তিনি ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। চাকরির দুই মাসের মধ্যে দুটো স্কুপ নিউজ করি। ফলে আমার এডিটর ও শিক্ষক এ ডি চৌধুরী চিন্তাগ্রস্ত হয়ে যান এবং আমাকে পরামর্শ দেন, আইয়ুব খান সরকারের সময়ে এ ধরনের স্কুপ করাটা পত্রিকার পক্ষে সম্ভব হবে না সব সময়। তিনি বলেন, স্কুপের দিকে তোমার নজর থাকলে তুমি বরং লন্ডনের ফ্লি্ট স্ট্রিটে যাও। আর না হলে তুমি সাংবাদিকতা বিভাগে চাকরি নিয়ে নাও। তিনি সে ব্যবস্থাও করলেন। বুঝলাম সেদিন, স্যার আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তার পরপরই আমি পাঞ্জাব বিশ্ববিদালয়ে লেকচারার হিসেবে সাংবাদিকতা বিভাগে যোগদান করি। তখনও সাংবাদিকতা করতাম। কিন্তু স্কুপ নিউজ করতাম না।
কিন্তু পরে সাংবাদিকতা এবং শিক্ষকতাও তো ছেড়ে দিলেন?
ছেড়ে দিতে হলো। লেখালেখি ছাড়াও আমি একজন সিরিয়াস পাঠকও ছিলাম। একটি সত্য অনুভব করতে আমার খুব একটি দেরি হয়নি যে, লিখতে হলে প্রচুর পড়তে হয়, বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে হয় আর তারও বড় সত্য হচ্ছে, প্রকাশক হলেন জ্ঞানের ভুবনের দ্বাররক্ষী। ঠিক তখনই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দিয়ে 'এডিটর ফর পাকিস্তান' পদের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করেন। এটা '৬৮-৬৯ সালের ঘটনা। '৬৯-এর গণআন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দাজ করলাম, পাকিস্তানে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে আবেদন করলাম স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক উইলবার শ্রামের বরাবর। দ্রুত তিনি আমাকে জানালেন, তাঁর পক্ষে আমাকে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে নেওয়া সম্ভব। তিনি আরো জানালেন, আমার সহায়তার জন্য ২০০ ডলার বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। অক্সফোর্ডেও আবেদন করেছিলাম। সেই সাক্ষাৎকার কমিটিও চলে এসেছে পাকিস্তানে। যার প্রধান ছিলেন স্যার জন ব্রাউন। করাচিতে আমাকেসহ তিনজনের শর্ট লিস্ট করে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হলো। চাকরিতে যোগদানের সময় নিয়োগপত্রে লেখা ছিল, ছয় মাসের শিক্ষানবিসী করতে হবে। সেটাও করলাম এবং চাকরি স্থায়ী হলো।
স্বাধীনতার পরে ঢাকায় চলে এলেন?
বাহাত্তরে এসেছি। অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষকে বললাম যে, আমি চলে যাব। আমাকে অন্য কোথাও পোস্টিং করতে পারলে করো। আমাকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রোভিং এডিটর হিসেবে বদলি করা হলো। ঢাকা-দিল্লি, করাচি এবং ইস্ট এশিয়ান ব্রাঞ্চ মালয়শিয়া- এই তিনটি কাভার করতে হবে। এই অফিসগুলোতে অক্সফোর্ডের সম্পাদকীয় কার্যক্রম কো- অর্ডিনেট করাই আমার কাজ। কাজ পেয়ে তো আমি মহা খুশি। আমার হেড-কোয়ার্টার ছিল ঢাকা। সত্যি কথা বলতে গেলে আমি কাজ ভালো করেছিলাম। করাচি শাখা ছিল লসের মধ্যে। আর এখানে তো খুব একটা পাবলিকেশন হতো না। বোর্ডের বই কিছু করত আর ইউনিভার্সিটির প্রশ্নপত্র কিছু করত। কিন্তু আমাদের প্রশ্নপত্র কোনো দিন ফাঁস হয়নি।
পাবলিকেশনসে গুরু তো মার্টিন পিক?
