‘সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের’ দাবিতে রাজধানীতে মহাসমাবেশ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সমাবেশে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লাখো নেতাকর্মী ও সমর্থক অংশ নেন। এ ছাড়া এই সমাবেশে যোগ দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিশ ও হিন্দু মহাজোটের নেতারা।
মহাসমাবেশে স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিচার, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে আয়োজনের দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
একই সঙ্গে মহাসমাবেশে ১৬ দফা দাবি সংবলিত ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। সমাবেশে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দলের নেতারাও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন।
গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এই মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই এসব দাবি তুলে ধরা হয়।
তবে পিআর পদ্ধতির পক্ষে না থাকায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) মহাসমাবেশে দাওয়াত দেওয়া হয়নি।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন দলটির আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। বক্তব্যের শুরুতে তিনি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে জীবন উৎসর্গকারী যোদ্ধাদের স্মরণ করে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানান।
১৯৭২ সালে রচিত সংবিধান দেশের মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও গণ-আকাঙ্ক্ষাবিরোধী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেই সংবিধান রচয়িতাদের স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান রচনা করার ম্যান্ডেটই ছিল না।
তাঁরা ভিনদেশের সংবিধান অনুসরণ করেছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধি ও উন্নতি হয়নি। রাজনৈতিক সংস্কৃতি কলুষিত হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, সংবিধান মেনেই স্বৈরাচার তৈরি হয়েছে। এ জন্য আমরা সংস্কারের প্রশ্নে অটল, অবিচল ও আপসহীন অবস্থান নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচার তৈরির রাস্তা খোলা রাখা যাবে না। সংস্কার না করেই নির্বাচন আয়োজন করে দেশকে আবারও আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মতো বিষয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে।’
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘দেশের সব মানুষের ভোটের দাম সমান। কারো ভোট যাতে অবমূল্যায়ন করা না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তাই আগামী নির্বাচনে সংসদের উভয় কক্ষে অবশ্যই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তাদের সেই অনুপাতে আসন থাকবে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার মতের প্রতিফলন ঘটবে। কোনো দল জালেম হওয়ার সুযোগ পাবে না। এটা জেন-জির দাবি। এটা এখন জনগণের দাবি। দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের দাবি। সব ধর্মের মানুষেরও দাবি।’
সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘পিআর বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি ছাড়া জাতীয় নির্বাচন দেশের মানুষ মেনে নেবে না। প্রধান উপদেষ্টার কিছু ভূমিকায় জনগণের মধ্যে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে দফায় দফায় সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন করার কথা বলে আসছি, কিন্তু সংস্কার কমিশন কেন জানি দু-একটি দলের সঙ্গে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। এখন স্থানীয় সরকারে কোনো জনপ্রতিনিধি নেই। এই সরকারের আমলে অনতিবিলম্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা যারা অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধা ছিলাম, যদি সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে আগামী দিনের বাংলাদেশে আর কোনো ফ্যাসিস্ট কোনো নামে, কোনো ব্যক্তিকে সামনে রেখে, কোনো দলকে সামনে রেখে দাঁড়াতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘আগামী বাংলাদেশের সংসদে আমরা যদি আসলেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব চাই, তাহলে পিআর পদ্ধতি নিয়ে আমাদের আরো জোরদার কাজ করতে হবে।’
মহাসমাবেশে ১৬ দফা দাবিসংবলিত ঘোষণাপত্র পাঠ করেন দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ সংবিধানে এমন বিষয় পুনঃস্থাপন করা; সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন; জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা; প্রয়োজনীয় মৌলিক রাষ্ট্রসংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করা; সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতে জনপ্রশাসনকে ঢেলে সাজানো; দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সক্রিয়, কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ; ভারতের সঙ্গে করা সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ ও দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল; জাতীয় নির্বাচনের আগে সব পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন; দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও সন্ত্রাসীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা; ঘুষ, দুর্নীতিসহ সব ধরনের নাগরিক হয়রানি বন্ধ, হয়রানিমূলক সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও কোনো রকম মব সৃষ্টির সুযোগ না দেওয়া; রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে ইসলামের সুমহান আলোকিত আদর্শের অনুশীলন করা।’
সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান, গণ অধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব মুহাম্মদ আখতার হোসাইন, সারজিস আলম, এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দীন, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার, হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও প্রমুখ।