সম্প্রতি আলোচিত টাঙ্গাইল শাড়িসহ ঐতিহ্যবাহী সাতটি পণ্যকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্যাটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) এরই মধ্যে এ পণ্যগুলোর জার্নাল প্রকাশ করেছে।
যেসব পণ্য জিআই স্বীকৃতি পাবে সেগুলো হলো টাঙ্গাইল শাড়ি, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, মুক্তাগাছার মণ্ডা, রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম, মৌলভীবাজারের আগর ও মৌলভীবাজারের আগর আতর। এসব পণ্যের জিআই স্বীকৃতির আবেদন পর্যালোচনা করে জার্নাল প্রকাশের জন্য অনুমোদন দেয় ডিপিডিটি।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এসব পণ্যের জার্নালের কপি হস্তান্তর করেছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে একটি টাঙ্গাইল শাড়ি তুলে দেন মন্ত্রী।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডাব্লিউআইপিও) নিয়ম অনুসরণ করে বাংলাদেশের জিআই পণ্যের স্বীকৃতি বা জিআই সনদ দেয় ডিপিডিটি। নিয়ম অনুযায়ী, আবেদনের পর যাচাই-বাছাই করে ডিপিডিটি সেই আবেদনের জিআই জার্নাল প্রকাশ করে।
এরপর দুই মাসের মধ্যে প্রকাশিত জার্নালের বিষয়ে অভিযোগ বা আপত্তি না থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যটি জিআই স্বীকৃতি পায়। অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ভারতের শিল্প মন্ত্রণালয় ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল’কে তাদের নিজস্ব জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। পরে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ডিপিডিটিতে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন।
এটিসহ আগে করা আরো ছয়টি আবেদন পর্যালোচনা শেষে গত বৃহস্পতিবার জার্নাল প্রকাশ করেছে ডিপিডিটি।
জার্নালে বলা হয়, মোগল আমলে যখন বিশ্বজুড়ে মসলিনের জয়জয়কার তখন টাঙ্গাইলের বসাক তাঁতিদের মাধ্যমে এই শাড়ির বিকাশ ঘটেছে। যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পার্শ্ববর্তী হওয়ায় এখানকার জলবায়ু এই শাড়ি বোনার উপযোগী। টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস শত শত বছরের পুরনো। এর উত্পাদনের ভৌগোলিক এলাকা ও মানচিত্র, উৎসর প্রমাণ, উত্পাদনের পদ্ধতি, শাড়িতে ব্যবহূত সুতার কাউন্টসহ ঐতিহাসিক দলিলাদির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
জার্নালে বলা হয়েছে, নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা স্থানীয় একটি জাত। মাঝারি আকারের ও হলুদ রঙের এই কলার স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। এই কলা দেশে ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে রপ্তানি হয়। দেশি জাতের অন্যতম সুস্বাদু ফল রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম। স্থানীয় মাটির গুণের কারণে ফলটির স্বাদ আলাদা। ৭০-৭৫ বছর ধরে আমটি চাষ হচ্ছে। ৩১ বছর ধরে চলছে বাণিজ্যিক চাষ।
আলাদা জার্নালে বলা হয়, মুক্তাগাছার মণ্ডা আর গোপালগঞ্জের রসগোল্লার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। পণ্য দুটি দেশীয় গাভির দুধের খাঁটি ছানা থেকে তৈরি হয়। স্থানীয় গুণের কারণে পণ্য দুটির অন্য সব এলাকা থেকে আলাদা সুনাম রয়েছে। মুক্তাগাছার মণ্ডার ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রণালিতে লুকিয়ে আছে স্বাদের বিশেষত্ব।
মৌলভীবাজারের আগর ও আগর আতর নিয়ে প্রকাশিত পৃথক জার্নালে বলা হয়, পাহাড়ি এই গাছের নাম আগর। গাছটি থেকে পাওয়া যায় আতর। গাছের কালো অংশ থেকে আগর সংগ্রহ করা হয়। পণ্য দুটি রপ্তানিমুখী। আন্তর্জাতিকভাবে পণ্যটির ব্যাপক সুনাম। ওষুধ, পারফিউম, সাবান, শ্যাম্পুসহ নানা কাজে আগরের তেল বা আতর ব্যবহার করা হয়।
ডিপিডিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জিআই জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে এই সাতটি পণ্যের জিআই স্বীকৃতির পথ সুগম হয়েছে। সনদ পেলে পণ্যের ওপর বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্বীকৃতি ও অধিকার নিশ্চিত হবে। আশা করা যায়, আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধেই পণ্যগুলোর জিআই সনদ পাবে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৌলিক পণ্যগুলোর জিআই স্বত্ব নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি। পরে ২০১৫ সালেই প্রথম জামদানি শাড়ির জিআই স্বত্বের আবেদন জানায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন। ব্যক্তি পর্যায়েও দুটি আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদনের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে দেশের প্রথম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি।
এরপর তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, বিজয়পুরের সাদামাটি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, বাংলাদেশের কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহীর সিল্ক, ঢাকার মসলিন, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের শীতলপাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসীমালা চাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম, কুমিল্লার রসমালাই ও কুষ্টিয়ার তিলের খাজা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া পণ্য ২২টিতে পৌঁছে। যদিও ২০২২ সাল পর্যন্ত জিআই পণ্য ছিল ১১টি। এ ছাড়া জিআই সনদের জন্য ডিপিডিটিতে ১৪টি আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে এখন সাতটির জার্নাল প্রকাশ হয়েছে।
আরো আবেদন আছে—যশোরের খেজুর গুড়, নরসিংদীর লটকন, জামালপুরের নকশিকাঁথা, মধুপুরের আনারস, সুন্দরবনের মধু, রাজশাহীর মিষ্টিপান, শেরপুরের ছানার পায়েশ, ভোলার মহিষের কাঁচা দুধ, দিনাজপুরের লিচু ও নওগাঁর নাগ ফজলি আম। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষে জার্নাল প্রকাশ করবে ডিপিডিটি।
প্রসংগত, একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উত্পাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে দেশটির জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী, কৃষিপণ্য, প্রকৃতি থেকে আহরিত সম্পদ ও কুটির শিল্পকে এই সনদ দেওয়া হয়। যেসব পণ্য এই স্বীকৃতি পায়, সেগুলোর মাঝে ভৌগোলিক গুণ, মান ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে।