। এর ফলে টিউমার সার্জারি সহজ হয়। একে বলা হয় নিউ অ্যাডজুভেন্ট কেমোথেরাপি। কোমোথেরাপি বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়, যদি মেটাস্ট্যাসিস হয়ে যায়, অর্থাৎ ক্যান্সার কোষ শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কেমোথেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সারের কিছু উপসর্গ দূর করা সম্ভব। কেমোথেরাপি ইস্ট্রোজেন তৈরি বন্ধ করতে সাহায্য করে। ইস্ট্রোজেন স্তন ক্যান্সার সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, ক্ষুধামান্দ্য বা ক্ষুধা না লাগা, ক্লান্তি, অবসাদ, গলায় ব্যথা, চুল পড়ে যাওয়া, সংক্রামক রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়া, গায়ের চামড়া বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, অস্থিমজ্জা অবদমিত হওয়া, হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, দুর্বল প্রতিরোধক্ষমতা, ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা, পেটে গ্যাস হওয়া ইত্যাদি। কেমোথেরাপির অন্য একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো সন্তান ধারণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। ক্যান্সার চিকিৎসার ক্রমোন্নতির কারণে অনেক রোগী ইদানীং প্রাণে বেঁচে গেলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে রোগীদের অনেক ক্ষতি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অল্পবয়সী নারীদের সন্তান ধারণক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যাওয়া এর মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিককালে গবেষকরা আর্সেনিকমিশ্রিত এমন একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, ওভারির ওপর যার প্রভাব খুব নেতিবাচক হবে না। শিকাগোর নর্থওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকরা মনে করেন, তাঁদের নতুন আবিষ্কার ক্যান্সারে আক্রান্ত অল্পবয়সী নারীদের চিকিৎসার সময় সন্তান ধারণক্ষমতা সংরক্ষণ করবে। কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত ওষুধের মধ্যে রয়েছে সাইক্লোফসফামাইড, ডক্সোরুবিসিন, ভিনক্রিস্টিন, মিটোমাইসিন, মেথোট্র্যাক্সেট, ৫-ফ্লোরোইউরাসিল, প্যাক্লিটেক্সেল, যা ট্যাক্সল নামে বহুল পরিচিত, হারসেপটিনসহ অসংখ্য ওষুধ।
হরমোন থেরাপি ব্যবহার করা হয় ওই রোগীদের ক্ষেত্রে, যেখানে স্তন ক্যান্সার হরমোনের প্রতি ক্রিয়াশীল থাকে। এই ক্যান্সারকে বলা হয় ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর পজিটিভ ও প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর পজিটিভ ক্যান্সার। এই চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সারের পুনরোদয় বন্ধ করা হয়। সার্জারির পর হরমোন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। তবে টিউমারের আকার ছোট করার জন্য সার্জারির আগেও হরমোন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যগত কারণে সার্জারি করা না গেলে তখন কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোন থেরাপি দিয়ে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। ক্যান্সারের প্রতি হরমোন ক্রিয়াশীল না হলে হরমোন থেরাপি কোনো কাজে আসে না। সার্জারির পর অন্তত পাঁচ বছর হরমোন থেরাপি দিতে হয়। হরমোন থেরাপিতে ব্যবহৃত ওষুধ টেমোক্সিফেন সাধারণত ইস্ট্রোজেনকে ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর পজিটিভ ক্যান্সার কোষের সঙ্গে বন্ধনে বাধা দেয়।
এবার কিভাবে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে একটু আলোচনা করি। নিচে বর্ণিত পরামর্শগুলো মেনে চললে ক্যান্সার অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন।
এক. মনোবল অটুট রাখুন, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখুন এবং রোগমুক্তির জন্য দোয়া করুন। চিকিৎসকরা আজকাল আল্লাহর ওপর ভরসা করার ওপর জোর দিচ্ছেন। দৃঢ় মনোবল ও আল্লাহর সাহায্য রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
দুই. ব্যায়াম করুন। প্রতি সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন ব্যায়াম করলে নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যায়।
তিন. সুষম ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তৈলাক্ত ভাজা-পোড়া ও জাংক ফুড বর্জন করুন। মাছের তেল ক্যান্সার প্রতিরোধে বিরাট ভূমিকা পালন করে। যেসব নারী নিয়মিত মাছের তেল ও ওমেগা-৩ ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার খান, তাঁদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ১৪ শতাংশ কমে যায়। স্যামন, সার্ডিন, টিউনা মাছে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাট রয়েছে। বেশি বেশি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার খান। শাকসবজি, ফলমূলে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরে ফ্রি-র্যাডিক্যাল তৈরি বন্ধ করে। ফ্রি-র্যাডিক্যাল হলো এক ধরনের কালপ্রিট, যা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। উচ্চ মানসম্পন্ন প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খান। দুধ, টকদই, ছানা, ডিম, বাদাম নিয়মিত খাবেন। অতি সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রেড মিট বা লাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত লাল মাংস ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
চার. ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি না নিলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হরমোন প্রদান করা না হলে অনেক নারী আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে হলে হরমোন না নেওয়াই উত্তম।
পাঁচ. আপনার শরীরের ওজন ঠিক রাখুন। স্থূল নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। খাবার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের স্বাভাবিক ওজন ঠিক রাখুন।
ছয়. ঘন ঘন স্তন পরীক্ষা করুন। স্তন পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং নিয়ে আমি আগের নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হলে আপনার সুস্থ থাকা ও বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে বেড়ে যাবে।
সাত. আপনার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান। ব্রেস্টফিডিং মায়েদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অন্য মায়েদের চেয়ে অনেক কম। শিশুদের অন্তত ছয় মাস বুকের দুধ খাওয়ালে অল্প বয়সে স্তন ক্যান্সার সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে না।
আট. ধূমপান বর্জন করুন। ধূমপান ও তামাকজাতীয় পদার্থ ক্যান্সার সৃষ্টি করে।
নয়. শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করুন।
দশ. অ্যালকোহল পরিত্যাগ করুন। যেসব নারী মদ পান করেন, তাঁদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এগারো. রাত জাগবেন না। প্রতিদিন অন্তত সাত-আট ঘণ্টা ঘুমাবেন।
পরিশেষে একটি সুখবর। ১৯৮৯ সাল থেকে স্তন ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুহার অনেক কমে গেছে। স্তন ক্যান্সার শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিপ্লব সাধিত হওয়ার কারণে এই সুফল পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন ২৮ লাখ নারী স্তন ক্যান্সার থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ জীবন যাপন করছেন। আপনি স্তন ক্যান্সারের রোগী হলে আপনিও সুস্থ হবেন এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকবেন-এই বিশ্বাস রাখুন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে সুস্থ রাখুন, ভালো রাখুন।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাবি
সম্পর্কিত খবর