এতে জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্র, হূদরোগ ও স্নায়ুরোগ সেবাকেন্দ্র, হেপাটোবিলিয়ারি ও যকৃৎ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, কিডনি রোগ কেন্দ্র এবং মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকবে। এসব কেন্দ্রে যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে তাতে করে রোগীর অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার হবে না। সব ধরনের পরীক্ষা করে একই ছাদের নিচে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে দেশে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া নিরুৎসাহ করাও ছিল বড় উদ্দেশ্য। এতে মানুষের দুর্ভোগ ও চিকিৎসা ব্যয় উভয়ই কমবে।
সরেজমিনে গিয়ে যা দেখা গেল
গতকাল সোমবার দুপুরে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, নিচতলার রিসিপশনের পুরো লাউঞ্জে কোনো এসি নেই। শীতের দিনেও গরম অনুভূত হচ্ছে। ১০০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তালা ঝুলছে। বন্ধ আছে দুটি ভিভিআইপি ও চারটি ভিআইপি কেবিন। ৫৮ সাধারণ কেবিনে ভর্তি রয়েছে ২৩ জন রোগী। এ ছাড়া ১০০ শয্যার জরুরি ইউনিটে চিকিৎসা চলছে ১৪ জন ডেঙ্গু রোগীর। উদ্বোধনের পর কিছুদিন বেশ কিছু অস্ত্রোপচার হলেও এখন তা-ও বন্ধ।
হাসপাতালের কিছু জায়গায় এসির পাইপ চুইয়ে দেয়াল ভিজে আছে। শৌচাগারের পানি ওয়ার্ড ও কেবিনে চলে আসে। বেশ কিছু ফ্লোর টাইলসে শেওলা পড়ে গেছে। পলেস্তারা ও পেইন্ট খসে পড়ছে। এক্স-রে মেশিনের বেশির ভাগই অ্যানালগ পদ্ধতির, সার্জারির ক্ষেত্রে ব্যবহূত হচ্ছে পুরনো কয়েকটি মেশিন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অকেজো অনেক আগে থেকে। আইপিএসগুলো ব্যবহূত না হওয়ায় নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও আধুনিক নয়।
আইসিইউসংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানান, আইসিইউ ভেন্টিলেটরের ফিল্টার ও অন্যান্য সাপোর্ট ডিভাইস নেই। একই সঙ্গে পোস্ট-ট্রান্সপ্লান্ট আইসিইউ নেই।
প্রথম বছরেই যে সমস্যাগুলো উঠে আসে : প্রকল্পে স্বয়ংক্রিয় গেট ও পার্কিং ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হলেও ক্রটিপূর্ণ যন্ত্রের কারণে ব্যবস্থাটি কাজ করে না। হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে সাধারণের চলাচলের পথে ঘাস লাগিয়ে অর্থের অপচয় করা হয়। পশ্চিম পাশে পাঁচ হাজার লিটার অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু সেটি সঠিক জায়গায় বসানো হয়নি। এতে অক্সিজেন সরবরাহকারী কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। ফলে সেটি অব্যবহূত। হাসপাতালের বেইসমেন্ট-২-এ মর্গ থাকলেও মরদেহের গোসলের ব্যবস্থা নেই। বেইসমেন্ট-১-এ গাড়ি ওঠা ও নামা ঝুঁকিপূর্ণ। পার্কিং টাইলসের স্থলে ব্যবহূত হয়েছে পিচ্ছিল টাইলস। এতে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।
লেভেল-১-এ অবস্থিত জরুরি বিভাগে ১০০ শয্যার জায়গায় শয্যা রয়েছে মাত্র ৫০টি। বাকি ৫০ শয্যা রাখা হয়েছে লেভেল-৭-এ। এতগুলো রোগীর জন্য শৌচাগার রয়েছে মাত্র চারটি। জরুরি অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসকদের হাইজিন ব্যবস্থা ও ড্রেস পরিবর্তনে কোনো কক্ষ রাখা হয়নি।
হাসপাতালের কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা থাকলেও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতিস্থাপনের জন্য আলাদা কোনো আইসিইউ রাখা হয়নি। হাসপাতালে কোরিয়ার তৈরি লিফট ব্যবহার করার কথা থাকলেও ব্যবহূত হয়েছে চায়না লিফট। লেভেল ৭, ৮ ও ৯-এ অবস্থিত ওয়ার্ডগুলোতে মোট ৫৪০টি শয্যা থাকলেও ৪৪৪ শয্যায় কোনো এসি বা চিলারের ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে উন্নতমানের ফ্লোর টাইলস ব্যবহারের কথা থাকলে তা ব্যবহূত হয়নি, যা এক বছরের মধ্যে নষ্ট হওয়া শুরু করেছে। প্রকল্পে এক হাজার পিএবিএক্স টেলিফোন সংযোগের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত একটি সংযোগও দিতে পারেনি। মাস্টার ডাটা সংগ্রহের কাজটি পুরোপুরিভাবে করা হয়নি। দুটি ইকো মেশিনই পুরনো মডেলের, যা কোনো আধুনিক হাসপাতালে ব্যবহার হয় না। এক্স-রে মেশিনগুলো অ্যানালগ পদ্ধতির, যার প্রচলন নেই।
শুরু থেকে প্রকল্পের উপপরিচালকের দায়িত্বে থাকা সহযোগী অধ্যাপক নূর-ই-এলাহী মিম কালের কণ্ঠকে বলেন, তিন কারণে হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা যায়নি। এক. নানা ত্রুটি নিয়ে হাসপাতাল চালু হয়; দুই. হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, বিএসএমএমইউ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা; তিন. গত দুই বছরে পটপরিবর্তন হওয়া। যে কারণে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে হাসপাতালে পরিচালনার কাজ শুরু করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পে যেসব যন্ত্রাংশ দেওয়ার বিষয় উল্লেখ রয়েছে, এর বাইরে এখনো কোনো যন্ত্রাংশ আমরা পাইনি। এখনো অনেক যন্ত্রের ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি আছে। এর পরও যদি কোনো অভিযোগ থাকে সেটা সমন্বয় করে ঠিক করার সুযোগ রয়েছে; যেহেতু পুরো টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি।’
চালুর জন্য এক বছর সময় পেয়েছি : বিএসএমএমইউয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এর আগের প্রশাসনে সবাই আমার সিনিয়র, আমি উনাদের সম্মান করি। আগে কী হয়েছে সে বিষয়ে বলতে চাই না। আমি মনে করি, এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ, রক্ষার দায়িত্বও আমাদের।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে আমাকে এবং নতুন উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. শাহিনুল আলমকে দেওয়া হয়েছে। আমরা এক বছর সময় পেয়েছি। এই সময়ে নতুন করে নিয়োগ দিয়ে প্রশাসন সাজাব। সিন্ডিকেট ও গভর্নিং বডি পরিবর্তন করব। আমরা বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ঋণের টাকা এখনো দেওয়া শুরু হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি। এটুকু নিশ্চিয়তা দিতে চাই, অর্থনৈতিক কোনো বদনাম শুনবেন না।
জানা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশটির এক্সিম ব্যাংক এর অর্থায়ন করছে। ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর প্রকল্পের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি একনেক প্রকল্প অনুমোদন করে।