বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিজম থেকে টেলিকম খাতকে মুক্ত করতেই অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নীতিমালা করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব। তিনি বলেছেন, টেলিকম খাতকে করমুক্ত করার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের দাবি পূরণে নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে। দ্রুতই প্রস্তাবিত নীতিমালা উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপিত হবে। নীতিমালাকে সমৃদ্ধ করতে যৌক্তিক পরামর্শগুলো বিবেচনা করা হবে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং নীতি সংস্কার’বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দের সভাপতিত্বে বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ জুলফিকার। তিনি জানান, ডিজিটাল অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে টেলিকম অপারেটররা।
মোবাইল নেটওয়ার্কে সাড়ে ছয় কোটি সোশ্যাল মিডিয়ায় সংযুক্ত। তার পরও দেশের ৯ কোটির মতো মানুষ এখনো আমাদের নেটওয়ার্কে সংযুক্ত নয়। তারা ডিজিটাল সেবা পাচ্ছে না। বিদ্যমান নীতিমালায় স্থানীয় পর্যায়ে ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ ও লক্ষ্য পূরণে সময় বেঁধে দেওয়া রীতিমতো ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
প্রস্তাবিত নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়ে মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, নতুন লাইসেন্সিং কাঠামো প্রযুক্তি নিরপেক্ষ করার পাশাপাশি নীতিমালায় লাইসেন্স তিনটিতে নামিয়ে আনা হচ্ছে। একই লাইসেন্সের আওতায় একাধিক ধরনের সেবা দিতে পারবেন অপারেটররা। ভয়েস, ডেটা (ইন্টারনেট), ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (ভ্যাস) ও ওভার-দ্য-টপ (ওটিটি) সার্ভিস দেওয়ার সুযোগ থাকছে নতুন লাইসেন্স নীতিমালায়। এটি এই খাতের বিকাশে সহায়তা করবে। তবে শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ না রাখায় উন্নয়নের গতি স্লথ হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব বলেন, ‘প্রজন্মের দাবি পূরণে কানেক্টিভিটি থেকে জেনারেশন সার্ভিস ট্রান্সফরমেশনের জন্য নতুন নীতিমালা হচ্ছে। অনেক বেশি জঞ্জালের ওপর থেকে এই নীতিমালা করতে যাওয়ায় এটিকে অনেকটা বিবরণমূলক করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেশের কল্যাণে কারো কারো স্বার্থে আঘাত আসতে পারে। কেননা আমরা নেটওয়ার্কের জঞ্জাল ছেঁটে ফেলব। নীতিমালাকে সমৃদ্ধ করতে যৌক্তিক পরামর্শগুলো বিবেচনা করা হবে। একই সঙ্গে সরকারের ভালো উদ্যোগকেও সবার স্বাগত জানানো উচিত।’
বিশেষ সহকারী আরো বলেন, ‘নীতিমালায় লাইসেন্সের সংখ্যা কতগুলো হবে তা নির্ভর করবে লাইসেন্স অবলিগেশন অ্যান্ড কেপিআই পারফরম্যান্সের ওপর। তবে বিটিআরসি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার মাধ্যমে জানতে পারে কী পরিমাণ লাইসেন্স লাগবে বা কী পরিমাণ লাইসেন্স থাকলে অপটিমাল হয়। তবে এই লাইসেন্স সংখ্যার নাম করে নতুন বিনিয়োগকারীদের বাধা দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া টোল কালেক্টর হিসেবে যে লাইসেন্সগুলো বিগত সরকারের সময় দেওয়া হয়েছিল সেগুলো কন্টিনিউ করা হবে না।’ বিদেশি কম্পানির দেশীয় প্রতিনিধিদের দেশের বৃহত্তম স্বার্থ রক্ষায় কাজ করার আহবান জানান তিনি।
নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে তা অন্তত ১৫ বছরের জন্য টেলিযোগাযোগ খাতকে সুরক্ষা দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো. জহুরুল ইসলাম।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী বলেন, ‘বিগত সময়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা পেশিশক্তি খাটিয়েছেন। এখনো ৯ কোটি মানুষ ও আড়াই কোটির মতো হাউসহোল্ড আনকানেক্টেড। এই অবস্থার উত্তরণ করতে, সেবার ব্যবহার সুফল বাড়াতে গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। সে কারণে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে পলিসিটা ধীরে ধীরে করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘টেলিকম পলিসি সরকারের এখতিয়ার। অরাজক পরিস্থিতির উত্তরণ থেকে সরকার এই পরিবর্তন আনছে। তাই অংশীজনদের নিয়েই এরপর গাইডলাইন করবে। লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কাউকে নতুন নীতিমালায় বঞ্চিত করা হবে না।
বিশ্বব্যাংক পরামর্শক মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের বর্তমান লিডারশিপ গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য। তারা একটি যুগোপযোগী পলিসি উপহার দেবেন বলে সবার প্রত্যাশা।’
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির বলেন, ‘আমি মনে করি, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কনসিস্টিন্সি, ক্যাপাসিটি, কোলাবরেশন ও কো-অর্ডিনেশন দরকার। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ থাকা দরকার। প্রতিবছর মোবাইল অপারেটররা নেটওয়ার্ক চালু রাখতে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। সে কারণে দেশে টেলিকম রোডম্যাপ দরকার।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, ‘দেশের মানুষের মোট চাহিদা ৭.৫ টেরাবাইট। এর ৬৫-৭০ শতাংশ প্রয়োজন মেটায় আইএসপিরা। এ জন্য ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের ৩৫ শতাংশ বাজার শেয়ার থাকলেও তাদের কর দিতে হচ্ছে না। এই বৈষম্য দূর করা দরকার। পলিসির মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যে নীতিমালা করা হচ্ছে, তা রাজনৈতিক সরকারের সময় টিকবে কি না—তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’
ফাইবার অ্যাট হোম সিআইও সুমন আহমেদ সাবির বলেন, গত সাত বছরে এই খাতে কত টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তা হিসাব করা দরকার। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ খরচ সাশ্রয়ী পথ বেছে নিতে হবে।
বৈঠকে আরো বক্তৃতা করেন গ্রামীণফোন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান, রবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) (ভারপ্রাপ্ত) রিয়াজ রশীদ, বাংলালিংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইওহান বুসে, টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল মাবুদ প্রমুখ।