সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে ঐকমত্য হয়েছে। সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কেমন হবে আর জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় দফা সংলাপের ১১তম দিনের আলোচনায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এই সিদ্ধান্ত হয়। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফররাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া।
সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সংলাপ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগসংক্রান্ত দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তন ও রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
তবে প্রধান বিচারপতি হিসেবে কর্মে নিযুক্ত জ্যেষ্ঠতম একজনকে না কর্মে জ্যেষ্ঠ দুজনের মধ্যে একজন নিয়োগ করা হবে সে বিষয়ে দুটি মত উপস্থিত আছে। কমিশন এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণাসংক্রান্ত বিষয়ে গত ৭ জুলাইয়ের আলোচনায় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪১(ক) সংশোধন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার না হয়, এ দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। আলোচনায় অনুচ্ছেদ ১৪১(ক) সংশোধনের ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান অপসারণ এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি স্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে।
তিনি বলেন, কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে এ বিষয়টা আরো সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আরো কী কী বিষয় সংযুক্ত করা যায়, সেসব আগামী সপ্তাহের আলোচনায় সুস্পষ্ট হবে বলে আশা প্রকাশ করছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক দুটি প্রস্তাব নিয়ে আজ (গতকাল) আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে কমিশনের সহসভাপতি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা কার্যত যতদূর সম্ভব ত্রুটিহীন হয় এবং যে ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। এই বিষয়েও আরো আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপিল বিভাগের দুজনের মধ্য থেকে একজনকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন।
এ ক্ষেত্রে কোনো অসদাচরণের অভিযোগ না থাকলে আপিল বিভাগের যেকোনো জ্যৈষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাব করেছে বিএনপি।
তিনি আরো বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত। তবে আগের একই কাঠামো থাকবে কি না, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।
জরুরি অবস্থা জারির বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধানে উল্লিখিত জরুরি অবস্থা জারিসংক্রান্ত বিধানে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য ‘বিদ্রোহ’ শব্দটি জরুরি অবস্থা জারি এই ‘অভ্যন্তরীণ’ শব্দটি বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। আর জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি স্বাক্ষরের বিধান না রেখে সংসদীয় কমিটির স্বাক্ষর করার বিধান রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া জরুরি অবস্থায় লেখার ও বলার স্বাধীনতা বহাল রাখা, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতম আচরণ করা যাবে না এবং বিচার পাওয়ার অধিকার রাখার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি প্রস্তাবনা বিএনপির কাছে দিয়েছে সরকার, এ নিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বৈঠকে আলোচনাও হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানকে যথাযথ মর্দাযায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চায় বিএনপি। ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। স্বাধীনতার পর জনপ্রতিনিধিরা ঘোষণাপত্র তৈরি করেছিলেন, তাঁরা আলোচনা করে সংবিধান প্রণয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে ঘোষণাপত্রকে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়ে একমত এনসিপি। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে আমরা সর্বদলীয় একটি কমিটি গঠনের কথা বলেছি। জরুরি অবস্থা জারি বিষয়ে ১৪১-ক অনুচ্ছেদের সংশোধনী আনতে মত দিয়েছি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটির্র (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের রুটিনকাজ হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা, স্থানীয় নির্বাচন করা তাদের কাজ নয়। স্থানীয় নির্বাচন করবে নির্বাচিত সরকার। একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করাই হবে নির্বাচনকালীন সরকারের কাজ। অতীতে দেখেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মূল কাজের বাইরেও অতিরিক্ত কাজে জড়িয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছে। এতে সমস্যা আরো বেড়ে যায়। তাই আমরা নাম পরিবর্তনের কথা বলেছি। তিনি আরো বলেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ যেন স্বচ্ছ হয়। এখনো অতীতের মতো বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২৩ জন বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আলোচনা দীর্ঘায়িত না করার আহবান জানান তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও বিচার বিভাগকে যুক্ত করার কারণে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল। বিচার বিভাগকে এখানে যুক্ত করার কারণে শুধু বিচার বিভাগ দলীয়করণ হয়নি, পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার মধ্যে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতিকে শেষ বিকল্প হিসেবে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে রাখা হয়েছিল। এর ব্যবহারও তাঁরা দেখেছেন। সে ব্যবহারে রাষ্ট্রপ্রধানকেও একটা বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে আরেকটা গুরুতর সংকট তৈরি করা হয়। এ কারণে তাঁরা তাঁদের দিক থেকে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি ও বিচার বিভাগ, এই দুই প্রতিষ্ঠানকে বাইরে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জায়গায় যাওয়া দরকার।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে জোনায়েদ সাকি বলেন, তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি যেন আপিল বিভাগের দুজন শীর্ষস্থানীয় বিচারপতির মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে নিয়োগের এখতিয়ার পান।