ছেলে রুহুল আমিনের প্রসঙ্গ তুলতেই রোজিনা খাতুন ডুকরে কেঁদে উঠলেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সুস্থ সন্তান জন্ম দিইছি আমি। খাইয়ে না খাইয়ে মানুষ করিছি। পুলিশ গুলি কইরে ছেলেডারে খুঁড়া বানায়ে দেছে।
‘আমাদের জীবন শেষ করে দিয়েছে এসপি আনিস’
- যশোরে গুলিতে পা হারানো দুই যুবকের অভিযোগ
আহসান কবীর, যশোর

আর বেশি কথা বলতে পারলেন না মধ্যবয়সী এই কৃষকবধূ। ফোন পেয়ে তার ছেলে রুহুল আমিন কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে এসেছিলেন কালের কণ্ঠ যশোর অফিসে। প্রায় আট বছর আগে কেটে ফেলা পায়ের চিকিৎসা চলছে এখনো। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন না।
সেদিন ছিল ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট।
সম্প্রতি এই ঘটনার বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) শরণাপন্ন হয়েছেন রুহুল ও ইসরাফিল।
রুহুল আমিন ও ইসরাফিল হোসেনের ভাষ্য, বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ তাদের ৩ আগস্ট আটক করে প্রথমে চৌগাছা থানায় নিয়ে যায়। সেখানে এক রাত তাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার করা হয়। পরদিন ৪ আগস্ট সকালে বাড়ি থেকে পাঠানো নাশতা খান তারা। স্থানীয় সাংবাদিক রহিদুল ইসলাম খান পেশাগত কাজে থানায় গিয়ে তাদের দুজনকে দেখতে পান এবং কথা বলেন। দুপুর ১২টার দিকে থানার এসআই আকিকুল ইসলাম আটক দুজনকে আদালতে হাজির করার কথা বলে যশোর ডিবি অফিসে নিয়ে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যায় ফের চৌগাছার উদ্দেশে নেওয়া হয় দুজনকে। যশোর-চৌগাছা সড়কের কয়ারপাড়া এলাকায় দুজনের চোখ বেঁধে হাত পিছমোড়া করে হাতকড়া পরানো হয়। এর কিছু সময় পর সেই বুন্দলিতলায় নির্জন মাঠে নিয়ে তাদের দুজনের একটি করে পায়ে গুলি করে পুলিশ। এরপর চোখ থেকে কাপড় খুলে তা পায়ের হাঁটুতে বেঁধে দেওয়া হয়। গুলি করার পর পুলিশ সদস্যরা চিৎকার করে মুখ খিস্তি করতে থাকেন। এতে আশপাশের কিছু লোক জুটলে এসআই আকিকুল আহত দুজনকে না চেনার ভান করে তাদের নাম জিজ্ঞাসা করতে থাকেন।
রুহুল ও ইসরাফিলের বর্ণনায়, এরপর তাদের আনা হয় প্রথমে চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে। তৃতীয় দিন তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে সাত দিনের মাথায় তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পা দুটি কেটে ফেলেন চিকিৎসকরা। এরপর দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে রুজু করা অস্ত্র মামলায় আদালতের মাধ্যমে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর দুজনকে জামিনে মুক্তি দেন আদালত।
‘ক্রসফায়ার নাটকের’ শিকার ইসরাফিল হোসেন ও রুহুল আমিন পরস্পর বন্ধু। সেই সময় ইসরাফিল যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে অর্থনীতি এবং রুহুল একই প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা প্রথম বর্ষে পড়তেন। তারা ছাত্রশিবির চৌগাছা উপজেলা শাখার যথাক্রমে সাধারণ সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন।
ইসরাফিল কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনে ন্যায়বিচার পাবেন না আশঙ্কায় তারা আইনের আশ্রয় নেননি। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা বিচার চান। সে কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছেন।