তিনি ছিলেন খুবই ভালো একজন সম্পাদক। আক্সফোর্ডের সম্পাদক হিসেবে তিনি ভারত, পাকিস্তান এবং এখানে কাজ করেছেন। তারপরে যোগদান করেছেন ম্যাকমিলানে। নিজে একটা পাবলিশিং হাউসও করেছিলেন ইংল্যান্ডে। উনি আছেন। এবারও শীতের শুরুতে আমার কাছে এসেছিলেন। উনার স্ত্রী সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করেন কিংস কলেজে। আমি গেলে উনার ওখানে উঠি, থাকি। তিনি আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। শিখিয়েছেন কিভাবে এডিটিং করতে হয়।
ইউপিএল গড়ে উঠল কিভাবে?
১৯৭৫ সালে, অক্সফোর্ড ঢাকা অফিস বন্ধ করে দিল। আমার হাতে বিকল্প প্রস্তাব ছিল রোভিং এডিটর হিসেবে কাজ করে যাওয়ার, তবে ঢাকায় কোনো অফিস থাকবে না। অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে পারবো করাচি এবং দিল্লী শাখাকে। করাচিতে যেতে চাচ্ছিলাম না। সেখানে আমি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে যাব। অক্সফোর্ডের উত্তরসূরি হিসেবে ইউপিএল শুরু করলাম। কারণ আমি ছিলাম এখানে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা। আর ইংরেজি দিয়ে শুরুর কারণ হলো, ইংলিশ আমি তুখোড়ভাবে দেখতে পারব। বাংলা মিডিয়ামে পড়ালেখা করিনি। বাংলা সাহিত্যের ভাষাগত দিক আমার দখলে নেই। অনেকের চেয়ে ভালো বাংলা হয়তো লিখব, কিন্তু একজন লেখকের লেখা বিচার করার মতো বাংলা জানা প্রকাশক আমি নই। ফলে প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তুলতে হলো যেটা অ্যাকাডেমিক এবং গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করবে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের পাঠ্য ভালো বই অ্যাডাপ্ট করার জন্য আমরা চুক্তিবদ্ধ হলাম অক্সফোর্ড ও ওরিয়েন্ট লংম্যানের সঙ্গে। শুরুটা হলো অক্সফোর্ডের সঙ্গে, ছয়টা বই নিয়ে। আর অক্সফোর্ডের উত্তরসূরী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ছিল ওদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমরা নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারী করব।
বইমেলাতে কীভাবে এলেন? আপনার তো সব ইংরেজি বই?
বাংলা একাডেমির বইমেলার যখন মিটিং হলো, তখন বলেছি যে শুধু বাংলা বই কেন হবে? আমাদের ছেলেরা কি ইংরেজিতে বই পড়বে না? মেলা কিন্তু শুরু করেছেন ফোকলোরের আশরাফ সিদ্দিকী সাহেব। আশরাফ সিদ্দিকী ছয়-সাতজন প্রকাশককে নিয়ে মিটিং ডেকেছিলেন। আমি ছিলাম, চিত্তবাবু ছিলেন, স্ট্যান্ডার্ড বুক হাউজের নিজামী সাহেবসহ আরো কয়েকজন ছিলেন।
ইংরেজি বই কিভাবে বের করতেন?
সত্যি কথা হলো ইংরেজি বই আমরা অ্যাডাপ্ট করেছি। হংকংয়ের একজন ছিল হাওয়ি। ওর বই হচ্ছে অ্যাকটিভ ইংলিশ। সেটি এখানে ছেলেমেয়েদের উপযোগী করে ছাপানোর জন্য অনুমতি সংগ্রহ করেছি। অ্যাডাপ্ট মানে ছবি বদলাতে পারতাম, চরিত্রের নাম বদলাতে পারতাম, যাতে বাঙালি বাচ্চারা বুঝতে পারে যে এটা রোজি নয়, রীতা। এ ধরনের ইংলিশ উচ্চারণ ভঙ্গির কাছাকাছি যে বাংলা শব্দ পেতাম, সেটা ব্যবহার করতাম।
ওই সময়টাতে কাদের সঙ্গে আপনার সখ্য গড়ে উঠল, লেখকদের মধ্যে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো?
