দেশজুড়ে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রশাসনিক এলাকায় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের নিয়ে বড় আকারের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এসব আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ বাস্তবায়নে গণসংযোগ কর্মসূচি করছে তারা।
তবে সাংগঠনিক কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফরমটির সদস্যরা জড়িয়ে পড়েছেন অন্তঃকোন্দলে।
কোন্দল থেকে কয়েকটি সাংগঠনিক কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়েছেন। এসব সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১০ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দপ্তর সেল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৩৫টি জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাংগঠনিক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরের অন্তর্গত থানাগুলোতে।
এর অংশ হিসেবে গত ৯ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের ছয়টি থানার কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ ছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত সাত কলেজ, ঢাকা পলিটেকনিকসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংগঠনিক কমিটি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সারা দেশেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে আমাদের জনসংযোগ চলছে। যেসব জেলা, মহানগর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাঁরা আমাদের লিফলেট নিয়ে আনাচকানাচে যাচ্ছেন।
জুলাই অভ্যুত্থান এবং এটির মাধ্যমে যে গণ-আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে, তার স্বীকৃতির জন্য আমাদের এই জনসংযোগ কর্মসূচি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরাই মূলত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জেলা ও প্রশাসনিক এলাকাভিত্তিক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ওই এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রশাসনিক এলাকার বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, যাঁরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণ-অভ্যুত্থানের সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের যুক্ত করা হয়েছে।
গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে সর্বশেষ ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত বিভিন্ন জেলা ও থানা কমিটির বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় কমিটির মতোই একজন করে আহ্বায়ক, সদস্যসচিব ও মুখ্য সংগঠকের নেতৃত্বে তুলনামূলক বড় সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শতাধিক সদস্যের এসব কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক, যুগ্ম সদস্যসচিব ও সংগঠকদের বেশির ভাগই স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সদস্য। এর বাইরে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়, অধিভুক্ত সাত কলেজ, জাতীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তাঁদের জেলা কমিটিতে স্থান পেয়েছেন।
গত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান সাধারণত স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে তিন শীর্ষ পদের দুটির সঙ্গে (আহ্বায়ক, সদস্যসচিব ও মুখ্য সংগঠক) অতিরিক্ত একটি করে জ্যেষ্ঠ আহ্বায়ক ও জ্যেষ্ঠ সদস্যসচিব পদ যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যক্রম সহজ ও গতিশীল করতে গঠন করা হয়েছে দপ্তর, কর্মসূচি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, ইমার্জেন্সি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বিষয়ক সেল। অভ্যুত্থানের ডকুমেন্টেশন, বিচারিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে স্মারক নির্মাণে গঠন করা হয়েছে আলাদা টিম।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দপ্তর সেলের সম্পাদক জাহিদ আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সারা দেশে আমাদের সংগঠকরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে গণসংযোগ করছে।’
বাড়ছে অন্তঃকোন্দল
গত ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ওয়াসা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। ওই দিন ঘটনায় সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন করতে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ ও আরেক সমন্বয়ককে অবরোধ করার অভিযোগ ওঠে। পরে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী বিবদমান দুই পক্ষ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ সমন্বয়ক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব ঘটনায় নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ সমর্থিত ডট গ্যাং জড়িত। কিছু সমন্বয়কের যোগসাজেশে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। যতগুলো অভিযোগ রয়েছে, সবগুলোরই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আমরা আশা রাখি।’
এর আগে ৯ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীন সাতটি থানা (মিরপুর (দারুসসালাম), মিরপুর মডেল, পল্লবী, কাফরুল, রূপনগর, শাহ আলী, ভাসানটেক) কমিটি গঠন করা হয়। পরদিন মিরপুর মডেল থানা কমিটি পদ না পাওয়ার জেরে কয়েকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে অবস্থানরত শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়ান। এ ছাড়া কমিটি এবং বিভিন্ন ঘটনার জেরে সম্প্রতি পিরোজপুরসহ কয়েকটি এলাকায় সংঘাতে জড়িয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা।
এসব বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনার পেছনে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ইন্ধন রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও নিজেদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। আমরা তদন্ত সাপেক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’