একনেক সভায় বা তার আগে পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এই বিপুল ব্যয় নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। সরকারের শেষ সময়ে প্রকল্পটি তাড়াহুড়া করেই দেওয়া হয়েছে অনুমোদন। পিইসি সভার পর নতুন করে প্রকল্পটিতে বড় একটি কেনাকাটা যুক্ত হলেও পরে আর কোনো সভা হয়নি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি প্রকল্প পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নতুন প্রকল্পটিতে রেলের পাত, লোকোমোটিভ, স্লিপার, পাথরসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম ধরা হয়েছে অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে বেশি।
ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে ২৫ শতাংশের বেশি অবনমন হয়েছে। এ কারণে নতুন প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা সলিমুল্লাহ বাহার। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ডলারের দাম ৮৫ টাকা ধরে আগের প্রকল্পগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে। আর নতুন প্রকল্পে প্রতি ডলারের দাম ধরা আছে ১০৯ টাকা। প্রতিটি ডলারের দাম ২৪ টাকা বেড়ে যাওয়ায় আমদানিনির্ভর প্রতিটি উপকরণের দাম বাড়ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
লোকোমোটিভের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় বিদেশি মুদ্রায় প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পে এর অতিরিক্ত যতটুকু দাম বেড়েছে, তার মূল কারণ মুদ্রার বিনিময় হারে অবনমন। রেলপথ তৈরির মূল উপকরণ রেলপাত, স্লিপার, পাথরসহ বেশির ভাগ উপকরণই আমদানি করতে হবে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করেই অনুমোদন দিয়েছি। যে ব্যয় ধরা হয়েছে, সেটা আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। আর এটা তো ওপেন টেন্ডার হবে। যে সর্বনিম্ন ব্যয় প্রস্তাব করবে, তারাই কাজ পাবে।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই বিভাগের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রশ্ন তুললেও বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বলে এই ব্যয় লাগবে। আমরা তো ইঞ্জিনিয়ার না। আর কমিশনে প্রকল্পের যে চাপ, এতে এত ভেতরে ঢুকে দেখাও সম্ভব হয় না।’
তিনি জানান, প্রাথমিক প্রস্তাবে লোকোমোটিভ কেনার সুযোগ না থাকলেও এডিবি বাড়তি সহায়তার প্রস্তাব দেওয়ায় ৩০টি রেল ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। তবে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করা হয়নি বলেও তিনি জানান।
এ বিষয়ে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের কাছে তো আগের ডাটা থাকা দরকার। কোন প্রকল্পে কোন খাতে কত খরচ হচ্ছে, সেটা দেখলে তো আর এত ব্যয় অনুমোদন নিতে পারত না। পরিকল্পনা কমিশনের এ ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হওয়া দরকার।
আড়াই থেকে ৪ গুণ বেশি ব্যয়
ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ এবং টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত দ্বিতীয় ডুয়াল গেজ রেললাইন নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি যে ব্যয় ধরা হয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত একই ধরনের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে তার চার গুণ। ঢাকা-টঙ্গী -জয়দেবপুর প্রকল্পে মেইন লাইন লুপলাইনসহ মোট ১৩৭.৯৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা আছে দুই হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। আর লুপলাইনসহ নতুন প্রকল্পটিতে ৬২.৮৮ কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। ঢাকা-টঙ্গী লাইনে কিলোমিটারে ১৯ কোটি টাকা ব্যয় হলেও নতুন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৭৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা করে।
পাথর কেনা হচ্ছে ৪০-৬৭% বেশি দামে
অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেল প্রকল্পে পাথর কেনা হচ্ছে ৪০ থেকে ৬৭ শতাংশ বেশি দামে। ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর লাইনে প্রতি ঘনমিটার পাথরের দাম ছয় হাজার টাকা ধরা হলেও নতুন প্রকল্পটিতে একই পাথর কেনা হচ্ছে ১০ হাজার টাকায়। এই হিসাবে নতুন প্রকল্পে প্রতি ঘনমিটার পাথরে বাড়তি ব্যয় হবে ৬৬.৬৭ শতাংশ। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের তুলনায় ৪৪ শতাংশ, পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের তুলনায় ৪০ শতাংশ ও আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেশি দামে পাথর কেনা হচ্ছে নতুন প্রকল্পে।
লোকোমোটিভ কেনা হচ্ছে ৩৬-৪২% বেশি দামে
নতুন প্রকল্পটির আওতায় ৩০টি লোকোমোটিভ কেনা, কমিশনিং, স্পেয়ার পার্টস এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ বাবদ দুই হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ হিসাবে প্রতিটি লোকোমোটিভ কেনায় ব্যয় হচ্ছে ৭৮ কোটি ৮১ কোটি টাকা, যা অন্য যেকোনো প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি।
এ ছাড়া প্রকল্পটির ব্যয় বিভাজনে দেখা গেছে, নতুন প্রকল্পে প্রতিটি লোকোমোটিভ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আনুষঙ্গিক অন্যান্য খাতে প্রতিটি লোকোমোটিভে ব্যয় করা হচ্ছে ৩০ কোটি ৫২ লাখ টাকা।