ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই ২০২৫
৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৮ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই ২০২৫
৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৮ মহররম ১৪৪৭

পাঁচ আঙুলে ফুলে ওঠে তাজুলরাজ্য

জাহিদ পাটোয়ারী, কুমিল্লা
জাহিদ পাটোয়ারী, কুমিল্লা
শেয়ার
পাঁচ আঙুলে ফুলে ওঠে তাজুলরাজ্য

সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ডান হাতের পাঁচ আঙুলে ফুলে উঠেছিলেন। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ ও লাকসামে তাজুলরাজ্যও ফুলে উঠেছিল অবৈধ অর্থে। ২০টির বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক হলেও তাজুল আরো লাভের লোভে অবৈধ বাণিজ্য গোছাতেন এই পাঁচ আঙুলে। আর এই পাঁচ আঙুলের মতো তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁর ভাতিজা, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও যুবলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন, ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মো. কামাল হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জাহিদ হোসেন আর শ্যালক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত আলী।

তাঁরাই তাজুলের নির্দেশে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা শাসাতেন। বিরোধীদের দমনে পীড়ন চালাতে তৈরি করা হয়েছিল আয়নাঘর। জমি দখল, কমিশন-বদলি-নিয়োগ-বরাদ্দ বাণিজ্য চলত পাঁচজনের নেতৃত্বে বিভিন্ন উপগ্রুপের মাধ্যমে। মন্ত্রী থাকাকালে তাজুল কুমিল্লার ১৭ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, পৌরসভা, এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, পল্লী উন্নয়ন একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজের অর্থ নিতেন পাঁচজনের মাধ্যমে।
এসব প্রতিষ্ঠানের কমিশনসহ বিভিন্ন খাতের অর্থ তাজুলের দপ্তরে যেত। সেই অবৈধ অর্থ গুনে গুনে রাখতেন ভাতিজা শাহাদাত। তিনি ছিলেন পরামর্শক ও হিসাবরক্ষক। এলজিইডির বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ শতাংশ হারে কমিশন আদায় করা হতো।
তা শাহাদাতের সঙ্গে বসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ফেবিয়ান গ্রুপের ভবনে বসে ঠিকঠাক করত। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বা ওয়াসার তদবির বাণিজ্যের অলিখিত চুক্তি শাহাদাতের মাধ্যমে একই ভবনে চলত। সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বদলি-দরপত্র-নিয়োগ বাণিজ্য, প্রকল্পে বরাদ্দএসব নিয়ন্ত্রণ করতেন সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জাহিদ হোসেন ও ভাতিজা আমিরুল ইসলাম। মন্ত্রীর কাছে ভিড়তে হলে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেই হতো। না হলে কাজ হতো না।
তবে তাঁদের ইশারা দিতেন শাহাদাত। জানা গেছে, এলজিইডির প্রকৌশলীর বদলি বাবদ কমপক্ষে ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা দিতে হতো। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বা প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে এই হার কোটি টাকাও ছাড়াত। কামালসহ চক্রের অন্য সদস্যরা তা আদায় করত। ভুক্তভোগীরা জানান, তাজুলের ভাতিজা শাহাদাত ছিলেন মনোহরগঞ্জের অলিখিত প্রশাসক। উপজেলাজুড়ে জমি দখল, কথা না শুনলে বিরোধীদের অত্যাচার করার সিদ্ধান্ত তিনিই দিতেন। গত ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে নির্বাচিত করা হবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে ৩০ কোটি টাকার ওপর হাতিয়ে নেন তিনি। তার ভাগ তাজুলের তহবিলেও গেছে। মনোহরগঞ্জের একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান কালের কণ্ঠকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তিন মাস আগে থেকে বিনা ভোটে জয়ী হতে ইচ্ছুক মেয়র, চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যের একাধিক তালিকা জমা দেওয়া হতো তাজুলের কাছে। চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেতে চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫ থেকে ২৫ লাখ, ইউপি সদস্য প্রার্থীর কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা হাতে দিলেই নিশ্চিত হতো জনপ্রতিনিধি। শর্ত থাকত, যেকোনো উন্নয়ন বরাদ্দ ও টিআর-কাবিখা থেকে ২০ শতাংশ টাকা তাজুলের তহবিলে দিতে হবে। তাতে অবশ্য সহযোগিতা করতেন তাজুলের ভাতিজা শাহাদাত ও আমিরুল। লাকসাম বাজারে থানার পাশে ছিল শ্যালক মহব্বত আলীর আয়নাঘর। ভগ্নিপতি তাজুলের নির্দেশে সেখানে বসেও দুই উপজেলার দরপত্র ভাগ-বাটোয়ারা, চাঁদা আদায়, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো। মহব্বত সহযোগী নিজাম উদ্দিন শামীম ও ওমর ফারুককে দিয়ে গোবিন্দপুর ও কান্দিরপাড়ে খোলেন আয়নাঘরের উপশাখা। আয়নাঘরের মাধ্যমে বিপুল অর্থ নিতেন মহব্বত। ২০১২ সালে শ্যালক মহব্বতকে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন তাজুল। ১০ বছরে লাকসামে কমপক্ষে ৫০টি পুকুর ভরাট করা ছাড়াও ফসলি জমি দখল করে বাণিজ্য করেছেন তিনি তাঁর ভগ্নিপতির প্রভাব কাজে লাগিয়ে। লাকসাম পৌর জামায়াতের আমির মো. জয়নাল আবেদীন কালের কণ্ঠকে বলেন, সাড়ে ১৫ বছরে তাজুল বাহিনীর অত্যাচারে লাকসাম-মনোহরগঞ্জের মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। গোয়ালঘর থেকে গরু, জমি থেকে কৃষকের ধানও কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিরোধীদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ জানালে নেওয়া হতো আয়নাঘরে। লাকসাম বিএনপির সদস্যসচিব আব্দুর রহমান বাদল বলেন, লাকসামের নিয়ন্ত্রণ ছিল মহব্বত আলীর হাতে। তৎকালীন লাকসামের ওসি আব্দুল্লাহ আল মাহফুজের সহযোগিতায় থানার পাশেই গড়ে তোলেন আয়নাঘর। দুই উপজেলায় হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে অন্তত ৪০০টি মামলা করে এলাকাছাড়া করা হয়েছে। আধিপত্য বিস্তারে ২০১৩ সালে লাকসাম উপজেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবীর পারভেজকে বিনা করণে র‌্যাবের অভিযানে আটকের পর গুম করা হয়।

কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন বলেন, তাজুল যাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিলেন তাদের কয়েকজনকে জামিন করানোয় আমার বিরুদ্ধে ২৭টি মিথ্যা মামলা দিয়েছেন।

তাজুল এলজিআরডিমন্ত্রী থাকাকালে সাড়ে পাঁচ বছরে কুমিল্লায় ডিপিএইচইর হাজার কোটি টাকার কাজ হয়। এই সংস্থা ছাড়াও বিভিন্ন দপ্তরের প্রকল্পে ঠিকাদার নির্বাচন করতেন তাজুলের পিএস কামাল। নিতেন ১০ শতাংশ হারে কমিশন। কুমিল্লা এলজিইডি অফিস নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ঠিকাদারি, কমিশন বাণিজ্য ও দুর্নীতির হোতা কামাল এখন পলাতক। তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানান, তাঁরাও কামালের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ ছিলেন। কুমিল্লা শহরেই কামালের কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ আছে। তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাস্টার এন্টারপ্রাইজ, এটি যাতে বেশির ভাগ কাজ পায় তার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতেন। লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে এলজিইডির সব কাজ নিতেও তাঁর চেষ্টার কমতি ছিল না। কার্যাদেশ পাওয়ার পর তা ছোট ছোট ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করতেন। কামালের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর দুদক কুমিল্লার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক পাপন কুমার সাহা ৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন। দুদক সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার হাউজিং এস্টেটে কামালের আছে একাধিক বাড়ি, কান্দিরপাড়ে বিগ বাজার সুপার মার্কেট একাধিক ফ্ল্যাট।

গত ২৭ অক্টোবর ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি, বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন কুমিল্লার লাকসাম পৌর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক মনির আহমেদ।

স্ত্রীর নামেও জমি দখল : ২০১৯ সালে প্রায় ১০০ একর কেনা হলেও তাজুলের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামের নামে বান্দরবানের লামায় আরো প্রায় ৪০০ একর জমি দখল করা হয়। দখল করে জমির পরিধি ধীরে ধীরে বাড়িয়ে নেওয়া হয়। তৈরি করা হয় বাংলোবাড়িও। তাতে চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা, কালভার্ট তৈরির খরচ অবশ্য জোগানো হয় এলজিইডি থেকেই।

