বিশিষ্ট বিজ্ঞান কল্পকাহিনি গবেষক ও লেখক ড. জাফর ইকবালের অদূরদর্শী চিন্তা এবং পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল সমীক্ষায় নেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাদ যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভুল জায়গা বাছাই, ভুল পরিকল্পনা, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা—সব কিছুতেই গলদ ছিল ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় নেওয়া এই প্রকল্পে।
তিন বছরে সাড়ে ছয় কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হওয়ার পর প্রকল্পটি এখন বাতিল হওয়ার মুখে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে সেটি কোনো কাজেই লাগত না, ২১৩ কোটি টাকার পুরোটাই জলে যেত।
প্রকল্পটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর একটি উপহার হিসেবে নেওয়া হয়েছিল।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে যেসব সাধারণ সমস্যা বেশি দেখা যায়, সেগুলো থেকে রেহাই পায়নি মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র নির্মাণের মতো কঠোর বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক নির্ভুলতা দাবি করা জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রকল্পও।
সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাব্বির হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় কর্মকর্তারা জানান, পরিকল্পিত মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ডোম ভূমি থেকে প্রায় ১৭২ ফুট উচ্চতায় স্থাপনের জন্য নকশা করা হয়েছিল। এই উচ্চতায় টাওয়ারটি সম্পূর্ণ নিশ্চল রাখা দুরূহ হবে। অন্যদিকে টাওয়ার নিশ্চল রাখার জন্য ভিত্তিমূল দৃঢ় করা হলে প্রকল্প ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে, যা কারিগরি ও আর্থিকভাবে কখনোই উপযোগী নয়।
প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, কর্কটক্রান্তি রেখা, যে কাল্পনিক রেখা বরাবর সূর্য সরাসরি কিরণ দেয় এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদবিন্দুতে অবস্থিত হওয়ায় মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্রের এই অবস্থানের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের কর্মকর্তারা এখন বলছেন, ভাঙ্গায় ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা ও কর্কটক্রান্তি রেখার ছেদবিন্দুর অবস্থান প্রতিবছর ১৫ মিটার করে দক্ষিণ দিকে সরে যাচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানান, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরে ওই ছেদবিন্দু ৬০ মিটার দক্ষিণে সরে গিয়ে প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির দক্ষিণ সীমানার প্রায় শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ছেদবিন্দু আরো সরে যাবে। ফলে প্রকল্পের অবস্থানটি ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত স্থানে কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি এবং বাতাসের আর্দ্রতার আধিক্য থাকায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্ত মহাকাশ গবেষণার কাজে ততটা উপযোগী হবে না।
এই মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র নির্মাণ করার বিষয়টি প্রথম সরকারের নজরে আনেন বিশিষ্ট কল্পকাহিনি গবেষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির এক সভায় তিনি ভাঙ্গায় একটি ‘বঙ্গবন্ধু মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র’ নির্মাণের প্রস্তাব দেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে প্রকল্প প্রস্তুতের নির্দেশ দেন। এরপর ২০২১ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
তখন প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, বিষুবরেখা, কর্কটক্রান্তি রেখা ও মকরক্রান্তি রেখা—এই তিনটি কাল্পনিক রেখা পূর্ব থেকে পশ্চিমে পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে। অন্যদিকে শূন্য (০) ডিগ্রি, ৯০ ডিগ্রি পূর্ব, ১৮০ ডিগ্রি পূর্ব-পশ্চিম ও ৯০ ডিগ্রি পশ্চিম—এই চারটি দ্রাঘিমারেখা উত্তর থেকে দক্ষিণে পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত এই তিনটি রেখা এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত চারটি দ্রাঘিমার সংযোগস্থল মোট ১২টি ছেদবিন্দু তৈরি করেছে। এর মধ্যে ১০টি ছেদবিন্দুই মহাসাগরে অবস্থিত। শুধু দুটি ছেদবিন্দু রয়েছে স্থলভাগে। স্থলভাগে থাকা দুটি ছেদবিন্দুর সংযোগস্থলের একটি সাহারা মরুভূমিতে, অন্যটি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। ১২টি ছেদবিন্দুর মধ্যে ভাঙ্গার এই বিন্দুই ভ্রমণকারীরা সহজে দেখতে যেতে পারে।
তবে এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্কটক্রান্তি রেখা এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদবিন্দু একটি জাতীয় মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র নির্মাণস্থল বাছাইয়ের জন্য প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো রাতের আকাশ কত দিন পরিষ্কার থাকে, কৃত্রিম আলোর দূষণ না থাকা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম হওয়া। ঘূর্ণন অক্ষ ধীরে ধীরে বদলানোর কারণে পৃথিবীর ঢাল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। এর ফলে ছেদবিন্দুটি প্রতি শতাব্দীতে প্রায় ৪৭ সেকেন্ড দক্ষিণে সরে যায়, যা ১০০ বছরে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার সরে যাওয়ার সমান।
প্রকল্পটিতে ১০ একর জমির ওপর পাঁচতলা বৃত্তাকার (আংটি আকৃতির) একটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর কেন্দ্রে পৃথক ভিত্তিমূল থেকে এক মিটার ব্যাসের একটি মূল পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরির নকশা করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, টাওয়ারটিতে ১০ মিটার ব্যাসের অনুভূমিকভাবে ঘূর্ণায়মান একটি প্ল্যাটফরম স্থাপন করা হবে, যেখানে রেইফ্লেক্টর টেলিস্কোপ স্থাপন করা যাবে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ভূমিস্তর এবং বৃত্তাকার প্ল্যাটফরমকে সেকেন্ডারি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
প্রস্তাবে টাওয়ারটির উচ্চতা ১০০ মিটার নির্ধারণ করা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে। পাঁচতলা বৃত্তাকার ভবনটিতে অফিসকক্ষ, শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও আবাসনের ব্যবস্থা রাখা হতো। সম্পূর্ণ প্রকল্পের অর্থায়ন করত সরকার।
এমন ভুল পরিকল্পনায় প্রকল্প নেওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এই প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে আরো ভালো সমীক্ষা দরকার ছিল, যাতে এমন প্রকল্প বাদ না যায় এবং জনগণের অর্থ অপচয় না হয়।