লেখকদের মধ্যে আমার মনে আছে বয়সের দিক থেকে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শওকত আলীর সঙ্গে। এঁরা নিয়মিত আসতেন। শামসুর রাহমান আর আমি এক পাড়ায় থাকতাম, শ্যামলী। তিনিও নিয়মিত আসতেন। ইলিয়াসের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল মুশফিক আহমেদ। সে আমার ক্লাস ফ্রেন্ড ছিল। মুশফিককে নিয়েই গল্প করতাম। ইলিয়াস এমনিতেই আসত। সে যখন জগন্নাথ কলেজে এলো, আস্তে আস্তে এদিকে আসা কমে গেল। আমার জীবনের গল্প নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করেছিল ইলিয়াস। আর রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যেভাবে ভুল পথে গেল সেটি নিয়েও আরেকটি বই লেখার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। আই ওয়াজ ফ্রেন্ডলি উইথ রাইটারস। হাসনাত অবদুল হাই। লেখকদের সঙ্গে বন্ধুত্বটা স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে।
আপনি তো আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সাহেবের বইও বের করেছেন- 'চিলেকোঠার সেপাই'।
একটা না, তিনটা না, চারটা বই। 'চিলেকোঠার সেপাই'- হিট বই।
'যথাশব্দ' আপনার আরেক বেষ্টসেলার।
কোর্টের এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। বললেন, উনি (মুহম্মদ হাবিবুর রহমান) একটু আলাপ করতে চান। আমি বললাম, ব্রিটিশরা তো ঠিকই আমার অফিসে আসে। বাঙালি লেখকরা তো ঠিক আসে না। আমরাই গিয়ে খোঁজ নিই। দুষ্টুমি করে বলেছিলাম। উনি আবার এই দুষ্টুমিটা গিয়ে করছেন হাবিবুর রহমান সাহেবের সঙ্গে। হাবিবুর রহমান সাহেব মেসেজ পাঠালেন, মহিউদ্দিন সাহেবকে বলবেন, আমি আসব উনার ওখানে। আমি বললাম সেকি! তিনি তো এখন প্রধান বিচারপতি। আমিই তাঁর কাছে যাব। তিনি বললেন- না, আমি আসব। তিনি এসেছিলেন। আর এই বই নিয়ে আলাপের সময় আমি বললাম যে, যথাশব্দের খুব ডিমান্ড হবে আমার ধারণা। কারণ খুব সুন্দর বাংলা, প্রমিত বাংলায় ভালো করে লিখতে পারে না। তিনি বললেন, এটা তো খুব কঠিন পরিশ্রমের কাজ। আপনার তো লোক জোগাড় করে দিতে হবে। বললাম- হ্যাঁ, লোক জোগাড় করে দেব। তখন পেঙ্গুইনকে লিখলাম। ওরা একজনকে বলল, সে এলো না। কবীর ছিল, সে বলল- স্যার, আমি আর নাঈম চেষ্টা করি করি। আরো মজার ব্যাপার হলো- বাংলা একাডেমির আর আমাদের যথাশব্দ নেন, দেখবেন যে কোনো মিল নেই। একেবারে নতুন বই করা হয়েছে।
এডিটিং প্যানেল আপনাদের তখনো ছিল, এখনো আছে।
আমি নিজে এডিটর ছিলাম তো, সে জন্য একে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।
বইয়ের মানও তো পরিবর্তিত হয়েছে।
হোয়াইট প্রিন্টিং পেপার বাংলার জন্য আর ইংরেজি বইয়ের জন্য অফসেট পেপার প্রিন্টিং করতাম। কারণ ইংরেজি বইয়ের দাম রাখা ইজি হতো। বাংলায় দামটা কমিয়ে রাখা হতো।
বইয়ের দামটা কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?
