কেবল ঘরে ঢুকতেই চাবি লাগে? সম্পর্ক, মন, বন্ধুত্ব—সব কিছুতে ঢোকার জন্য একটা চাবির প্রয়োজন। চাবি ভুল হলে দরজা আটকায়। আর না খোলার যন্ত্রণাই জটিল করে তোলে আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া। বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন বলেই শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘চাবি’ কবিতায় মানবমনের চিরন্তন অভিব্যক্তিটি ছুড়ে দিয়েছেন এভাবে : ‘আমার কাছে এখনো পড়ে আছে তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি, কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো?’
দরজা বা দরকারি কিছু আবদ্ধ করে রাখতে আমরা যে যন্ত্রটির আশ্রয় নিই, সেটির প্রচলিত নাম তালা।
শব্দটি সংস্কৃত ‘তলক’ থেকে এসেছে। তবে বহুতল বিল্ডিংয়ের প্রতিটি স্তরকেও আমরা ‘তালা’ বলি—যা আসলে ‘তলা’। ‘কানে তালা লাগা’ বললে আবার অন্য অর্থ বোঝায়। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর রচনায় পাই : ‘দারুণ প্রহার তার উদরের জ্বালা। ঘন শ্বাস বহে তার কানে লাগে তালা।’
‘প্রধান’ অর্থেও ‘চাবি’ শব্দটির ব্যবহার হতে পারে—চাবিকবিতা, চাবিধারণা, চাবিব্যক্তিত্ব, চাবিশব্দ। যাই হোক, কলের পুতুল চাবি দিলেই নড়ে এবং ঘোরে। আবার আগের দিনের ঘড়িতে সময় বেঁধে চাবি দেওয়া হতো।
বিষয়টি বাংলার লোককবি ও বাউলেরা তাঁদের গানে রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন : ‘একবার চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া, জনম ভইরা ঘুরতে আছে।’ আবার আমাদের সংসারজীবনে এক গোছা চাবির গুরুত্ব অনেক। চাবির গোছাটি যে নারীর আঁচলে বাঁধা থাকে তিনিই সংসারের কর্ত্রী বিবেচিত হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় রয়েছে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে?’ অথবা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় রয়েছে ‘তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি, মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তাঁদের কবিতায় তালার বদলে ‘চাবি’ ব্যবহার করেছেন! কেউ কেউ মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানে আমরা যাকে তালা বলি সেটা চাবি নামে পরিচিত। তাই লেখা হয়েছে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’।
আবার অনেকে মনে করেন, কবিতার ছন্দ রক্ষার স্বার্থে ‘চাবি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ কারণেই বলা হয়, বাংলা ভাষায় ‘তালা’ ও ‘চাবি’ মূলত একই জিনিস!
বাংলা, হিন্দি ও উর্দুতে প্রচলিত চাবি শব্দের মূল পর্তুগিজ ভাষার chave. পর্তুগিজ ভাষায় chave মানে চাবি। অর্থাৎ ‘চাবি’ শব্দটি আমরা পর্তুগিজদের কাছ থেকে পেয়েছি। তবে পর্তুগিজ ভাষায় চাবির উচ্চারণ ‘শাবি’। সাড়ে চার শ বছর আগে উত্তর ভারতে ‘চাবি’কে বলা হতো ‘কুঞ্জী’ আর বাংলায় বলা হতো ‘কাঠি’। তালাচাবিকে রাঢ়ে এখনো কেউ কেউ ‘কুলুপকাঠি’ বলেন। কেউ কেউ ‘চাবিকাঠি’ও বলেন। ‘কুঞ্জী’ শব্দটি এককালে উর্দু ভাষায় চালু ছিল। যেমন—‘কিতাবোঁ কী কুঞ্জী তেরে হাথোঁ মে হৈ, অগর ইয়াদ করলেঁ তো ক্যা বাত হৈ—বইয়ের চাবি তোমার হাতেই রয়েছে। যদি মুখস্থই করে নিলে তাতে ক্ষতিটা কী?
চাবির সমতুল শব্দ ব্রাজিলিয়ান ও ইউরোপিয়ান পর্তুগিজে chave (শাবি); চেকে klíč (ক্লিৎস); ডেনিশে nøgle (নইলে); ডাচে sleutel (স্লইটল্); ইংরেজিতে key; ইউরোপিয়ান ও লাতিন আমেরিকান স্প্যানিশে llave (জাবে); ফিনিশে avain (আভাইন্); ফ্রেঞ্চে clé (ক্লী); জার্মানে Schlüssel (স্লুসার); গ্রিকে ক্লীভি; ইতালিয়ানে chiave (চিয়াভে); রুশে ক্লুচ; তুর্কিতে anahtar.
বাংলা শব্দ নিয়ে বিখ্যাত ইংরেজি অভিধান হবসন-জবসনে চাবি (chabee) শব্দটি রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, Chave বন্দর থেকে chabee নামটি এসেছে। এতে আরো বলা হয়, এই chabee শব্দটির বাংলা রূপ sabi আর তামিলে savi। এই চাবির কারণে আমরা যে প্রাচীন শব্দটি হারিয়েছি, সেটি হচ্ছে কুঁজি (সম্পদের সীমা নাই বুড়া গরু পুঁজি। রসনা কেবল কথা সিন্দুকের কুঁজি—অন্নদামঙ্গল, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর)।
বিদ্যুতেও চাবি থাকে। তবে এখানে চাবির কেতাবি নাম ‘সুইচ’। অন্যভাবে বলা যায়, সুইচ হলো এমন একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যা কোনো বিদ্যুৎ বর্তনীতে লাগালে তা বর্তনীতে ইলেকট্রন তথা বিদ্যুত্প্রবাহ চালু বা বন্ধ করতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রতীক ও কোট অব আর্মসে প্রদর্শিত চাবির ছবি ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। হলি সী (রোমের সি, পেট্রিন সি বা অ্যাপোস্টলিক সিও) তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটি হলো ক্যাথলিক চার্চ ও ভ্যাটিকান সিটি স্টেটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদ। উপর থেকে দেখলে বোঝা যায়, হলি সী ভবনের নকশা দেখতে ঠিক চাবির মতো। বিশ্বে প্যালেস্টাইনিয়ান কী-ও বেশ আলোচিত। ১৯৪৮ সালে নাকবা থেকে বর্বর ইহুদিদের নির্যাতনে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের সম্মিলিত প্রতীকটিই প্যালেস্টাইনিয়ান কী হিসেবে পরিচিত। আর বিশ্বের সবচেয়ে ভারী চাবির রেকর্ড কাতারের। এটার ওজন ২.৭ টন। প্রস্থ তিন মিটার আর উচ্চতা ৭.৮ মিটার।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীনতম চাবির সন্ধান পাওয়া গেছে মিসরে। প্রায় চার হাজার বছর আগেকার সেই কাঠের তালাচাবির সিস্টেম ছিল ত্রুটিপূর্ণ। রোমানরা তাই ওয়ার্ডেড লক (খাঁজকাটা) উদ্ভাবন করে। সেই চাবিও তেমন সুবিধার ছিল না। অবশেষে, ১৮০০ শতকে আমেরিকান লিনাস ইয়েল এবং তাঁর ছেলে স্প্রিংচালিত পিন-টাম্বলার লক তৈরি করেন। ওটিই আমরা এখন ব্যবহার করছি। একটি ব্রিটিশ সংস্থা অনুমান করছে, একজন মানুষ সারা জীবনে গড়ে তিন হাজার ৬৮০ ঘণ্টা ব্যয় করে শুধু স্মার্টফোন বা চাবির মতো ছোটখাটো জিনিস খুঁজতে।