<p>আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল প্রায় পুরোটাই তালেবানের দখলে। পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরও এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারেও একই অবস্থা। সর্বশেষ দক্ষিণাঞ্চলীয় লোগার প্রদেশের রাজধানী ফুল ই আলম দখল করার মধ্য দিয়ে রাজধানী কাবুলের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে তালেবান।</p> <p>এ অবস্থায় তালেবানকে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দিয়েছে সরকার—শীর্ষ পর্যায়ের এক আফগান কর্মকর্তার বরাত দিয়ে গত বৃহস্পতিবার আলজাজিরা এ তথ্য জানায়।</p> <p>এদিকে আফগানিস্তান থেকে নিজেদের বেসামরিক নাগরিকদের দ্রুত সরিয়ে নিতে দেশটিতে সেনা মোতায়েন করছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তালেবানের অগ্রযাত্রার  মুখে ঘরবাড়ি ছেড়ে হাজারো মানুষের পলায়ন ও অনাহারি মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ‘মানবিক বিপর্যয়’ ঘনিয়ে আসার সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসংঘ সংস্থাগুলো।</p> <p>গতকাল শুক্রবার ফুল ই আলম দখল করে নেয় তালেবান। স্থানীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য সাঈদ কারিবুল্লাহ সাদাত এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘ফুল ই আলম এখন শতভাগ তালেবানের দখলে। এখন আর কোনো লড়াই হচ্ছে না। বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা পালিয়ে কাবুলে চলে গেছেন।’</p> <p>একই দিন দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশের রাজধানী লস্কর গাহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তালেবান। ঊর্ধ্বতন এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা এ খবর স্বীকার করেন। ওই শহর থেকে সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।</p> <p>এর আগে তালেবানের দখলে যায় কান্দাহার। তালেবানের এক মুখপাত্র টুইট করে বলেন, কান্দাহার সম্পূর্ণভাবে জয় করা হয়েছে। তালেবান যোদ্ধারা শহরের শহীদ চত্বরে পৌঁছে গেছে। একসময় কান্দাহার তালেবানের শক্ত ঘাঁটি ছিল। কৌশলগতভাবে শহরটির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। তাই শহরটির দখল তালেবানের জন্য একটা বড় জয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। লস্কর গাহও গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত।</p> <p>গত বৃহস্পতিবার এক দিনে গজনি, হেরাত ও কালা-ই-নাউ শহরের দখল নেয় তালেবান। এর আগে ফাইজাবাদ, ফারাহ, পুল-ই-খুমরি, জারাঞ্জ, কুন্দুজ, তাকহার, সার-ই-পল, তালুকান ও সেবারঘান শহর তালেবানের দখলে যায়। সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে কমপক্ষে ১৪টির রাজধানী দখল করে নিয়েছে বলে তালেবানের দাবি।</p> <p>সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (ন্যাটো) সেনারা। এই লড়াইয়ের ইতি টানতে গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি দোহায় তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন। চুক্তি অনুসারে এ বছর ১ মে থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এই মাসের মধ্যেই এ প্রক্রিয়া শেষ করার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।</p> <p>এদিকে আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই বেড়ে যায় তালেবানের দৌরাত্ম্য। গ্রামীণ এলাকা আর গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত পথগুলো একে একে দখল করতে থাকে তারা। এরপর তারা নজর দেয় প্রাদেশিক রাজধানীগুলোর দিকে। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন প্রাদেশিক রাজধানীকে ঘিরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই চালাচ্ছে তালেবান। সর্বশেষ ফুল ই আলম দখলের মধ্য দিয়ে অন্তত ১৪টি প্রাদেশিক রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে তালেবানের দাবি। স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারাও সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন।</p> <p>এ অবস্থায় আফগান সরকার তালেবানের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দিয়েছে। দেশটির শীর্ষ পর্যায়ের এক সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আলজাজিরা গতকাল বৃহস্পতিবার জানায়, কাতারের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তালেবানকে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়। কাতারে তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয় রয়েছে এবং কাতারের রাজধানী দোহাতেই চলছে আফগান শান্তি আলোচনা।