ইংল্যান্ডে বইয়ের আসল দাম থেকে ১২ থেকে ২০ গুণ বাড়িয়ে রাখা হয়। বইয়ের দাম যদি এক পাউন্ড হয়, তাহলে সেটার দাম হবে ১২ পাউন্ড থেকে ২০ পাইন্ডের মধ্যে। ভারতে এই দাম ছয় গুণ পর্যন্ত রাখা বৈধ। আমাদের এখানে জনপ্রিয় বইয়ের ক্ষেত্রে চারগুণ। এটা একটা থোক হিসাব। হিসাবটা হচ্ছে এমন- একটা বই যখন আমরা হাতে নিই, তখন প্রতিদিন যে বিলটা যায়, আমি আপনাকে দেখিয়ে দিতে পারব ইচ্ছে করলে, বিলের মধ্যে লেখা থাকে, কোন বইয়ের জন্য চা খেল, কোন বইয়ে যাতায়াত ভাড়া গেল, কোন বইয়ের জন্য কী রেফারেন্স বই কেনা হলো। ওটার পেছনে যে আসল খরচ আছে, সেটার সঙ্গে এগুলো যোগ করা হবে। তার পরে হিসাব করা হবে, এটা কি ধরণের বই হবে। জনপ্রিয় ধারার বই হলে এটার বিজ্ঞাপন লাগবে। বিজ্ঞাপনের রেট ধরে সেই দাম ঠিক করা হবে। বাংলার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই দাম বেশি হবে। ওটাকে আমরা ওভারহেডের মধ্যে কাভার করি। ওভারহেড একটা আছে না এই যে সকালে আমি এলাম, ভাড়া দিলাম।
বইয়ের বিজ্ঞাপনে কি কাজ হয়?
কাজ হয় না। সামান্য কাজ হতো রিভিউতে। আজকাল রিভিউ সব দোস্তরা করে। আমাদের নির্দিষ্ট রিভিউয়ার আছে। আমরা বই রিভিউ করার জন্য দেই ডেইলি স্টারকে। আর তারা ঠিক করেন কাকে দিয়ে রিভিই করাবেন। ওটা তাদের হাতে। আমি সেরা রিভিউয়ার বলব ড. মুজাফফর আহমদকে। আতিউর ভালোই করত। সে তো আর পরে রিভিউ করত না।
আন্তজার্তিক বাজারেও তো প্রবেশ করেছেন?
উদাহরণ দিয়েই বলি- এই যে বঙ্গবন্ধুর বইটা করেছে না, সেখানে আমি বলেছিলাম বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী হিসেবে এখানে আমি আসিনি, এসেছি একজন পেশাদার প্রকাশক হিসেবে। আপনারা আন্তজার্তিক বাজারে এই বইটি নিতে চান। আর আমি চ্যালেঞ্জ করে বলবো- আমার মতো সেটা কেউ পারবে না।
বইয়ের মানের জায়গাটা, প্রচ্ছদের পরিবর্তন এসেছে?
আমি যদি বলি আপনি হাসবেন। শুরুর দিকে যেসব বই আমাদের আছে, প্রতিটি প্রচ্ছদে ভিজ্যুয়াল আমার (এই সময় আলোচনায় অংশ নিলেন ইউপিএলের পাবলিশার অ্যাডভাইজার বদিউদ্দিন নাজির। তাঁকে উদ্দেশ করে মহিউদ্দিন আহমেদ বললেন, এই, আমরা যে এত কথা বললাম, তুমি কোথায় ছিলে?)
বদিউদ্দিন নাজির : আমি আছি তো, শুনতে পাচ্ছি তো। পাবলিশিংয়ে দুটি ক্ষেত্রে চেইঞ্জ হয়েছে, লেটার প্রেস থেকে অফসেট হয়েছে আর হুমায়ূন আহমেদ বাংলাবাজারের শাপমুক্তি ঘটিয়েছেন। তিন. একুশে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেছে, এটা একেবারে নতুন সংযোজন।
আরেকটা বিষয় নিয়ে আলাপ করব। অনুবাদ সাহিত্য বাংলাদেশে...।
এটা আরেকটি দুর্বলতা। আমাদের চরম দুর্বলতা। ভালো অনুবাদ কোথায়?
নাজির : অনুবাদ সাহিত্যের ব্যাপারটি খুলে বলি। যেকোনো লেখায় একটি কপিরাইটের ব্যাপার থাকে। যিনি লেখেন, যেকোনো পাবলিশার থেকে ছাপা হোক না কেন, বিদেশের এবং দেশের, সত্ব দাঁড়িয়ে যায় লেখকের ও প্রকাশকের। এই সত্বটা মারা যাওয়ার ৬০ বছর পর্যন্ত লেখক বা তার উত্তরাধিকারীর থাকে। অনুবাদ করতে গেলে যে কারো বই নিয়ে তুমি অনুবাদ করো; তুমি কি তার পারমিশন পেয়েছ? পারমিশন ছাড়া তার অনুবাদ করছ কিভাবে?