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত রুহুল আমিন বলেন, ‘আমাদের দুই বন্ধুর জীবন শেষ করে দিয়েছে যশোরের তৎকালীন কুখ্যাত এসপি আনিস ও তার খুনি বাহিনীর সদস্যরা। আমরা দুজনই গরিব ঘরের সন্তান। আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়ায় আনিস ও তার সহযোগীদের বিচার চাই।’
কথা হয় এই ঘটনায় অভিযুক্ত চৌগাছা থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আকিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি অভিযোগ বেমালুম অস্বীকার করেন। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ পিবিআইতে কর্মরত পুলিশ ইন্সপেক্টর আকিকুল টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল বলে মনে করতে পারছি না। আইসিটিতে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ হয়েছে কি না তা-ও জানি না।’
পা হারানো ইসরাফিল চৌগাছা উপজেলার চুটারহুদা গ্রামের গরিব কৃষক আবদুর রহমানের ছেলে। তার এক ভাই কৃষক, এক ভাই রাজমিস্ত্রি, আরেক ভাই বাসের সুপারভাইজার। সবচেয়ে ছোট ইসরাফিল যশোর এমএম কলেজ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের পর এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
রুহুল আমিন একই উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের ইমদাদুল হকের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় রুহুল। ছোট ভাই ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর রুহুল অনার্স শেষ করতে পারেননি। নিম্ন কৃষক পরিবারের এই সন্তান পরে স্থানীয় একটি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন।
ইসরাফিলের ভাই বাসের সুপারভাইজার শাহ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের যে দিন গেছে তা বর্ণনা করা যাবে না। ভাইকে গুলি করে পা খোঁড়া করে দিয়েও পুলিশ ক্ষ্যান্ত হয়নি। প্রায়ই বাড়িতে এসে হাঙ্গামা করত। টাকা দাবি করত। আমরা গরিব মানুষ। মাঠের জমি সামান্য। ভিটাও ছিল না। টাকার অভাবে ভাইয়ের চিকিৎসা খরচও ঠিকমতো জোগাতে পারিনি।’
ইসরাফিল ও রুহুল দুজনেরই একটি করে কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে। দুজন কালের কণ্ঠকে তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন। জানান, পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারেননি। এখনো চিকিৎসা শেষ হয়নি তাদের। তবু জীবনের তাগিদে চাকরি করতে হচ্ছে। পা হারানোর পর আগের সেই আনন্দময় জীবন নেই তাদের। এখন খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন না।
বন্দুকযুদ্ধের নামে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে দুই তরুণের পা নষ্ট করে দেওয়ার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত যশোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ দিকে রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ছিলেন। সরকার পতনের পর গোপালগঞ্জের এই বিতর্কিত অফিসারকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সংযুক্ত করা হয়। অনেক খুঁজেও তার বর্তমান অবস্থান জানা যায়নি।
আনিসুর যশোরের এসপি থাকাকালে বহু ক্রসফায়ার ও জঙ্গি নাটক হয়েছে। পুলিশ বিভাগে বলাবলি আছে, তার আগে-পরে যশোরে এত নৃশংস, দুর্নীতিবাজ, বেপরোয়া পুলিশ কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। হাসিনা সরকারের পতনের পর এসপি আনিসুরের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
সম্পর্কিত খবর

মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্ত
‘কেউ তো জানাবে আমার মেয়ে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে?’
নিজস্ব প্রতিবেদক

‘যদি দেখতাম আমার পাখি ফিরে এসেছে, দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে : আম্মু, দরজা খোল। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এমন বিলাপ ভেসে আসছিল রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আঙিনায়। কথাটি বারবার কানে বাজছিল অন্যদেরও। বিলাপ করছিলেন রাবেয়া খাতুন মিম।
এ ঘটনায় রইসার মা রাবেয়া খাতুন মিম চোখে অন্ধকার দেখছেন। বেশির ভাগ সময় বাকরুদ্ধ থাকছেন। গত সোমবার দিনভর স্কুল প্রাঙ্গণসহ রাজধানীর অন্তত আটটি হাসপাতালে ছুটে গেছেন, সন্তানের খোঁজ পাননি। আশায় বুক বেঁধে আছেন, হয়তো জীবিত অবস্থায় তাঁর কোলে ফিরে আসবে ছোট্ট শিশুটি।
যাঁরা তাঁর বিলাপ শুনছিলেন তাঁরা আরো কিছু জানতে চাইছিলেন। কিন্তু কান্নার জন্য রাবেয়া আর কিছুই বলতে পারছিলেন না। তিনি কেবলই বিলাপ করছিলেন। একই কথা বারবার বলছিলেন : ‘যদি দেখতাম আমার পাখি ফিরে এসেছে... দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে আম্মু, দরজা খোল।’
পাশেই ছিলেন রাইসার মামা সাগর হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাতভর রাইসাকে খুঁজেছি। সকাল হতেই আবার খুঁজতে এসেছি। তার বই, খাতা, আইডি কার্ড পেয়েছি। তাকে কেন পাওয়া যাচ্ছে না? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট কেউ তার খোঁজ দিতে পারছে না। জীবিত বা মৃত, যাই হোক সন্ধান তো পাওয়ার কথা।’
স্কুল প্রাঙ্গণে নিখোঁজ সন্তানের খোঁজ নিতে এসেছিলেন তানিয়া আক্তার। তাঁর মেয়ে মারিয়াম উম্মে আফিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে দিশাহারা তিনিও। সামনে যাকেই পাচ্ছিলেন তাকেই মেয়ের ছবি দেখিয়ে খোঁজ জানার চেষ্টা করছিলেন। আফিয়া এই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জানিয়ে তানিয়া আক্তার বলেন, ‘প্রতিদিন স্কুল শেষে সে কোচিং করত। নিজে থেকে বাসায় ফিরত। সেদিন (সোমবার) আর ফেরেনি। বিমান দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলের কাছে ছুটে যাই। কিন্তু আমার বাচ্চাকে কোথাও খুঁজে পাইনি। রাতভর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি। আজ সকালে আবারও স্কুলে এসেছি, হয়তো কেউ কিছু বলতে পারবে। কিন্তু কেউ তার খোঁজ দিতে পারছে না। অন্তত কেউ তো জানাবে আমার মেয়ে বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে!’

চিকিৎসক-নার্সদের অভিজ্ঞতা
‘ভেতরে যেন প্রাণ আছে বাইরে পোড়া লাশ’
- মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্ত
জুবায়ের আহমেদ

‘আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলছিল। হঠাৎ খবর আসে, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুল থেকে বেশ কিছু শিক্ষার্থী জরুরি বিভাগে আসছে। প্রথমে কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না কী ঘটেছে। আমরা প্রস্তুতি নিই, কিন্তু বুঝে উঠতে পারিনি ঘটনা এতটাই হৃদয়বিদারক!’
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোল স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার পর দগ্ধদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার এসব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর ডা. বজলুর রহমান আদিল।
আহতদের মধ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের অবস্থা গুরুতর ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু দগ্ধের শরীর থেকে চামড়া উঠে গিয়েছিল, যা দেখতে অত্যন্ত মর্মান্তিক ছিল। জীবিত মানুষের শরীর থেকে চামড়া উঠে যাওয়া এক বিভীষিকাময় দৃশ্য ছিল। ভেতরে যেন প্রাণ আছে, বাইরে পোড়া কোনো লাশ।’
শিশু শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে ডা. বজলুর রহমান আদিল বলেন, ‘শিশুদের অবস্থা আরো হৃদয়বিদারক ছিল।
ডা. বজলুর রহমান আদিল এ কথা বলতে বলতে কান্না ধরে রাখতে পারেননি।
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির বিভীষিকাময় দিনটি দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স সামিউল আলম। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আসে এক সাত-আট বছরের মেয়ে শিশু। মেয়েটির শরীরের চামড়া ঝুলছিল, কাপড় পুড়ে গেছে। অথচ তাদের সঙ্গে কেউ নেই, না অভিভাবক, না শিক্ষক।’
তিনি বলেন, ‘তখনো কেউ ভাবতে পারিনি, এটি কেবল শুরু। মাত্র পাঁচ-সাত মিনিট পরই একের পর এক পোড়া রোগী ঢুকতে থাকে জরুরি বিভাগে। কাউকে কাঁধে করে, কাউকে ট্রলিতে চাপিয়ে আনা হচ্ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা, তাদের শরীর পুড়ে কালো হয়ে গেছে। কারো মুখে চামড়া নেই, কারো পিঠ গলে গেছে, কারো শরীরের চামড়া ঝুলে ঝুলে পড়ছে। প্রথমে আনা প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থীর বেশির ভাগেরই ৯০ শতাংশ শরীর পুড়ে গিয়েছিল। শ্বাসকষ্টে থাকা দেহগুলোকে অক্সিজেন দেব, সেই অবস্থাও নেই। কারণ কণ্ঠনালিও পুড়ে গেছে।’
সিনিয়র এই নার্স বলেন, ‘জরুরি বিভাগের ফ্লোরে এত পানি জমে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল পায়ের গোড়ালি সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আছি। আর সেই পানির মধ্যে পড়ে আছে দগ্ধ শিশুরা, ব্যান্ডেজ আর স্যালাইন।’
মর্মান্তিক ঘটনা মনে করে লুবানা জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিরাজুন নাবী চঞ্চল বলেন, ‘ঘটনার দিন সারাক্ষণ কেবল শিশুদের যন্ত্রণা দেখেছি। রাতে গিয়ে ঘুমানো যায়নি। এত ছোট দেহে এত যন্ত্রণা! না তারা কোনো ভুল করেছে, যার জন্য এই সাজা? তারা তো কেবল স্কুলে গিয়েছিল!’

