<p>সুপ্রাচীন কাল থেকে বিচারসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক. যা শরিয়তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, দুই. যা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকরা ধর্মীয় বিষয়গুলোকে বিচারকের ওপর ন্যস্ত করতেন এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে নিজেদের হাতে রাখতেন। রাজনৈতিক বিষয়গুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। তবে জুলুমের অবসান ঘটানো এবং চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে যাওয়া বিষয়ের সমাধানের দায়িত্ব তারা নিজেদের কাঁধেই তুলে নিতেন। সত্যটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রকাশ পায়।</p> <p>মামলুক ও তাদের পরবর্তী সময়ের শাসকরা পুরো ভারতবর্ষে বিচারক নিয়োগ দিতেন। সব ধর্মীয় বিষয় এসব বিচারকের দায়িত্বে থাকত। যেমন—ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ, ওয়াকফ সম্পত্তি ও এতিমদের বিষয়। ইসলামী শরিয়তের আলোকেই সমস্যার সমাধান করতেন। প্রধান বিচারপতির উপাধি ছিল ‘কাজিউল কুজাত’। সুলতান বা সম্রাট নিজেই তাকে মনোনীত করতেন। ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকরা ‘আমির দাদ’ নামের একজন প্রধান প্রশাসক নিয়োগ দিতেন। তিনি অন্য প্রশাসকদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রশাসকদের বিরুদ্ধে কারো অভিযোগ থাকলে তাঁর কাছে নালিশ করা হতো। আমির দাদ নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহভীতি ইত্যাদি গুণ বিবেচনা করা হতো।</p> <p>মুসলিম শাসকরা জুলুম, চুরি, ডাকাতি থেকে রক্ষা করতে এবং মানুষের জীবন, সম্পদ, ঘরবাড়ি, শস্যক্ষেত ও বাগান রক্ষার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিতেন। তাদের কোতোয়াল বলা হতো। মানুষকে হারাম ও মন্দ কাজ, মাদক, অশ্লীলতা, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকে দূরে রাখতে একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতো। যাদের পদবি ছিল ‘মুহতাসিব’। মুহতাসিবরা পণ্যের পরিমাপে জালিয়াতি ও বাজারে মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ও তদারকি করত। এসব দায়িত্বশীল ব্যত্তি তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে বাদশার ‘দিওয়ানে আম’ তথা সাধারণ মজলিসে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করার সুযোগ ছিল।</p> <p>শের শাহ সুরির আমলে প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ‘মুনসেফ’ নিয়োগ দেওয়া হয়। পদমর্যাদায় তারা ছিল কাজি, মুফতি, কোতোয়াল ও অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী। মুনসেফের প্রধান কাজ ছিল প্রশাসনিক দুর্নীতি ও জুলুম থেকে মানুষকে রক্ষা করা। স্থানীয় পর্যায়ের মুনসেফদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতেন ‘সদরে মুনসেফ’। তিনিই আঞ্চলিক সমস্যাগুলো বাদশাহর কাছে উপস্থাপন করতেন।</p> <p>ভারতবর্ষে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিচারব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তারা ছোট-বড় সব প্রশাসনিক অঞ্চলে কাজি (বিচারক) নিয়োগ দেয়। প্রধান বিচারপতিকে কাজিউল কুজাত বলা হতো। তিনি সর্বদা সম্রাটের সঙ্গে থাকতেন। সামরিক বিভাগের জন্য ‘কাজিউল আসকার’ নিয়োগ দেওয়া হতো। বিচারক ধর্মীয় বিষয়ে এবং ধর্মের আলোকেই বিচার করতেন। মোগল সম্রাটদের দরবারে বিচারসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতো। যেমন—মুফতি (যিনি ধর্মীয় বিধান বর্ণনা করেন), আল ওয়াকিলুল আম (জনকল্যাণ কর্মকর্তা), মুহাররিরুল মুনাসাকা (লিপিকার), মুশরিফ (এজলাস পরিচালনাকারী) ইত্যাদি। স্থানীয় বিচারকদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে অঞ্চলভিত্তিক সদর নিয়োগ দেওয়া হতো। এ ছাড়া প্রত্যেক প্রশাসনিক অঞ্চলে কোতোয়াল ও থানাদার নিয়োগ দেওয়া হতো। জনকল্যাণ ও নৈতিকতা রক্ষায় ‘দারোগাহ আদালত’ নিয়োগ দেওয়া হতো। তারা সাধারণত প্রধান প্রধান শহরে অবস্থান করত এবং দিনের প্রথম প্রহর থেকে তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত তাদের কার্যলায়ে অবস্থান করত। যেন বিচার প্রার্থীরা তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বিচার প্রার্থনা করতে পারে। কার্যালায়ে সাক্ষাৎ করতে না পারলে রাস্তাঘাটেও তাদের কাছে বিচার দেওয়া যেত। সুবাহদার ও ফোজদার পদবির কর্মকর্তারাও সপ্তাহে এক-দুই দিন সাধারণ মানুষের আরজি শুনতে নির্ধারিত স্থানে অবস্থান করত।</p> <p>মোগল সম্রাটরা প্রতি সপ্তাহে এক দিন সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া, আরজি ও নালিশ শুনতেন। সাধারণত প্রত্যেক বুধবার ‘দিওয়ানে আম’ বা সাধারণ মজলিস অনুষ্ঠিত হতো। সম্রাটের রাজপ্রাসাদেই তা হতো। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিচারক, মুফতি ও গুণীজনরা উপস্থিত থাকতেন। একজনের পর একজনের দাবি ও নালিশ শুনতেন। কখনো সম্রাট নিজে থেকে উত্তর দিতেন, কখনো মুফতিদের জিজ্ঞাসা করতেন। বিচার প্রার্থী যদি কোনো দূর অঞ্চল থেকে আসত এবং বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ হতো, তবে সম্রাট তা তদন্তের জন্য বিশেষ লোক নিয়োগ দিতেন।</p> <p>সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর প্রতিদিন ইশরাকের নামাজ পড়ে বিচারকার্যে বসতেন। কোনো কোনো দিন জোহর থেকে আসর পর্যন্তও তিনি বিচারকাজে লিপ্ত থাকতেন। তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ‘উকিল’ নিযুক্ত করেন। এসব উকিলের কাজ ছিল অসহায় মানুষ, যারা বাদশাহর কাছে পৌঁছতে পারে না, কিন্তু শরিয়তের দৃষ্টিতে সে হকদার—তাকে বাদশাহর কাছে পৌঁছে দেওয়া।</p> <p>ভাষান্তর : আল হিন্দ ফিল আহদিল ইসলামী থেকে আলেমা হাবিবা আক্তার</p> <p> </p> <p> </p> <p> </p> <p> </p> <p><br />  </p>