তাজুল সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে নির্বাচন বমিশনে দেওয়া হলফনামায় যেসব তথ্য দিয়েছেন তা থেকে জানা গেছে, ১০ বছরেই তিনি ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর নামে বহু সম্পদ রয়েছে, যা তিনি গোপন রেখেছেন। এসব সম্পদ বাড়িয়েছেন মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তাঁর হাতের পাঁচ আঙুলের মতো ঘনিষ্ঠ পাঁচজনকে দিয়ে। গত ১৫ এপ্রিল তাজুল ইসলামের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামের ইজারা ও বায়না দলিলের বান্দরবানের ৩০৪.৫৯ একর জমি, ফ্ল্যাট ও ২৬টি শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দেন। অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া অস্থাবর সম্পদের তালিকায় রয়েছে ১২টি ব্যাংক হিসাব ও ১৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার।

জব্দ করা স্থাবর সম্পদের মধ্যে ঢাকার গুলশানে জমিসহ একটি ফ্ল্যাট, চট্টগ্রামের হালিশহরে চারতলা বাসার এক-তৃতীয়াংশ। এ ছাড়া বান্দরবানের লামা উপজেলায় ইজারা ও বায়না দলিল মূলে ৫৩টি দলিলের প্রায় ৩০৪.৫৯ একর জমি আছে।

জব্দ ও অবরুদ্ধের আবেদনে বলা হয়, ফৌজিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ছয় কোটি ৯০ লাখ দুই হাজার চার টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন ও দখলে রাখা এবং তাঁর স্বামী মো. তাজুল ইসলাম কর্তৃক অসদুপায়ে উপার্জিত অর্থ দ্বারা স্ত্রীর নামে বর্ণিত ছয় কোটি ৯০ লাখ দুই হাজার চার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে সহায়তা প্রদান এবং ১১টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৫০ হাজার ২০৩ টাকা জমা ও ১৩ কোটি ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭৫ টাকা উত্তোলন করা হয়। সর্বমোট ২৭ কোটি ১১ লাখ ৯৫ হাজার ১৭৮ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরপূর্বক আয়ের উৎস আড়াল করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারাসহ পেনাল কোডের ১০৯ ধারায় একটি মামলা রুজু করা হয়।

তার আগে গত ১৩ এপ্রিল তাজুলের নামে থাকা ঢাকা, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের ২৮.৬৩ বিঘা জমি, কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় থাকা দুটি বাণিজ্যিক স্পেস, একটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া তাঁর নিজ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৫০টি ব্যাংক হিসাব ও শেয়ারে জমা ২৮ কোটি টাকা অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত।

জানা গেছে, তাজুল ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ ফেবিয়ান গ্রুপের কো-অর্ডিনেটর মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, শাহাদাত সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে কিছুদিন আগে। তাজুল স্যারসহ অন্যদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। জানা গেছে, তাজুলের ভাতিজা শাহাদাত ও অন্যরা পলাতক অবস্থায় রয়েছেন। বারবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও তাঁদের খোঁজ পাচ্ছেন না।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বিজিবি মোতায়েন

শেয়ার
বিজিবি মোতায়েন
শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবার সচিবালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করে একদল শিক্ষার্থী। পরে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে বের করে দেয়। গতকাল সকালে ফটকে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। ছবি : শেখ হাসান
মন্তব্য

পালিয়েছেন ঠিকাদাররা ইতিহাসের সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন

এম আর মাসফি
এম আর মাসফি
শেয়ার
পালিয়েছেন ঠিকাদাররা ইতিহাসের সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন নেমে এসেছে ইতিহাসের সবচেয়ে নিচে। সদ্য শেষ হওয়া এই অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার হয়েছে মাত্র ৬৭.৮৫ শতাংশ, যা গত দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এই চিত্র।

অর্থবছরের শুরু থেকেই এডিপি বাস্তবায়নে গতি ছিল মন্থর।

এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের আগস্টে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার বদলের পরপরই দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন অস্থিরতা দেখা দেয় এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। আগের সরকারের সময় নানা সুবিধা পাওয়া অনেক ঠিকাদার প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
ফলে নতুন সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নে হিমশিম খেতে থাকে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অযাচিত ব্যয় বন্ধে কঠোরতা আরোপ প্রকল্প যাচাই-বাছাই ও অপ্রয়োজনীয় খাতগুলোতে অর্থছাড় বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়া হয়। এর ফলে একদিকে উন্নয়ন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে এলেও অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন মারাত্মকভাবে শ্লথ হয়ে পড়ে।

আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে এক হাজার ৪৬৮টি প্রকল্প ছিল এডিপির আওতায়।

এসব প্রকল্পের জন্য সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন প্রকল্পগুলোর বিপরীতে ব্যয় হয়েছে মাত্র এক লাখ ৫৩ হাজার ৪৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ পুরো বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশের মতো অর্থ খরচই হয়নি।

অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও দেখা গেছে ব্যয় কমে যাওয়ার প্রবণতা। এ মাসে খরচ হয়েছে ৪২ হাজার ৪৪৫ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা সংশোধিত বরাদ্দের মাত্র ১৮.৭৭ শতাংশ।

অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে জুন মাসে খরচ হয়েছিল ৫৮ হাজার ৭৪২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা ছিল বরাদ্দের ২৩.০৯ শতাংশ। অর্থাৎ মাসিক হিসাবেও ব্যয় কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে সবচেয়ে বড় ধস দেখা গেছে বিদেশি সহায়তানির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে। সংশোধিত এডিপিতে বিদেশি ঋণ ছিল ৮১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৬৫.৫৩ শতাংশ। এই হারও ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এমনকি কভিড মহামারির মধ্যেও এই খাতে ব্যয় হয়েছিল ৯২ শতাংশের বেশি।

আইএমইডির ওয়েবসাইট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনো অর্থবছরেই এডিপি বাস্তবায়নের হার ৮০ শতাংশের নিচে নামেনি। করোনাকালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার ছিল ৮০.৩৯ শতাংশ, যা এবারকার তুলনায় ১২.৫৪ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৯৪.৬৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৯৪.০২ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯২.৭২ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯২.৭৪ শতাংশ এবং ২০১১-১২, ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও ৯৩ শতাংশের ওপরে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল। এককথায়, কোনো অর্থবছরেই বর্তমান অর্থবছরের মতো এত খারাপ হয়নি।

এডিপি বাস্তবায়নে খাতভিত্তিক চিত্রেও ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ করা গেছে। কিছু কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের অর্ধেকও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বাস্তবায়ন হার ছিল মাত্র ১৫.৩৬ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ খরচ করেছে ২১.৭৪ শতাংশ। এ ছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয় ৩৭.৪৬ শতাংশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ৩২.০২ শতাংশ, জননিরাপত্তা বিভাগ ৩৯.৫৫ শতাংশ এবং সরকারি কর্ম কমিশন ৩৭.৪৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে।

অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৯৯.৫৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ৯৮.১০ শতাংশ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ৯৮ শতাংশ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৯৪.৭৭ শতাংশ, কৃষি মন্ত্রণালয় ৯১.০৭ শতাংশ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ৯১.৫৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, তারা তাদের বরাদ্দকৃত ৩৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় করেছে ৩০ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, যা ৮৪.৫০ শতাংশ।

এ বিষয়ে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্য অর্থবছরগুলোর তুলনায় এবারের এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে, এটা ঠিক। তবে সরাসরি তুলনা সঠিক হবে না, কারণ গত অর্থবছরের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবে এমনটি হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, পরে অন্তর্বর্তী সরকার অযাচিত অর্থ খরচে কঠোর হয়। এ কারণে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বিশ্লেষকদের মতে, শুধু বাজেট বরাদ্দ দিলেই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। পরিকল্পনা, দক্ষতা ও প্রশাসনিক সক্ষমতাএই তিনের সমন্বয় না হলে এডিপি বার্ষিক টার্গেটের নিচেই থেকে যাবে। প্রতিবছর এডিপি বাস্তবায়নে গতিশীলতা আনতে সরকারের তরফ থেকে চাপ দেওয়া হলেও বাস্তব ফলাফল দৃশ্যমান নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়ানো, দীর্ঘসূত্রতা কমানো এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর জবাবদিহির আওতায় আনাই হতে পারে ভবিষ্যতের বাস্তবায়ন সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

 

 

 

মন্তব্য
নির্বাচন প্রসঙ্গে জামায়াত আমির

কোনো মাস্তানতন্ত্র, কালো টাকার খেলা মানব না

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট
নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট
শেয়ার
কোনো মাস্তানতন্ত্র, কালো টাকার খেলা মানব না
শফিকুর রহমান

নির্বাচন বিলম্বিত হলে জটিলতা সৃষ্টি হবে জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, তবে আমরা কোনো প্রি-ম্যাচিউর ডেলিভারি চাচ্ছি না। যে বাচ্চা ছয় মাসের মাথায় জন্ম নেয় তাকে ইনকিউবেটরে রাখতে হয়। ওই বাচ্চা সারা জীবন দুর্বল থাকে। আমরা এ রকম কোনো দুর্বল ও ইমম্যাচিউর গণতন্ত্র ও নির্বাচন চাচ্ছি না।

গতকাল বুধবার বিকেলে সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌর শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি ও সুধি সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