স্থায়ী কমিটির বৈঠক
বিএনপিকে বিব্রত করতে ‘অযৌক্তিক’ সংস্কার প্রস্তাব দিচ্ছে সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক

সংস্কারের নামে বিভিন্ন নতুন প্রস্তাব সামনে এনে অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটি বলেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এমন সব সংস্কার প্রস্তাব আনছে, যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়, যার কারণে বিব্রত হচ্ছে।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
বৈঠকে বিএনপি নেতাদের অভিমত, গণতন্ত্রের ইতিহাসে দেশে দেশে যেগুলোর স্বাভাবিক প্র্যাকটিস আছে, সেগুলোও কমিশন উপেক্ষা করতে চাচ্ছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল অন্য দলগুলো অনেক বড় দল নয়। নির্বাচন হলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সে ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাব মেনে নিলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য বলেন, বর্তমানে অযৌক্তিক অনেক সংস্কার প্রস্তাব আনা হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য বিএনপিকে বেঁধে ফেলা।
স্থায়ী কমিটির গত বৈঠকের মতো এ বৈঠকেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। দলটি তাদের মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য আনতে রাজি আছে। তবে এমন ভারসাম্য চায় না, যেখানে সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে না। স্থায়ী কমিটি মনে করে, সার্বিক বিবেচনায় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। বিএনপি নেতারা অভিমত দেন, রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা, অর্থাৎ স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দু-একটি বিষয়ে ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রপতিকে যদি ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করা হয়, তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্র তো তেমন অর্থবহ থাকবে না। সে ক্ষেত্রে সংসদেরই বা কী দরকার। প্রধানমন্ত্রীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে। তবে এই আলোচনায় এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা নিয়ে ভবিষ্যতে আরো আলোচনা হবে।
এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গত সোমবার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের মর্মান্তিক ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে সভায় শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় নিহত ছাত্র-ছাত্রী ও পাইলটের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত, আহতদের আশু সুস্থতা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা হয়।
সভায় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

পাকিস্তানের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি
ম্যাচের সঙ্গে সিরিজও বাংলাদেশের
বোরহান জাবেদ