মহিউদ্দিন : খামাখা চুরি করা আর কি।
নাজির : মানে অন্যের সম্পত্তি জোর করে ভোগ করা। একমাত্র ওল্ড ক্লাসিকসগুলোর ওপরে কারো কোনো সত্ব নেই...
মহিউদ্দিন : পাবলিক ডোমেইনের ব্যাপারটি দেখতে হবে।
অনেককেই আক্ষেপ করতে দেখা যায়, আমাদের অক্সফোর্ডের মতো অভিধান নেই।
নাজির : একটি অভিধান তৈরি করতে বহু টাকা লগ্নি করা লাগে, লাখ লাখ টাকা খরচ এবং অনেক দিন সময় লাগে, তবে একটি ডিকশনারি দাঁড় করা যায়। এটা একটা প্রাইভেট পাবলিশারের পক্ষে সম্ভব হয়। খুব বড় পাবলিশার হলে সে হয়তো করতে পারে।
মহিউদ্দিন : বড় পাবলিশার না, অন্য ব্যবসা থাকলে...।
নাজির : অন্য ব্যবসা থাকলে। করলেও পাইরেসি যত দিন আছে, এক কোটি টাকা খরচ করে একটি বই করলাম। কিন্তু সেটা মার্কেটে যাওয়া শুরু করল, পাঠক খাওয়া শুরু করল, বই পাইরেটেড হয়ে যাওয়া শুরু করল। বাংলা একাডেমির ডিকশনারি কিন্তু পাইরেটেড হয়ে গেছে। বাংলা একাডেমি নিউজপ্রিন্টে সস্তায় করে, তিন-চার শ টাকা করে দাম নিচ্ছে; তাও পাইরেসি হচ্ছে। আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার কথা কনসিডার করে আমাদের ভালো ডিকশনারি থাকা দরকার। বেঙ্গলি টু বেঙ্গলি করতে গেলে সমস্যা, আমাদের কারো সংস্কৃত ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। যে কারণে বাংলার গায়ে কেউ হাত দিতে পারে না। যে কারণে আমরা অথেনটিক কিছু করতে পারিনি।
পেঙ্গুইন, ম্যাকমিলান- এদের শাখা হতে পারে না বাংলাদেশে?
নাজির : না, হতে পারে না। যে পরিমাণ ডিমান্ড থাকলে একটি পেঙ্গুইন চলতে পারে, তত ডিমান্ড মার্কেটে নেই। কোনো বই ৬০ কপি, কোনো বই ১০০ কপি, আবার যেটি মার্কেট ধরে ফেলে, পাইরেসি হয়ে যায়। তখন সে বই নিয়ে পাবলিশার কী করবে?
তাহলে তো বই আমদানি হতে পারে?
নাজির : বই আমদানিও রিস্কি হয়ে যাচ্ছে, এ কারণে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, অন্যদেরও অভিজ্ঞতা আছে। ধরো, একটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর বই, কি ডাক্তারির ওপর বই, খুব চালু বই, ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয়, বইটি সে ১০০ কপি ইমপোর্ট করে আনে। একটা বইয়ের ইমপোর্ট প্রাইস ৫০০ টাকা, সেটা নীলক্ষেতে তারা ফটোকপি করে সাড়ে তিন শ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে।
মহিউদ্দিন : নীলক্ষেতে একটা দোকান আছে, সেখানে আমাদের সব বই, এক অধ্যায় চাও, দুই অধ্যায় চাও, ক্লাসরুমে ওদের শিক্ষক বলে দেন, অধ্যায় ছয় আর সাত, ওরা ছয় আর সাত ফটোকপি করে দেয়। ছাত্রদের কথা ভেবে আমি কখনো না করিনি। সে হয়তো সাড়ে পাঁচ শ টাকা দিয়ে এ বই কিনতে পারবে না।
আমাদের এখানে ভারতের বই কিন্তু আসে। বাংলাদেশের বই কিন্তু সেভাবে যাচ্ছে না। আমরা ভারতের বই কিনছি। কেন?