</p> <p>আফগানিস্তানের হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ দোহায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও আফগানিস্তানের আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।</p> <p>গত বৃহস্পতিবার আবদুল্লাহ জানান, আফগানিস্তানের শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে কাতার সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে তালেবানকে কোনো ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।</p> <p>গত বছর ফেব্রুয়ারিতে হওয়া যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তিতে বলা হয়েছিল, আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের সমঝোতা এবং দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যায়ক্রমে সেখান থেকে বিদেশি সেনা তুলে নেওয়া হবে। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। চুক্তি অনুসারে আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের শান্তি আলোচনা শুরু হলেও এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। অথচ দোহা চুক্তি অনুসারে আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া সময় মতোই শুরু করা হয়। এই প্রক্রিয়া ৯০ শতাংশের বেশি এগিয়ে যাওয়ার পর আফগানিস্তানজুড়ে যখন ত্রাস নিশ্চিত করেছে তালেবান, তখন এই গোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার প্রস্তাব দিল সরকার।</p> <p>বেসামরিক নাগরিকদের সরাতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের সেনা প্রেরণ : আফগানিস্তান থেকে নিজেদের বেসামরিক নাগরিকদের দ্রুত সরিয়ে নিতে দেশটিতে বাড়তি সেনা প্রেরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। পরিকল্পনা করা হয়েছিল আগেই, গতকাল শুক্রবার এসংক্রান্ত আদেশ জারি করে দুই দেশের সরকার। পরিকল্পনা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি তিন হাজার ও যুক্তরাজ্য ৬০০ সেনা মোতায়েন করছে আফগানিস্তানে। এ সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গতকাল ন্যাটের বৈঠকে বসার কথা।</p> <p>ঝুঁকিপূর্ণ আফগানদের সরিয়ে নিতে তৎপর অস্ট্রেলিয়া : গত দুই দশকের লড়াইয়ের সময় যেসব আফগান অস্ট্রেলিয়ার সেনা সদস্য ও কূটনীতিকদের সঙ্গে কাজ করেছে, তাদের দ্রুত সরিয়ে নিতে কাজ করছে ক্যানবেরা সরকার। গতকাল শুক্রবার এ কথা জানান অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন।</p> <p>ন্যাটো জোটের সেনাদের জন্য দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন অথবা জোটের সদস্য দেশগুলোর কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, এমন আফগানদের হত্যার হুমকি দিয়ে চলেছে তালেবান। প্রাণনাশের হুমকিতে থাকা এই আফগানদের সরিয়ে নিতে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো জোটের বিভিন্ন সদস্য দেশ। অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগ তারই অংশ।</p> <p>অস্ট্রেলিয়ার সরকারপ্রধান মরিসন জানান, তালেবানের হত্যার হুমকিতে থাকা ৪০০ আফগানকে সপরিবারে এরই মধ্যে পুনর্বাসিত করেছে তাঁর সরকার। গত এপ্রিল থেকে ওই সব পরিবারকে পুনর্বাসন করা শুরু হয়। তবে সামনের দিনগুলোয় আর কত পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে জানাননি মরিসন।</p> <p>ভুল করেছে যুক্তরাষ্ট্র : আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন যুক্তরাজ্য বলছে, সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ভুল।</p> <p>যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস দোহা চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে গত বৃহস্পতিবার স্কাই নিউজ টেলিভিশনকে বলেন, ‘আমি মনে করি, যেভাবে কাজটা করা হয়েছে, সেটা ভুল হয়েছে। পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের এর মূল্য চোকাতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আফগানিস্তানে বিরাট সমস্যা তৈরি করেছে, এগিয়ে দিয়েছে তালেবানকে। তাঁর ধারণা, আল-কায়েদা লাভবান হবে, তালেবানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আবার তারা শাখা-প্রশাখা মেলবে।</p> <p>২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে এই আল-কায়েদার সিরিজ হামলার পরপরই সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে আফগানিস্তানে সেনা অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সূত্র : এএফপি, টাইমস অব ইন্ডিয়া।</p> <p> </p> <p> </p>