একে তো পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের হাতছানি। মানসিক চাপ অনুভব করা অস্বাভাবিক ছিল না বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের। তার ওপর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়ে গেছে পুরো দেশকে। সেই বিষণ্নতা ছুঁয়ে গেছে লিটন দাস-তাওহিদ হৃদয়দেরও।
এই সংস্করণে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবার সিরিজ জয়ের স্বাদও যোগ হয়েছে এই জয়ে। স্বাভাবিকভাবে উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে গেছে কানায় কানায় পরিপূর্ণ মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারির দর্শকদের। অবশ্য ম্যাচের পূর্বাভাসে রঙিন দিনের বার্তা ছিল না।
চার বল বাকি থাকতে পাকিস্তান অলআউট হয় ১২৫ রানে। মিরপুরের উইকেটে প্রথম টি-টোয়েন্টির মতো গতকালও ব্যাট হাতে রীতিমতো খাবি খেয়েছেন পাকিস্তানের ব্যাটাররা।
পাকিস্তানের ইনিংসের পতন শুরু হয় সাইম আইয়ুবের রান আউট দিয়ে। এরপর শরিফুল ইসলামের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরেন মোহাম্মদ হারিস। এক ওভার বিরতি দিয়ে নিজের পরের ওভারে সফরকারী দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটার ফখর জামানের উইকেট তুলে নেন তাসকিন আহমেদের জায়গায় একাদশে ঢোকা শরিফুল। পরের ওভারে প্রথমবার আক্রমণে এসে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপের কোমর ভেঙে দেন তরুণ পেসার তানজিম হাসান সাকিব। টানা দুই বলে দুই নাওয়াজকে ড্রেসিংরুমের পথ দেখিয়ে দেন তানজিম। অফ স্টাম্প লাইনে লাফিয়ে ওঠা দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে আগ্রাসী ব্যাটার হাসান নাওয়াজকে উইকেটকিপার লিটন দাসের ক্যাচে পরিণত করেন তানজিম। এই পেসারের একই রকম ডেলিভারিতে উইকেটকিপার লিটনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন মোহাম্মদ নাওয়াজও।
প্রথম পাঁচ ব্যাটারকে ১৫ রানের মধ্যে হারানো পাকিস্তান আর দিশা খুঁজে পায়নি। বরং উইকেটে হাঁপিয়ে উঠে প্রথম টি-টোয়েন্টি-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান দলের কোচ মাইক হেসনের কথার সঙ্গে যেন একাত্মতা ঘোষণা করে যান সালমান আগা। অফ স্পিনার শেখ মেহেদী হাসানের বলে আউট হওয়ার আগে ২৩টি বল খেলেন পাকিস্তান অধিনায়ক। ৯ রান করেন সালমান। একবারের জন্যও মনে হয়নি তিনি ব্যাটিংটা ঠিকঠাক করতে পারেন এবং এই সংস্করণে চলতি বছর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (২৬৯) ও স্ট্রাইক রেট (১৩৬.৮৪) তাঁর। ব্যাটে বল ছোঁয়াতে রীতিমতো সংগ্রাম করেছেন তিনি। প্রথম ম্যাচ শেষে মিরপুরের উইকেট নিয়ে কোচ হেসনের সঙ্গে সমালোচকের তালিকায় যুক্ত ছিলেন সালমানও। তাঁর দাবি ছিল, বাংলাদেশে কখনোই ভালো মানের উইকেট পাওয়া যায় না।
এই ম্যাচের পর সালমানের সেই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হবে বৈকি। সালমানের বিদায়ের পর রানের চাকা ঘোরাতে চেষ্টা করেন ফাহিম আশরাফ, আব্বাস আফ্রিদি ও দানিয়েল। শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা বৃথা গেছে। বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুটাও পাকিস্তানের মতো। পাওয়ার প্লের ৫.৫ ওভারে ২৮ রানে প্রথম সারির চার ব্যাটার মোহাম্মদ নাঈম, পারভেজ হোসেন ইমন, লিটন দাস ও তাওহিদ হৃদয়ের উইকেট হারায় বাংলাদেশ। এদিন তানজিদ হাসান তামিমকে বসিয়ে একাদশে সুযোগ দেওয়া হয় নাঈমকে। ৭ বলে ৩ রান করে নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি এই বাঁহাতি ওপেনার। আড়াই বছরের বেশি সময় পর সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সিরিজ দিয়ে দলে ফিরেছিলেন নাঈম। সেই সিরিজে এক ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন চার নাম্বারে। সিরিজ শেষে জানিয়েছিলেন, চারে খেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। যদিও গতকাল পছন্দের ওপেনিংয়ে নেমেও নাঈমের ব্যাটিংয়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। চার উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশের ইনিংসের গল্পটা সীমাবদ্ধ জাকের আলী অনিক ও শেখ মেহেদীর দুটি ইনিংসে। পঞ্চম উইকেটে দুজনে ৫৩ রান যোগ করে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিয়েছিলেন। এখান থেকে ৩৩ রান করে শেখ মেহেদী আউট হয়ে গেলেও বাংলাদেশ ইনিংসের শেষ ওভার পর্যন্ত ছিলেন জাকের। শেষ বলে আব্বাস আফ্রিদির হাতে আউট হওয়ার আগে জাকেরের ব্যাট থেকে আসে ৫৫ রান। তাতে যে লড়াইয়ের পুঁজি আসে, সেটা দিয়েই পাকিস্তানের ব্যাটারদের বেঁধে ফেলেন বাংলাদেশের বোলাররা। আনন্দ দ্বিগুণ হয়েছে সিরিজ জয়ের ছোঁয়ায়।