ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে এক হাজার চার শর বেশি হত্যা মামলা হয়েছে। ছয় মাস আগে থেকে এসব মামলা হলেও গতকাল শনিবার পর্যন্ত কোনো মামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এসব মামলার মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২১৩টি মামলা রয়েছে।
অন্যদিকে হাসিনাকে প্রধান আসামি করে জুলাই বিপ্লবের ঘটনায় প্রথম মামলা দায়েরকারী আমির হামজাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁর গরুর খামারে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৮৫৯টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যার ঘটনায় এক হাজার চার শর বেশি মামলা হয়েছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আগস্টে হত্যা মামলা হয়েছে ৬১৮টি, সেপ্টেম্বরে হয়েছে ২৮৩টি, অক্টোবরে ২৪৯টি, নভেম্বরে ২১১টি, ডিসেম্বরে ২০৪টি এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৯৪টি হত্যা মামলা হয়েছে।
প্রথম মামলার বাদীকে প্রাণনাশের হুমকি : গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশের বেশির ভাগ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর পর ৬ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা থানায় দায়িত্ব পালন করেননি। ১৫ আগস্ট থেকে থানার কার্যক্রম শুরু হয়।
ফলে ওই সময় থানায় মামলা করার সুযোগ পাননি বিচার প্রার্থীরা। এ পরিস্থিতিতে গত বছর ১৩ আগস্ট আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন আমির হামজা নামের সচেতন এক নাগরিক। গত বছর ১৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে মুদি দোকানের মালিক আবু সায়েদ নিহত হন। ওই ঘটনায় আমির হামজা বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবিপ্রধান মো. হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকে আসামি করা হয়। পাশাপাশি অজ্ঞাতপরিচয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাদের এই মামলায় আসামি করা হয়।
গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে দেওয়া আমির হামজার ভাষ্য, মামলা করার পর থেকে তিনি প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছেন। বিদেশি নম্বর থেকে ফোন করে তাঁকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেওয়া হয়। এর মধ্যে গত শুক্রবার রাজধানীর কল্যাণপুরে থাকা তাঁর একটি গরুর খামারে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
আমির হামজা বলেন, ‘মামলা করার পর থেকেই আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি সরকারের কাছে আমার নিরাপত্তা চাচ্ছি।’
কোনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি : সূত্র জানায়, ১৩ আগস্ট করা মামলার জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নিহত হওয়ার ঘটনায় একের পর এক মামলা হতে থাকে। রাজধানীসহ সারা দেশে এক হাজার ৪০০-এর বেশি শুধু হত্যা মামলাই হয়েছে। এতগুলো হত্যা মামলা হলেও গতকাল পর্যন্ত কোনো মামলারই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দেওয়া হয়নি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রথম মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আদালত থেকে বলা হলেও দুই দফা তারিখ পেছানো হয়। এর পরও পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যে তদন্তগুলো করছি, সেগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে করা হচ্ছে। কারণ এই তদন্ত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বিচার কার্যক্রম চলবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন। প্রকৃত অপরাধীরা যেন চার্জশিটভুক্ত হন, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।’
হাসিনার বিরুদ্ধে ২১৩ হত্যা মামলা : রাজধানীসহ সারা দেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত নভেম্বর পর্যন্ত ২৫৩টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ২১৩টি। বাকি মামলাগুলোর বেশির ভাগই হত্যাচেষ্টা ও অপহরণ মামলা। এ ছাড়া সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে ৯২ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হলেন ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশীদ। সারা দেশে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ১৭১টি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, যাঁর বিরুদ্ধে ১৫৫টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১১৭টি, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ১২৫টি, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৪৬টি এবং অতিরিক্ত ডিআইজি এস এম মেহেদী হাসানের নামে ৩১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৩২ জনের বেশি পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।