অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ অর্থনীতিবিদ। উন্নয়ন অর্থনীতিতে তাঁর গবেষণা আছে। উন্নয়ন অর্থনীতিতে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি আরো বলেন, শুধু অর্থনীতিতে নয়, এর পাশাপাশি আর্টিফিকেশনের ওপর নুরুল ইসলামের ধারণা অনেক ওপরের দিকে।
বাস্তব অর্থনীতির সঙ্গে যেটার কোনো মিল ছিল না, সেটা নিয়েও তিনি ভাবতেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দেশের জন্য নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন, যার সুফল পরবর্তী সময়ে স্বাধীন দেশের মানুষ পেয়েছে।
গতকাল রবিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম : নানা প্রজন্মের দৃষ্টিতে দেখা’ শিরোনামের এই সভায় ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এসব কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানসহ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সহকর্মী, ছাত্র, অর্থনীতিবিদ, বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালকসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে গত ৮ মে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, অর্থনীতিতে অমর্ত্য সেন অনেক কাজ করলেও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিংয়ে তাঁর কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু নুরুল ইসলাম তা নিয়েও কাজ করেছেন। নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন সর্বাঙ্গীণ পূর্ণাঙ্গ অর্থনীতিবিদ।
যেটা অন্য কারো মধ্যে দেখা যায়নি।
সংবিধানের প্রবক্তা কামাল হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমিই অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁদের মধ্যে আরো সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে তুলি। তাঁর (নুরুল ইসলাম) সঙ্গে আমার একাধিক কাজ করা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ১৯৬৯ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করা। দেশের অর্থনীতির পেছনে নুরুল ইসলামের অবদান ছিল অসামান্য।
’
নুরুলকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেওয়া অনুদারতা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরি এবং বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের রূপরেখা তৈরি ও নীতি প্রণয়নে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেওয়া অনুদারতার পরিচায়ক বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেককে মৃত্যুর পর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হলে মন্দ হয় না।’
একুশে পদক না পাওয়া নিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বিনায়ক সেন বলেন, তিনি (নুরুল ইসলাম) উত্তরে বলেছিলেন, একুশে কেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অনেক কিছু করেছেন। সেই স্বীকৃতিও তো পাননি।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, একজন মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই মাপকাঠি হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। স্বীকৃতি না পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। সেটি হলো, দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকা এবং প্রাসঙ্গিকতা না থাকা।
নুরুল ইসলামের সরাসরি ছাত্র মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘নুরুল ইসলাম ছিলেন কল্যাণ অর্থনীতিবিদ। তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মিল ছিল। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আপনি করে বলতেন। অনেক খাতির করতেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘নুরুল ইসলাম দেশে এলে খুব ভালো থাকতেন। তবে নিজের চিকিৎসা ও পরিবারের দেখাশোনার জন্য তিনি মনে করতেন তাঁর ফিরে যাওয়া উচিত। নুরুল ইসলামকে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকের মতো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দিলে ভালো হতো। আমরা তাঁকে সম্মানের বেদিতে বসাই। এটাই তাঁর বড় পুরস্কার।’
তাঁর ছাত্র রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘রাজনীতি করার কারণে প্রায়ই জেলে যেতে হতো। একবার জেল থেকে বের হওয়ার পর অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আমাকে বলেন, তুমি পরীক্ষা দেবে। যা পারো লিখবে। খাতা আমরা দেখব।’
সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনে যেসব বাধা নুরুল ইসলামকে ব্যথিত করেছিল, তা এখনো আছে। স্বীকার করতেই হবে, পরিকল্পনা কমিশন সেই মর্যাদায় নেই। নুরুল ইসলামের প্রতি আমার শ্রদ্ধা।’