চোখ বুজে একনিঃশ্বাসে বলে ফেলা যায়, ইন্টারনেট আমাদের চমৎকার অনেক কিছু উপহার দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে এই আধুনিক প্রযুক্তি মানুষের মন, মনের কোমলতা আর সামাজিক জীবনটাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, একদিন হয়তো এই ইন্টারনেটই আমাদের জীবনটাকে অত্যন্ত দুঃখময় ও বিবর্ণ বানিয়ে ছাড়বে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইন্টারনেটের সবচেয়ে অনন্য উপহার ই-মেইল।
এটা যেমন ব্যবসায়ের প্রসার বাড়াচ্ছে, তেমনি এটা গণযোগাযোগের কার্যকর মাধ্যম হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু এটা বিশ্বের শতকোটি মানুষকে না লেখার অভ্যাসটাও রপ্ত করিয়ে দিচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে, ফেসবুকের নেশায় ধরলে মানুষ মরতেও ভুলে যায়! যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম ও জার্মানিতে পৃথক গবেষণায় অভিন্ন প্রমাণ মিলেছে, ফেসবুক নেশা নতুন প্রজন্মের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধ ভোঁতা করে দিচ্ছে।
ফেসবুকের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া টুইটারও কম ক্ষতি করছে না।
চীনা গবেষকরা সিনা ওয়েবোতে (চীনা ভাষায় টুইটার ভার্সন) সাত কোটি পোস্ট নিয়ে গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ পেয়েছেন, ক্রোধ আর হিংসাই নতুন প্রজন্মকে টুইটারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে ভূমিকা রাখছে। গবেষকদের মূল্যায়ন, ‘টুইটার আমাদের খুব বেশি সুখী বানাচ্ছে না; রাগী বানিয়ে দিচ্ছে।’
শুধু তা-ই নয়, ইন্টারনেটকে বর্ণবাদ উসকে দেওয়ার উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে দেখতে পেয়েছেন গবেষকরা। যেমন—ফেসবুকে জ্যাক ব্রাউন নামের একজন ব্লগার লিখেছেন, সাদারা কালোদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ—যাঁরা একমত, তাঁরা লাইক দেন।
এর মাধ্যমে জমে উঠেছে বর্ণবাদ বিতর্ক এবং বিতর্কের ফল মোটেও ইতিবাচক নয়।
গবেষকরা দেখেছেন, ইন্টারনেট এমন একটি প্রযুক্তি, যা ব্যবহারকারীর ভিজ্যুয়াল লিটারেসি স্কিল বাড়ায়। কিন্তু এই ইন্টারনেট আসক্তিই মানুষের চিন্তার ক্ষমতা কমায়। উচ্চারণক্ষমতাও কমে যায়। সন্দেহ নেই, ইন্টারনেটের কারণে আমাদের চিন্তন পদ্ধতি ও কর্মকৌশল পাল্টে যাচ্ছে।
এটা কি আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তন পদ্ধতিকে নতুন করে স্থাপন করে? সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিষয়টা আসলে তা-ই হচ্ছে। ফেসবুক সদস্য ১২৫ শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণা চালিয়ে ব্রিটিশ গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। শুধু তা-ই নয়, ইন্টারনেট যে আমাদের আচার-আচরণে প্রভাব ফেলছে, সেটারও অজস্র প্রমাণ রয়েছে।
বহুজাতিক কম্পানিগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের পণ্যের বিপণনে ভোক্তাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। হাজারো পণ্যের ভিড়ে ভোক্তারা ভালো-মন্দের ব্যবধানও সঠিকভাবে সব সময় নির্ণয় করতে পারে না। গবেষকরা দাবি করেছেন, ইন্টারনেটের প্রসারের কারণে বহুজাতিক কম্পানিগুলো বর্ধিত হারে ভোক্তাদের বিবেচনাবোধে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়ে গেছে।
২০০৯ সালে আল-কায়েদার তৎপরতা নিয়ে বিবিসি পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে ইন্টারনেট। বিশেষ করে আল-কায়েদার মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো সদস্যকে যখন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ বলা হয়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তার সম্পর্কে বেশি করে জানতে তৎপর হয়ে ওঠে। এটা অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গি রিক্রুটেও ভূমিকা রেখেছে।
ইন্টারনেট ইউজ ডিস-অর্ডার (আইইউডি) এখনো অফিশিয়ালি মেন্টাল ডিস-অর্ডার বা রোগ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। তবে গবেষকরা দাবি করছেন, ইন্টারনেট আসক্তি ব্যবহারকারীদের জন্য হেরোইনের চেয়ে কম আসক্তির নয়। ১৪ বছরের শিশুও আজ প্রশ্ন তুলছে, ‘আমার মা অনলাইনে এত বেশি সময় কেন দিচ্ছে?’ বিষয়টি নিয়ে শত শত গবেষণা হয়েছে। এবং কোনো গবেষণায় এটা দাবি করা হয়নি, ইন্টারনেট আসক্তি বা আইইউডির কোনো ইতিবাচক দিক রয়েছে।
ইন্টারনেটের সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকটি হচ্ছে, এটা অন্যের মানসিক অনুভূতির দিকে নজর রাখতে ব্যবহারকারীকে মোটেও উৎসাহিত করে না। মাত্র ৩০ বছর আগেও যুবসমাজ অন্যের অনুভূতির ব্যাপারে এতটা উদাসীন ছিল না। গবেষকরা বলছেন, ইন্টারনেট আসক্তি পারিবারিক বন্ধন আলগা করে দিচ্ছে। এতে সামাজিক বন্ধনও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। এটা সাংস্কৃতিক চেতনার দিক থেকে উৎকট ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ উসকে দিচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নেট ব্যবহারকারীরা ‘ইয়েসম্যানদের’ দ্বারা বেষ্টিত হয়ে যায়। এসব ইয়েসম্যান বলয়ের প্রতিটি সদস্যের প্রতিটি কথায় ইতিবাচক সাড়া দেয়, অথচ কখনোই বন্ধুর সত্যিকারের সমালোচনা করে না।
শুধু প্রয়োজনীয় খবরই নয়, ইন্টারনেট অপ্রয়োজনীয় খবর আর গুজবও ছড়াতে সহায়তা করে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ইন্টারনেট ব্যবহার করা এবং না করা লোকদের মধ্যে ‘ডিজিটাল বিভেদ’ এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে।
তার পরও এটা সত্য, আমরা আজ প্রযুক্তির অগ্রগামিতার যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে এসে আমরা মোটেও ইন্টারনেটবিমুখ হতে পারি না। বরং ইন্টারনেটকে কিভাবে বৃদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনার সঙ্গে সৃষ্টিশীল খাতে সীমাবদ্ধ করে ফেলা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ যে ইন্টারনেট সামাজিক সংকট সৃষ্টি করছে, সেই ইন্টারনেটের মধ্যেই সমাধানের পথনির্দেশ পাওয়া যেতে পারে। হয়তো আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ নতুন করে বিনির্মাণ করতে হবে।