গত ৫০ দিনে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৮৮টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ৩০ বার মূল সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া গত এক মাসে ৪২টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অন্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনাও ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৪টি. সরকারি সংস্থা অফিসসংক্রান্ত তিনটি, রাজনৈতিক কোন্দল ৯টি এবং অন্যান্য ঘটনা ছিল ১৬টি।
গতকাল সোমবার ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সেনা সদর আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান সেনা সদর মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম।
তিনি সংবাদ ব্রিফিংয়ে গত ৫০ দিনে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, ২৮ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫০ দিনে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে (মূলত গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভার এলাকায়) ৮৮টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ৩০ বার মূল সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। কারখানাগুলোকে চালু রাখার জন্য মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, শিল্পাঞ্চল পুলিশ, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানে দেশের দুই হাজার ৯৭টি পোশাক কারখানার মধ্যে গুটিকয়েক (বেক্সিমকো গ্রুপ, সাউদার্ন ডিজাইনারস লিমিটেড, স্বাধীন গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড এবং সেলফ ইনোভেটিভ ফ্যাশন লিমিটেড) ছাড়া সব কারখানাই চালু রয়েছে।
এ ছাড়া সারা দেশে সেনাবাহিনীর কর্মতৎপরতায় চাঁদাবাজি ও হত্যা আগের চেয়ে কমে এসেছে বলে জানানো হয়।
কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখছি। শুধু মব জাস্টিস নয়, যেকোনো ধরনের চাঁদাবাজি-হত্যা আগের চেয়ে কমে এসেছে। কিছু হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো নজরে রাখছি।
অদূর ভবিষ্যতে আরো কমে আসবে।
মব জাস্টিসের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, শুধু মব জাস্টিস নয়, চাঁদাবাজি, চুরি, রাহাজানি ও হত্যা আগের চেয়ে কমেছে। গত দুই মাস আগে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল ২৫০টি, কিন্তু বর্তমানে কমে ১২০টিতে নেমেছে। চুরি ৮৫০টির মতো হতো, বর্তমানে ৬০০টির নিচে নেমে এসেছে। হত্যা সাড়ে তিন শ ছিল, বর্তমানে ১২০-এ নেমেছে।
বান্দরবানের লামায় বেশ কয়েকজন শ্রমিককে অপহরণ করা হয়েছে। তাঁদের উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে কর্নেল শফিকুল বলেন, সেনাবাহিনীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, লামা থেকে ২০ জনের মতো শ্রমিককে গুম করা হয়েছে। কোনো একটি দুষ্কৃতকারী দল অপহরণ করেছে। তাঁদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ, বিজিবি ও আনসার বাহিনীরও অভিযান চলমান রয়েছে। অপহরণকারীরা একটি নম্বর দিয়েছে, তারা হয়তো টাকা চেয়েছে। শ্রমিকদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম চলমান।
পার্বত্যাঞ্চলে কুকি-চিনের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর পেট্রোলিংয়ের কারণে কুকি-চিনের দৌরাত্ম্য রোধ করতে পেরেছি। গতকালও (রবিবার) কুকি-চিনের দুটি ক্যাম্প (আস্তানা) ধ্বংস করেছি। এ ছাড়া কুকি-চিনের অত্যাচারে বাড়িছাড়া ১১টি বম পরিবারকে সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাদের গ্রামে আনা হয়েছে। কুকি-চিনের বিরুদ্ধে আভিযানিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুর ও বনানীতে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য এবং কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। আর যাঁরা অবসরপ্রাপ্ত সদস্য তাঁদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করা হবে। কোনো অন্যায়কে সেনাবাহিনী কখনো প্রশ্রয় দেয় না। সেনাবাহিনী সব সময় সততার সঙ্গে আছে এবং থাকবে। জনগণের আস্থার জায়গায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পাশে পাবেন। দেশের মানুষের পাশে থেকে সেনাবাহিনী সব সময় নিরপেক্ষ পন্থা অবলম্বন করে কাজ করে।
সেনাবাহিনী মাঠে কাজ করতে গিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী কোনো চ্যালেঞ্জ ফেস করছে না। তবে আমরা দীর্ঘ ছয় মাস বাইরে নিয়োজিত রয়েছি। অন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে, এসব গুজব মনিটরিংয়ে সেনাবাহিনীর কোনো তৎপরতা আছে কি না জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কারোর মত প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। সবাই মত প্রকাশ করবে। সেনাবাহিনী কাউকে বাধা দিচ্ছে না। তবে কে, কেমন, কী মত প্রকাশ করছে এবং তা কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ এর বিচারের দায়ভার সাংবাদিকদের ওপর দিয়ে দিতে চাই।’
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সহায়তা চাইলে সেনাবাহিনী সেভাবে কাজ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ৫০ দিনে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী ১৭২টি অবৈধ অস্ত্র এবং ৫২৭ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।
সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা : কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম আরো বলেন, গত ৩১ ডিসেম্বর ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্য সব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগে অবস্থিত ফোনিক্স লেদার কমপ্লেক্সে সংঘটিত অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছে। বিশ্ব ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ইজতেমা ময়দানে তুরাগ নদের ওপর পাঁচটি ব্রিজ স্থাপন, বোম ডিসপোজাল দলসহ প্রয়োজনীয়সংখ্যক জনবল মোতায়েন ও পর্যাপ্তসংখ্যক সেনা সদস্য যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর সংস্কার কর্মকাণ্ড যেমন—অ্যান্টি পলিঘিনি অপারেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পরিচালিত খাল পুনরুদ্ধার অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছে।
তিনি বলেন, গত এক মাসে যৌথ অভিযানে ৩৩৪ মাদক কারবারি ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবৈধ মাদকদ্রব্য যেমন—ইয়াবা, ফেনসিডিল, অবৈধ মদ উদ্ধার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে গত এক মাসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত দুই হাজার ১৪২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, এসব কাজের পাশাপাশি সেনাবাহিনী দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং কক্সবাজার জেলায় এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্বও সার্বক্ষণিকভাবে পালন করে যাচ্ছে।
সেনা সদরের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময় যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী আজ পর্যন্ত তিন হাজার ৮৫৯ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে, যার মধ্যে ৪১ জন এখনো চিকিৎসাধীন। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, দেশের জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তা প্রদানসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধানের দিকনির্দেশনাকে অনুসরণ করে দেশের ৬২টি জেলায় সেনা সদস্যরা সার্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।