হারানো জীবিকা অথবা লুপ্ত জীবিকা অথবা লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় জীবিকা—যে হিসেবেই এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখি না কেন, গত প্রায় চার দশকে আমাদের সামনে থেকে হারিয়ে গেছে অথবা হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক জীবিকা। গোনাগুনতির হিসাবে অসংখ্য, তার কিছু দৃশ্যমান আর কিছু অদৃশ্য। সেই হারিয়ে যাওয়া কখনো প্রকাশ্যেই, কখনো অপ্রকাশ্যে আর সংগোপনেও! চেনাজানা প্রাত্যহিক দিনযাপনে প্রায় লেপ্টে থাকা কিন্তু আজ হারিয়ে যাওয়া ৩০টি জীবিকার কথা নিয়ে হয়ে উঠল এ বই।
অনেক দিন আগে হাতে এসেছিল পশ্চিম বাংলার কথাসাহিত্যিক কিন্নর রায়ের ‘লুপ্ত জীবিকা’ নামের একটি পকেট বই।
সেখানে পশ্চিমবঙ্গের জনজীবন থেকে লুপ্ত অনেক জীবিকার কথা লিখেছিলেন তিনি। সেই জীবিকার কোনো কোনোটি বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল না। কিন্তু এ বিষয়ে অনুসন্ধিত্সু করে তুলতে সে বই সাহায্য করেছে খুব। কিছুদিন আগে বইটি আবার পড়তে পড়তে ভাবা গেল, আমাদের চারপাশ থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এমন অনেক জীবিকার কথা তো লেখাই যায়; কোনো কোনোটি ছিল প্রায় প্রাত্যহিকই, কোনো কোনোটি পার্বণিক, কোনোটি বাৎসরিক। কিন্তু সেগুলো হারিয়ে গেছে অথবা হারিয়ে যেতে বসেছে অথবা শিগগিরই দিনবদলের অভিঘাতে হারিয়ে যাবে। আমরা চাই কি না চাই, সেগুলো আর টিকে থাকবে না, থাকবেও না আমাদের চোখের সামনে।
বাংলাদেশের হারানো জীবিকা নিয়ে এ বই। প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ।
শ্রদ্ধাভাজন হায়াৎ মামুদ প্রাক্-চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি পুরোটা পড়েছেন। একদা ক্লাসপালানো ছাত্র আমি তাঁর, এখানে নির্দেশ পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।
মোস্তাফিজ কারিগরের অলংকরণ পাঠকের জন্য সহায়ক, পাশাপাশি নন্দনগুণও তাতে বেড়েছে আশা করি। বইটির এই পর্যায় পর্যন্ত সৈকত হাবিব ও জসিম উদ্দিনের আগ্রহ কোনোভাবেই ভুলবার নয়। তাঁদের উদ্দেশে ধন্যবাদ ও প্রীতি।
বইটির বিষয়ক্রম : ঝরনাকলমে নাম খোদাই, ঘটিগরম, ঝরনাকলম সারাই, বটতলায় বই, ব্ল্যাকের ইন্ডিয়ান শাড়ি, সিনেমার ক্যানভাস, দেলবাহার, বানর-খেলা, আটাকদমা, উড়ে মালি, কুলিফ মালাই, বায়োস্কোপ, শিল-পাটা খোঁটানো, টিয়ে পাখির ঠোঁটে ভাগ্য গণনা, টাইপরাইটার, মাধুকরী : গাজির গান, মাধুকরী : বৈষ্ণব ও বৈরাগিণী, পুরনো কাপড়ের বদলে বাসনকোসন, ভাড়ার সাইকেল, মাখন জ্বালিয়ে ঘি, তেল মালিশ, পুকুর আর কুয়ো ছাঁকা, পট ও পটগান, কাঁসা-পিতলের বাসন, যন্ত্রে বাত নিরাময়, ঘোলওয়ালা ও ঘোষমশাই, বহুরূপী, বাজারের মাসি, পিন-হোল ক্যামেরা, লেটার প্রেসের কম্পোজিটর।
এ বইয়ে যে কথা বলা যায়নি, যে কথা বলা যেতে পারত—সেই না-পারার অক্ষমতার দায় আমার। তবু এই লেখায় যদি হারিয়ে যাওয়া জীবিকাগুলোর সঙ্গে জড়িত সেই সব মানুষের কথা আবারও ভেবে নিতে পারি, তাদের আর কখনো দেখা না পাওয়ার মাঝেও এখানে মুখোমুখি হওয়ার স্মৃতি তবু কিছু প্রাপ্তির!