জামায়াতের আমির বলেন, অবশ্যই দেশকে সুশৃঙ্খল অবস্থানে আনতে আমাদের একটি কার্যকর নির্বাচন লাগবে। আমরা আশা করছি, আগামী বছরের প্রথম অংশে এ নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচন কেমন চাই? আমাদের স্পষ্ট বক্তব্যঅতীতের বস্তাপচা ধারার কোনো নির্বাচন আমরা চাই না এবং মেনে নেব না।

নির্বাচন হতে হবে স্বচ্ছ, সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ওপর। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে হবে, কোনো   মাস্তানতন্ত্র, কালো টাকার খেলা মানব না।

স্থানীয় নির্বাচন আগে দেওয়ার বিষয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলেছি দুর্ভোগ কমানোর জন্য। বহু জায়গায় জনপ্রতিনিধি নেইজনগণকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

এ কিসের রাজনীতি যে জনগণকে সাফারিংয়ের মধ্যে রেখে দেব?

প্রবাসীদের ভোটাধিকারের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই গণ-অভ্যুত্থান আমরা একা করিনি। আমাদের প্রবাসীরাও এতে সমান কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁদের ভোটাধিকার কেন থাকবে না? প্রবাসীদের ভোটাধিকার নেই বলে সরকারও তাঁদের গুরুত্ব দেয় না। তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া হয় কেবল এক জায়গায়রেমিট্যান্স পাঠাতে বলে। আল্লাহর ইচ্ছায় আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, জমিনের দায়িত্ব ও কৃতিত্ব বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের।

আমরা কাউকে কোনো মাস্টারমাইন্ড মানি না এবং নিজেদেরও মাস্টারমাইন্ড দাবি করি না। যদি আমরা নিজেদের মাস্টারমাইন্ড বলি তবে বাকি সবাইকে আন্ডারমাইন্ড করা হবে।

তরুণদের কাজে লাগানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক দেশে ৪২ শতাংশের বেশি জনশক্তি রয়েছে, যাদের বয়স ৭০ বছরের বেশি। আমাদের দেশে ৩৫ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের সংখ্যা বেশি। এরাই একটি সমাজকে গড়ে দিতে পারে। এটি বিশাল একটি শক্তি আমাদের দেশের। আমাদের মাটির নিচে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন। মাটির ওপরেও দিয়েছেন, সমুদ্রের তলেও দিয়েছেন। কিন্তু এত সম্পদ দেওয়ার পরও কেন আমরা দেশটা গড়তে পারলাম না? উত্তর একটিইচারিত্রিক সম্পদের অভাব। দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, যাঁরাই যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে গেছেন তাঁরা প্রথমে চিন্তা করেছেনআমার সুবিধাটা কোথায়? এরপর চিন্তা করেছেনআমার দলের সুবিধা কোথায়? এই দুই সুবিধা নিতে গিয়ে তারা হাঁপিয়ে উঠেছেন। এরপর জনগণের দিকে ভালোভাবে ফিরে তাকানোর সময় তারা পাননি। তিনি দুঃখ করে বলেন, এরা দুদককে ভয় পায়, আল্লাহকে ভয় পায় না। যদি তারা আল্লাহকে ভয় পেত, তাহলে জনগণের সম্পদে হাত দিত না।

মন্তব্য

মমতাময়ী শিক্ষিকা মেহরিনের প্রশংসা করে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর শোক

কালের কণ্ঠ ডেস্ক
কালের কণ্ঠ ডেস্ক
শেয়ার
মমতাময়ী শিক্ষিকা মেহরিনের প্রশংসা করে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর শোক
মেহরিন চৌধুরী

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত ও হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। পাশাপাশি প্রশংসা করেছেন ২০ শিশুকে বাঁচানো শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরীর।

গতকাল বুধবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্টের মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেন আনোয়ার ইব্রাহিম।

ওই পোস্টে তিনি লেখেন, ঢাকার স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা শোনার পর বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার খারাপ লাগছে।

আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। অনেকের প্রাণ গেছে, যার মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। আহত হয়েছে শতাধিক। তিনি আরো লেখেন, নিহতের তালিকায় থাকা মেহরিন চৌধুরী অনেক শিক্ষার্থীকে রক্ষা করেছেন।
শিশুদের রক্ষায় তিনি ধোঁয়া ও আগুনের স্ফুলিঙ্গের মধ্যে চলে যান। তাঁর এই সাহসিকতা ভোলার মতো নয়। বাংলাদেশের প্রতি সংহতি জানিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম লেখেন, আমি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখে সমবেদনা জানাব। এই দুঃখের মুহূর্তে আমরা আপনার পাশে আছি।
আমরা প্রতিটি হারানো প্রাণের জন্য শোকাহত এবং প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা জানাই। উল্লেখ্য, গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