দুপুর গড়িয়ে গেছে। রান্নাঘরের কাজ শেষ, ঘরের ভাঁড়ার গোছানো। এরপর উঠানে বা খলিয়ানে পাটি পেতে বসেন গ্রামের নারীরা। হাতে সুই-সুতা।
উদ্যোক্তা
নারীর নকশায় ‘কুপিয়া’ টুপির ওমানযাত্রা
ফরিদুল করিম, নওগাঁ

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রামে এখন কুপিয়া টুপি তৈরির ধুম। মধুবন, কুঞ্জবন, খাজুর, রনাইল, ভালাইন, খোসালপুর, সুলতানপুর, উত্তরগ্রাম, শিবগঞ্জ, গোয়ালবাড়ি—যেদিকে চোখ যায়, দেখা মেলে সুই-সুতা হাতে ব্যস্ত নারীদের।
৪০ হাজারের বেশি নারী সরাসরি যুক্ত এই হস্তশিল্পের সঙ্গে।
এই টুপি স্থানীয়ভাবে তৈরি হলেও বাজার মূলত মধ্যপ্রাচ্য। বিশেষ করে ওমানে এর বিপুল চাহিদা। ওমানের পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অংশ হিসেবে কুপিয়া টুপির বিশেষ কদর রয়েছে। আর সেই টুপিই এখন তৈরি হচ্ছে নওগাঁর প্রত্যন্ত গ্রামে, নারীর ঘরোয়া হাতে।
পাঁচ ধাপে তৈরি হয় টুপি
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই টুপি তৈরি হয় পাঁচটি ধাপে। শুরুতেই কাপড়ের থান থেকে টুপির আকার অনুযায়ী কেটে নেওয়া হয়। এরপর সেই কাপড়ে তেল ও ‘বুলু’ নামের বিশেষ নীল রং দিয়ে ছাপ তোলা হয়। তাতে বিভিন্ন ফুল, পাতা, জ্যামিতিক নকশা উঠে আসে।
এরপর মেশিনের মাধ্যমে সেলাই করা হয় ওই নকশার অংশ। সেই টুপিগুলো পৌঁছে যায় গ্রামের নারীদের হাতে, যাঁরা সূক্ষ্ম কারুকাজে রঙিন সুতা দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন মনোমুগ্ধকর নকশা। একেকটি টুপিতে ব্যবহার করা হয় পুঁতি, চেইন, দেওয়ান, গুটিদানা কিংবা মাছকাঁটা বোতামের সেলাই। সর্বশেষ ধাপে টুপির সেলাই ও ভাঁজের কাজ শেষ করে রপ্তানির উপযোগী করা হয়।
ঘরে বসেই আয়
শিবরামপুর গ্রামের শাপলা বিবি বলেন, ‘সংসারের কাজের ফাঁকে প্রতিদিন চার-পাঁচটা টুপি বানাই। এতে মাসে চার হাজার টাকার মতো আয় হয়। এই আয় দিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলের খরচ চালাই।’
ভালাইন গ্রামের শিউলী বেগম বলেন, ‘যে টুপিতে শুধু সুতা ঢোকানোর কাজ করি, সেগুলোর জন্য ১৬ টাকা করে পাই। তবে ডানা তোলা বা বেশি জটিল টুপিতে মজুরি মেলে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত। অবশ্য সেই কাজ শেষ করতে ১৫ দিন থেকে এক মাসও লেগে যায়।’
মজুরি নির্ভর করে টুপির কারুকাজের জটিলতার ওপর। সাধারণ নকশার টুপিতে ১৬ থেকে ২০ টাকা পাওয়া গেলেও জটিল ও সময়সাপেক্ষ টুপিতে আয় হয় বেশি। গড়ে একজন নারী মাসে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন। তবে অনেকেরই অভিযোগ, শ্রমের তুলনায় মজুরি খুব কম।
রামচন্দ্রপুর গ্রামের শাহিদা বেগম বলেন, ‘দিন-রাত খেটে যা পাই, তাতে সংসারের খরচ মেটে না। কিন্তু এই টুপির কাজ না করলে আয় বলতে কিছুই থাকত না।’
গ্রাম ছাড়িয়ে বিদেশে
স্থানীয় ব্যবসায়ী সবুজ হোসেন বলেন, ‘এই টুপি হচ্ছে ওমানের জাতীয় টুপি। এখানে তৈরি হয় হাতে তৈরি আসল কুপিয়া টুপি। প্রথমে ডিজাইন হয়, এরপর ছাপ তোলা হয়, তারপর সেলাই। এরপর সেটা নারীদের কাছে পাঠানো হয় সুতা ঢোকানোর জন্য, তারপর আবার পাঠানো হয় হাতের কাজের জন্য। শেষে মাঠ পর্যায়ের এজেন্টরা এসব সংগ্রহ করে আমাদের কাছে দেয়। আমরা সেখান থেকে ওমানে পাঠাই।’
সবুজ আরো বলেন, গ্রামীণ নারীদের তৈরি এই টুপি শুধু ওমানে নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হয়। ঈদের আগে এসব টুপির চাহিদা আরো বেড়ে যায়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার
এমন একটি রপ্তানিমুখী হস্তশিল্প হলেও সরকারি তেমন নজর নেই। নারী কারিগররা চান, সরকার যেন মজুরি নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করে এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সরবরাহে সাহায্য করে।
তাঁদের আশা, গ্রামবাংলার উঠান থেকে তৈরি হওয়া এই শিল্প একদিন ছড়িয়ে পড়বে আরো বহুদূর। শুধু মজুরি নয়, তাঁরা চান স্বীকৃতিও। সেই স্বপ্ন বুনেই তাঁরা সুই-সুতার ফোঁড়ে তৈরি করছেন একেকটি শিল্পকর্ম।
সম্পর্কিত খবর