নাজির : বাংলা একাডেমির বইমেলায় ভারতীয়দের আমরা ঢুকতেই দিই না। ওদের কলকাতা বইমেলায় আমাদের বিশাল খোলা জায়গা করে দিয়েছে। তাতেও লাখ লাখ টাকার বই বিক্রি হয় না। তার কারণ হচ্ছে, আমার বইটা তাদের মধ্যে চাহিদা বা বইটি সংগ্রহ করার বাসনা তৈরি করতে পারে না। তাহলে আমাদের বই তারা আমদানী কেন করবে? আমাদের যারা আমদানী করে, তাদের ভারতীয়দের কেউ আমদানী করতে বলেছে?
তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে আমাদের বইয়ের কোনো চাহিদা তাদের মধ্যে নেই?
নাজির : চাহিদা থাকলে তো তারা কাঁধে করে নিয়ে যেত। বই বিক্রি করে পয়সা হলে, পয়সার জন্য ব্যবসায়ীরা কী না করে? সবই করে। আমাদের ইউপিএলের বই কলকাতার প্যারাগন এন্টারপ্রাইজে স্থায়ীভাবে প্রদর্শন ও বিপননের ব্যবস্থা রয়েছে। তার টার্নওভারও তো খুব ভালো না।
একসময় বাংলাদেশের কবিতা, ছোটগল্প বের করতেন। এখন আর হয় না কেন?
মহিউদ্দিন : এটার কথা কী বলব? নাজির অনেক কষ্ট করে করেছিল। ছয়-সাতজন স্কলার ছিলেন। সবাই বলেছেন, এ রকম বই দরকার যেখানে সেরা লেখকদের নির্যাসটি পাব। কই, চলল না তো। আগে চার ভলিউমে করতাম, তার পরে এক ভলিউমে। তার পরে...। অনেক খরচ আসত। আমাদের খরচটা কেউ দেখে না।
নাজির : সারা বছরের তথ্য সংগ্রহ করতেই তো অনেক খরচ আসত। যে বই নিজের দেশে চলে না, অন্য দেশে চলবে, আমরা আশা করি না।
আমাদের বই বিক্রি কি বইমেলাকেন্দ্রিক?
নাজির : লেখক লিখল, প্রকাশক ছাপল, ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে সেটা রিটেইলারের কাছে গেল। সে সেগুলো বায়ারের কাছে পৌঁছে দিল। ক্রেতার সঙ্গে প্রকাশকের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। সে নানা রকম গবেষণা, এটা-সেটা করে ক্রেতার মনোভাব, রুচি ইত্যাদি যাচাই করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে সমস্যা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও অংশত তা-ই, প্রকাশক বই ছাপে, কিন্তু যেহেতু তার খুচরা বিপননকারী নেই, মানে ওই মাধ্যমে সে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে পারছে না, তাই সরাসরি পাঠকের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই সুযোগটা বইমেলায় বাংলাবাজার কোনোভাবেই মিস করতে পারছে না। কারণ তার তো নেটওয়ার্ক নেই। যার ফলে আমাদের বই ছাপাও হয়ে গেছে বইমেলাকেন্দ্রিক। কিন্তু যাদের নেটওয়ার্কের ভয় নেই, সারা বছর ধরে বই ছাপলেও অসুবিধা নেই। এর ফলে অসুবিধা হয়েছে, বাংলাবাজারের কোনো বই নিউ মার্কেটের দোকানদার রাখতে উৎসাহী হয় না। বলে, তোমরা তো কাস্টমারের কাছে সরাসরি ৩০ পার্সেন্ট কমিশনে বিক্রি করো। তোমার বই রাখব কেন? মোস্টলি বইমেলায় বিক্রি করি। সারা বছর বিভিন্ন টেন্ডার হয়, সেগুলোতে বিক্রি করি।
(৩১ জানুয়ারি ২০১৩, ইউপিএল, রেড ক্রিসেন্ট ভবন, মতিঝিল, সকাল সাড়ে ১১টা-২টা)