ছোটবেলা থেকেই কৃষিতে আগ্রহ ছিল সোহেল রানার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কিছুদিন সাংবাদিকতা করার পর মাটির টানে ফিরে যান গ্রামে। অনেকের বাধা উপেক্ষা করে শুরু করেন কৃষিকাজ। আজ তিনি এক সফল উদ্যোক্তা
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় আমের বিদেশযাত্রা নিয়ে একটি কনটেন্ট খুব দেখা যাচ্ছে।
সোহেল রানা নামের তরুণ উদ্যোক্তার আম যাচ্ছে বিদেশে। কৃষিতে সাফল্যের এক নায়ক সোহেল রানার গল্প উঠে এসেছে ভিডিও চিত্রটিতে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিষয়ে মাস্টার্স পড়েছেন সোহেল রানা। পড়াশোনা শেষে ঢাকায় এসে দৈনিক ইত্তেফাকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন।
সেই পত্রিকায় আমি তখন কৃষি নিয়ে একটি পাতা সম্পাদনা করতাম। কৃষিতে আশৈশব আগ্রহী ছিলেন সোহেল। ইত্তেফাকের ওই পাতায় প্রকাশিত কৃষি বিষয়ে সাফল্যের খবর এবং ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান কৃষি নিয়ে কিছু করতে সোহেলকে প্রত্যয়ী করে তোলে।
সোহেল রানা ২০১৫ সালে গ্রামে ফিরে গিয়ে ছোট ভাই আব্দুল বারীকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের পাঁচ বিঘা জমিতে শুরু করেন সমন্বিত কৃষি খামার।
শুরুতে আত্মীয়-স্বজনের অনেকে ও এলাকাবাসী তাঁদের নিরুৎসাহ করে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে গিয়ে খামার গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে যান সোহেল। এরপর ধীরে ধীরে সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন তিনি। এখন প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে বিস্তৃত তাঁর কৃষি খামার।
গত বছর নওগাঁর সাপাহারে প্রতিবেদন ধারণ করতে গিয়ে আবার দেখা পাই সোহেল রানার।
তাঁর বছর চারেক আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘কৃষি দিবানিশি’ অনুষ্ঠানে তাঁর কৃষি সাফল্যের গল্প তুলে ধরেছিলাম।
সোহেল রানার কৃষি কার্যক্রম দেখে মুগ্ধ হয়েছি। নগরের আধুনিক জীবনের আহ্বান উপেক্ষা করে মাটির টানে গ্রামে ফিরে গিয়ে তিনি যে ভুল করেননি তা স্পষ্ট। আজ তিনি এক সফল উদ্যোক্তা। আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিতে পাল্টে দিয়েছেন ফসল উৎপাদনের প্রথাগত হিসাব-নিকাশ। এটিই তাঁর সফলতা তথা স্বাবলম্বী হওয়ার মূল সূত্র।
সোহেলের সমন্বিত কৃষি খামারটিতে বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে আম, লিচু, লেবু আর মাল্টার বাগান। আছে ড্রাগন আর বারোমাসি আমও। বারি ১ জাতের মাল্টা এ বাগানে বেশ ভালো ফলেছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, দেশে মাল্টা চাষের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত এ জাতটি দিয়ে।
সোহেলের কৃষি খামারে বড় একটি অংশজুড়ে আছে ড্রাগন ফলের চাষ। সারা দেশে তরুণদের হাতে দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে ড্রাগনের চাষ। দারুণ পুষ্টিকর ও সুস্বাদু এই ফলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বাড়ছে উৎপাদন।
উদ্যোক্তা সোহেল রানা অনুশীলন করছেন টার্কি, দেশি মুরগি, ছাগল, কবুতর ও লাভ বার্ড লালন-পালনের। আগামী দিনে এসব প্রাণী ও পাখির বড় খামার গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। পুকুরে মাছের চাষও হচ্ছে সোহেলের খামারে। নতুন কোনো ফল-ফসলের কথা জানলে খোঁজখবর নিয়ে শুরু করেন তার চাষাবাদ।
পাঁচ বিঘা আয়তনের পেয়ারাবাগান দিয়ে শুরু হয়েছিল উদ্যোক্তা সোহেল রানার কৃষির হাতেখড়ি। সোহেলের দাবি, তাঁর পেয়ারার বাগানই পত্নীতলা ও সাপাহার এলাকার প্রথম বাণিজ্যিক বাগান। আজ তাঁর অনুগামী অনেক। অঞ্চলটিতে বাড়ছে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের আবাদ।
ফল-ফসল আবাদেই নিজের স্বপ্নকে আটকে রাখেননি সোহেল রানা। ২০১৮ সালে সাপাহারে ৭০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে শুরু করেন বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্ক নামের আধুনিক সমন্বিত কৃষি খামার ও অ্যাগ্রো ট্যুরিজম সেন্টার। নানা রকম গাছের সংগ্রহ নিয়ে নিজস্ব ‘জার্মপ্লাজম সেন্টার’ গড়েছেন সোহেল। সেখানে আছে নানা রকম ঔষধি গাছসহ প্রায় ৩০০ প্রজাতির গাছ। রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন দেশি গাছ।
নিজেকে সমৃদ্ধ করতে সোহেল নানা রকম প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, চর্চা করছেন আধুনিক কৃষি-প্রযুক্তির। তরুণদের কৃষিতে উদ্বুদ্ধ করতে তাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করছেন। ‘গ্লোবাল গ্যাপ’ অনুসরণ করে উৎপাদিত আম্রপালি আম যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করেছেন গত জুন মাসে।
কঠিন পরিশ্রম আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার বদৌলতে সোহেল রানা আজ একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। বহু প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে তিনি শুধু নিজেকেই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেননি, বরং এলাকার অন্য তরুণদের মধ্যেও সাড়া ফেলেছেন। সোহেলের বিশ্বাস, নতুন নতুন প্রযুক্তি আর শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে শিগগিরই দেশের কৃষির চিত্র পাল্টে যাবে।