<p>ভৌগোলিক দিক দিয়ে দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় খানিকটা আলাদা উত্তরের জেলা লালমনিরহাট। সাধারণত বিভিন্ন জেলার জেলা সদর ঘিরে অন্যান্য উপজেলার অবস্থান। কিন্তু লালমনিরহাট জেলার এক মাথায় অবস্থান জেলা সদরের। বাকি উপজেলাগুলো একটির পর একটি অবস্থিত। প্রথমে সদর উপজেলাসহ জেলা শহর। এরপর একে একে অন্যান্য উপজেলা। জেলার এক পাশে ভারতীয় সীমান্ত, অন্য পাশে তিস্তা নদী।</p> <p>জেলার অবস্থান লম্বাকৃতির হওয়ায় সর্বশেষ উপজেলা পাটগ্রামের সঙ্গে জেলা শহরের দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিলোমিটার। আর ওই উপজেলায় অবস্থিত দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দরগুলোর একটি বুড়িমারীর দূরত্ব জেলা সদর থেকে প্রায় এক শ কিলোমিটার। এর পরের উপজেলা হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারীর সঙ্গে জেলা শহরের দূরত্ব যথাক্রমে ৫০, ৩০ ও ১৬ কিলোমিটার।</p> <p>অবস্থানগত এই দূরত্বের কারণে সদর বাদে বাকি চার উপজেলার মানুষ সারা দেশের সঙ্গেই রেল ও সড়ক যোগাযোগে ভোগান্তিতে আছে। অনেক প্রতিশ্রুতির পরও চালু হয়নি বুড়িমারী-ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেন। আবার এই চার উপজেলা থেকে চালু হয়নি দিবাকালীন দূরপাল্লার বাস সার্ভিস। ফলে এসব এলাকার মানুষকে ট্রেন বা বাসে দিনের বেলা রাজধানীর উদ্দেশে যাত্রা করতে হলে প্রথমেই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যেতে হয় লালমনিরহাট শহরে, নয়তো রংপুরে।</p> <p>বুড়িমারী স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বন্দরটি দিন দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি এই বন্দর ব্যবহার করে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসা কিংবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন অন্তত পাঁচ শ পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত করে থাকে। এতে দূরের</p> <p>মানুষ বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। তারা স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফিরেই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের দূরের জেলাগুলোতে যাওয়ার কোনো গাড়ি পান না। দূরপাল্লার নৈশকোচের জন্য অপেক্ষা করতে হয় সন্ধ্যা পর্যন্ত। আবার দেশের ভেতর থেকে কেউ ট্রেনে এলে নেমে যেতে হয় লালমনিরহাট শহরে বা রংপুরে। পরের যাত্রাপথটুকু পুরোটাই ভোগান্তির।</p> <p>বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাসপোর্টধারী যাত্রীদের ইমিগ্রেশনের কাজে সহায়তাকারীদের একজন জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে যাতায়াতকারীদের জন্য বুড়িমারী-ঢাকা আন্ত নগর ট্রেন ও দিনভর চলাচল করা দূরপাল্লার বাস সার্ভিস প্রয়োজন। এ দুটি সুবিধা যত দিন না হবে তত দিন এই ভোগান্তির শেষ হবে না।</p> <p>জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে আলোচিত ছিটমহল দহগ্রাম সফরকালে বুড়িমারী-ঢাকা আন্ত নগর ট্রেন চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সব শেষ গত বছরের গোড়ার দিকে বুড়িমারী স্থলবন্দর পরিদর্শনে এসে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনও ওই বছরের মধ্যেই আন্ত নগর ট্রেন চালুর আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ অবধি কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বর্তমানে চার উপজেলাকে পেছনে ফেলে রেখে লালমনিরহাট থেকে ঢাকার পথে চালু আছে আন্ত নগর ‘লালমনি এক্সপ্রেস’ ট্রেন।</p> <p>দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রেও বঞ্চনার শিকার আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও পাটগ্রামের মানুষ। ঢাকার উদ্দেশে দুই-তিনটি দিবাকালীন কোচ ছেড়ে যায় শুধু লালমনিরহাট শহর থেকে। আবার নৈশকোচগুলো সবই ছাড়ে বুড়িমারী থেকে। এ অবস্থায় এই চার উপজেলার মানুষ জরুরি প্রয়োজনেও দিনের যেকোনো সময় সরাসরি ঢাকা যেতে কোনো বাস পান না।</p> <p>কালীগঞ্জের কলেজ শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘যোগাযোগের ক্ষেত্রে এখানে সব সুবিধাই কেবল জেলা শহরের বাসিন্দাদের জন্য।’ পাটগ্রামের বাউরা এলাকার বাসিন্দা ও রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবির হোসেন বলেন, ‘আশপাশের জেলাগুলো থেকে সারা দিনই ঢাকায় যাতায়াত করা যায়। কিন্তু আমাদের অপেক্ষা করতে হয় নৈশকোচের জন্য।’</p> <p>হাতীবান্ধা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড কাউন্সিলের আহ্বায়ক সোহেল রানা বলেন, ‘এই চার উপজেলার জন্য ট্রেন-বাস উভয় ক্ষেত্রেই বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। মূলত রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছার অভাবেই এখানকার লাখ লাখ মানুষ ভুগছেন।’</p> <p>পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন লিপু বলেন, ‘বুড়িমারী-ঢাকা সরাসরি ট্রেন চালু হলে লাখো মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হতো। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং রেলপথ মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হতো।’</p> <p>বিষয়টি নিয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় বাস মালিক অনুপ কুমার রায় বাপ্পীর সঙ্গে। জেলা মোটর মালিক সমিতির এই নেতা দাবি করেন, ‘বুড়িমারী বা বাকি উপজেলাগুলো থেকে ঢাকার দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় সকালে সেখান থেকে ছেড়ে ঢাকা গিয়ে আবার রাতে যাত্রী নিয়ে ফিরে আসার সময় থাকে না। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ না থাকায় মালিকরা দিনে বাস চালাতে আগ্রহী হন না।’</p> <p>বুড়িমারী-ঢাকা আন্ত নগর ট্রেন চালু প্রসঙ্গে লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার তাপস পালের বক্তব্য জানতে গত বুধবার একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।</p>