হাঁপানি বা অ্যাজমা শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগগুলোর একটি। এক যুগের কিছুটা বেশি সময় ধরে জাতীয় পর্যায়ে এ নিয়ে কোনো ধরনের জরিপ না হওয়ায় বাংলাদেশে প্রতিবছর ঠিক কতসংখ্যক মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত হচ্ছে কিংবা মারা যাচ্ছে তার সঠিক তথ্য নেই।
‘ন্যাশনাল অ্যাজমা প্রিভিলেন্স সার্ভে’র ১৯৯৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় দেশে অ্যাজমা রোগী ছিল ৭০ লাখ। আর সর্বশেষ ২০১০ সালের জরিপে অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ লাখে।
এরপর গত ১৩ বছরের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, অ্যাজমায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
শ্বাসতন্ত্রের চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের তথ্যের সঙ্গে এসব তথ্যের কিছু মিল রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত চার বছরে ধারাবাহিকভাবে শ্বাসনালির সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রোগী বেড়েছে ৩৭.৭৭ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে ১৬.১৬ শতাংশ।
চিকিৎসা নিতে আসা ২৫ শতাংশের বয়স ছিল ২৪ বছরের নিচে। পঞ্চাশোর্ধ্ব রোগী ৪৫ শতাংশ এবং এই বয়সীদের মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্বাসনালির সমস্যায় ভোগা রোগীদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের অ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা। এটি বংশগত কিংবা পরিবেশগত কারণেও হতে পারে।
তাঁরা বলছেন, বায়ুদূষণ, অ্যালার্জেন, ঋতু, আবহাওয়া, তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে এই রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এ রোগের প্রকোপ বেশি।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব অ্যাজমা দিবস’। প্রতিবছর ৭ মে সচেতনতার লক্ষ্যে দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপ্রাদ্য ‘অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা আবশ্যক সর্বজনে’।
বিশ্বে ২৬ কোটির বেশি মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত। প্রতিবছর এই রোগে মারা যায় সাড়ে চার লাখ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ অ্যাজমা রোগে ভুগছে। সেই হিসাবে এই রোগে আক্রান্ত এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ।
মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জরুরি ও বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ১৭ হাজার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিয়েছে ৫৫ হাজার ৭৯৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৪৬০ জন। গত বছর সর্বোচ্চ এক লাখ ৫৯ হাজার ৬৬ জন রোগী চিকিৎসা নেয়। ওই সময় মারা গেছে এক হাজার ৪৬ জন। ২০২২ সালে রোগী ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৮৯১ জন, মারা গেছে ৯৪৭ জন। ২০২১ সালে রোগী ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৫১৭ জন, মারা গেছে এক হাজার ২২ জন। ২০২০ সালে রোগী ছিল ৯৮ হাজার ৯৯১ জন, মারা গেছে ৮৭৭ জন। গত চার বছরে রোগী বেড়েছে ৩৭.৭৭ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ১৬.১৬ শতাংশ।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সেরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু অ্যাজমা নয়, শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য রোগও বাড়ছে। আগে আমাদের বহির্বিভাগে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে আসত প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ রোগী, বর্তমানে তা ৮০০ থেকে ১০০০-এ দাঁড়িয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে রোগী অনেক বেড়েছে। সব বয়সী রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তবে বয়স্ক ও শিশুদের জটিলতা বেশি।’
তিনি বলেন, ‘শহরগুলো বেশি দূষণের শিকার হলেও এখন গ্রামের রোগীও বেশ বেড়েছে। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায় এবং রোগীর চাপও বাড়তে থাকে।’
অ্যাজমা বা হাঁপানির লক্ষণ
ডা. মো. সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আক্রান্ত রোগীর মাঝে মাঝে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নিঃশ্বাসের সঙ্গে সাঁ সাঁ শব্দ হয়। সেই সঙ্গে শুকনো কাশি, প্রায়ই এই কাশি একটানা অনেকক্ষণ ধরে চলে, বুকে চাপ অনুভব করা এবং খুব অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া—এই লক্ষণগুলো যদি থাকে তাহলে আপনি সম্ভবত হাঁপানিতে আক্রান্ত।’ এসব সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ শাহেদুর রহমান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, রোগী বাড়ার অন্যতম কারণ পরিবেশ ও বায়ুদূষণ। এ ছাড়া রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাদ্যে ভেজাল, আবহাওয়া, তাপমাত্রা পরিবর্তন প্রধান কারণ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবেশদূষণ কমানো খুব জরুরি। এর সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করতে হবে। মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তাহলে অ্যাজমা কমিয়ে আনা সম্ভব।’