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে পাট চাষ

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে করা হয়েছে পাট চাষ। সেই পাট কেটে মহিষের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পানিতে জাগ দেওয়ার জন্য। গতকাল রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্নেয়া ইউনিয়নের চর বাঘমারা থেকে তোলা। ছবি : মো. আসাদুজ্জামান
।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী মুগদা হাসপাতালে

খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগ এলাকার আড়াই বছর বয়সী নূরজাহান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল তোলা। ছবি : মঞ্জুরুল করিম
।
২২৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা খেলাফত মজলিসের
নিজস্ব প্রতিবেদক

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২৩টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন দলটির আমির মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দলটি আগামী জাতীয় সংসদে নিম্নকক্ষে আংশিক আনুপাতিক ও উচ্চকক্ষে পূর্ণ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক দ্বিকক্ষীয় সাংবিধানিক কাঠামোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দলের নেতারা বলেন, একদলীয় শাসনব্যবস্থা জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ।
মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়া আত্মঘাতী। এতে ফ্যাসিবাদের দোসররা আরো উৎসাহী হচ্ছে। আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ না হই, তবে ফ্যাসিবাদ ফের মাথা চাড়া দেবে।
গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী শৈথিল্য দেখালেও পরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দুষ্কৃতকারীরা দ্রুত প্রতিহত হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন—দলের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন ও মাওলানা তোফাজ্জল হোসাইন মিয়াজি, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা এনামুল হক মূসা, মাওলানা আবুল হাসানাত জালালী, মাওলানা ফয়সাল আহমদ। এ ছাড়া ছিলেন মাওলানা ফজলুর রহমান, মাওলানা হারুনুর রশীদ, মাওলানা রুহুল আমীন খান, মাওলানা হাসান জুনাইদ, মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ছানাউল্লাহ আমিনী, মাওলানা জয়নুল আবেদীন ও মাওলানা মুহসিন বেলালী।

রামেকে ইন্টার্ননির্ভর চিকিৎসায় ঝুঁকিতে মুমূর্ষু রোগীরা
রফিকুল ইসলাম, রাজশাহী

পাবনার ঈশ্বরদী এলাকার ওয়াহেদুজ্জামান (৭১) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে পরিবারের সদস্যরা গত ১৩ জুলাই সন্ধ্যার দিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। রোগীকে জরুরি বিভাগ থেকে পাঠানো হয় ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে (মেডিসিন ওয়ার্ড)। ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পরে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তাঁকে ভর্তি করে নেন।
পরের দিন ১৫ জুলাই সকালের দিকে রোগী কিছুটা সুস্থ বোধ করলে তাঁকে ছুটি দেওয়ার কথা জানিয়ে দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু দুপুর গড়াতে না গড়াতেই রোগী আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এটি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রতিদিনের চিত্র। চিকিৎসকসংকটে দিনের প্রায় ১৮ ঘণ্টাই ইন্টার্ন চিকিৎসকনির্ভরতার মাধ্যমে চলছে এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।
খুব জরুরি প্রয়োজনে ফোনে পরামর্শ নেওয়া হয় অভিজ্ঞ ডাক্তারদের। এর বাইরে এফসিপিএস ডিগ্রিধারী বা এফসিপিএস করছেন এমন মধ্যম মানের চিকিৎসকরা থাকেন ভর্তির দিন ধার্য থাকা ওয়ার্ডগুলোতে। এ ছাড়া দিনের ২৪ ঘণ্টা প্রতিটি ওয়ার্ডেই চার থেকে ছয়জন করে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করতে হয় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই ইন্টার্নদের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
পাবনার ঈশ্বদীর রোগী ওয়াহেদুজ্জামানের ছেলে হামিম আবেদীন বলেন, ‘রামেকে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিনে একবার করে আসার কারণে আমার বাবার সমস্যাগুলো জটিল হয়ে গিয়েছিল, যা ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বুঝে উঠতে পারেননি।’
ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি রোগীর সেবা দেওয়ার। কিন্তু যে পরিমাণ রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়, সে পরিমাণ ইন্টার্ন চিকিৎসকও নেই।’
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহমেদ বলেন, ‘হাসপাতালে পর্যাপ্ত আনসার সদস্যও নেই। অন্যদিকে যেসংখ্যক রোগী ভর্তি হচ্ছে, সেসংখ্যক অভিজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাসামগ্রী ও ওষুধপথ্যও আমরা দিতে পারছি না। কারণ সব কিছু বরাদ্দ হচ্ছে ৫০০ শয্যার বিপরীতে। কিন্তু এখানে শয্যাই আছে এক হাজার ২০০টি। এর বাইরেও অতিরিক্ত আরো দুই থেকে আড়াই হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমাদের নানাভাবে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’