<p>প্রত্যেক মুমিনের কাছে রমজান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসে যেমন সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর ভয় আত্মস্থ করা যায়, তেমন মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি ফিরালে দেখা যায় নবী, সাহাবি এবং মুসলিমরা রমজানে আত্মিক উন্নতির পাশাপাশি জাগতিক দায়িত্ব পালনে তৎপর ছিলেন। শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। এমন কিছু বিজয়গাথা যুদ্ধের বর্ণনা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।</p> <p> </p> <p><strong>বদর</strong> <strong>যুদ্ধ</strong></p> <p>বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মদিনার অদূরে বদর প্রান্তর অবস্থিত। বদর একটি কূপের নাম। বদর প্রান্তরে যুদ্ধ হওয়ার কারণে এটি বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। তবে কোরআনে এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফোরকান’ তথা সত্য-মিথ্যা ও হক-বাতিলের পার্থক্যকারী দিন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।</p> <p>পটভূমি : নবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় এসে বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেন এবং ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন। এতে কুরাইশদের গাত্রদাহ হয়। এ ছাড়া সিরিয়ার ব্যবসার পথে মুসলিমদের অবস্থান তাদের অনিরাপত্তার শঙ্কায় ফেলে। তাই উদীয়মান ইসলামী রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে অর্থের জোগান ও যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করতে মক্কার একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া যায়। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এই কাফেলায় ছিল এক হাজার মালবাহী উট এবং চল্লিশজন সশস্ত্র রক্ষী বাহিনী। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে এই কাফেলায় অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। ব্যবসা শেষে তারা মদিনার পথ ধরে মক্কায় ফিরছিল। এই সংবাদ পেয়ে নবী (সা.) কাফেলার পথ রোধ করবার জন্য বের হন। কেননা এ কাফেলায় কমপক্ষে ৫০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার সম্পদ ছিল। যা মক্কায় পৌঁছতে পারলে সবটাই মুসলিমদের বিপক্ষে ব্যয় হতো। কিন্তু আবু সুফিয়ান বিষয়টি টের পেয়ে ভিন্ন পথ ধরে এবং একজন উটারোহীকে দ্রুত মক্কায় পাঠিয়ে দেয়। মক্কার কুরাইশরা এ খবর পেয়ে আবু জাহলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা নিয়ে মদিনা অভিমুখে বের হয়। এই বাহিনীতে ১০০টি ঘোড়া এবং ১৭০টি উট ছিল। অন্যদিকে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। আর তাদের সঙ্গে ছিল দুটি ঘোড়া ও ৭০টি উট।</p> <p>যুদ্ধের বিবরণ : মক্কার কুরাইশরা বদর প্রান্তের উঁচু টিলাতে অবস্থান নেয়। মুসলিমরা বদর কূপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঢালু প্রান্তে শিবির স্থাপন করে। যুদ্ধের পূর্বরাতে বৃষ্টি হলে মুসলিমরা চৌবাচ্চা তৈরি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে এবং অন্যান্য জলাশয়ের পথ আটকে দেয়। ফলে কুরাইশরা পানির সংকটে পড়ে। কুরাইশ নেতা আসওয়াদ মাখজুমি আল্লাহর কসম করে বলে, আমি ওদের চৌবাচ্চা থেকে পানি সংগ্রহ করেই ছাড়ব। নতুবা তা ধ্বংস করব। প্রয়োজনে এর জন্য জীবন দেব। সে সামনে এগিয়ে এলে হামজা (রা.) তাকে হত্যা করেন। ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।</p> <p>আরবের প্রাচীন যুদ্ধরীতি অনুযায়ী মল্লযুদ্ধের জন্য কুরাইশদের পক্ষে উতবা, শায়বা এবং ওয়ালিদ বের হয়ে আসে। মুসলিমদের পক্ষ থেকে এগিয়ে আসেন তিনজন আনসার সাহাবি আউফ, মুয়াউয়িজ ও আবদুল্লাহ (রা.)। কুরাইশরা বলল, আমরা স্বজাতিদের সঙ্গে লড়তে চাই। তখন রাসুল (সা.) উবায়দা, হামজা ও আলী (রা.)-কে মোকাবেলার নির্দেশ দেন। তাঁরা তিনজনই নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেন। এরপর সম্মিলিত যুদ্ধ শুরু হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। নবী (সা.) একটি টিলার ওপর থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। আল্লাহ তাআলা তিন থেকে পাঁচ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করেন। তাদের আক্রমণে কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পিছু হটতে থাকে। আবু জাহলের মতো বড় বড় কুরাইশ নেতাসহ ৭০ জন কাফের নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হয়। আর ১৪ জন সাহাবি শহীদ হন। আল্লাহ তাআলা শিরক, মিথ্যা ও অনাচারের বিরুদ্ধে তাওহিদ, সত্য ও ইনফাসের ঝাণ্ডা উঁচু করেন।</p> <p>জয়ের প্রভাব : এই যুদ্ধ বিজয়ের কারণে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে একত্ববাদের উত্থান হয়। আরব ভূখণ্ডে মুসলিমদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তাদের সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়। অন্যান্য গোত্রের ওপর কুরাইশদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাস পায়। মুসলিমরা তাদের আস্থাভাজনে পরিণত হয়। সর্বোপরি এই জয়ের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য, ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি লাভ হয়।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/05.May/11-05-2020/1/2_kalerkantho-2020-11-pic-5.jpg" style="height:483px; margin:12px; width:800px" /></p> <p><strong>মক্কা</strong> <strong>বিজয়</strong></p> <p>মক্কা বিজয় একটি রক্তপাতহীন বিজয়। এটি নবী (সা.)-এর দূরদর্শিতার ফসল। মক্কা নগরীতে একত্ববাদের প্রতীক কাবাঘর অবস্থিত। পৃথিবীর সূচনা থেকে যুগে যুগে একত্ববাদের চর্চা হয়েছে এই ঘরে। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা আল্লাহর ঘরে মূর্তিপূজা ও শিরকের আখড়া বানিয়ে রেখেছিল। হিজরতের পর থেকে রাসুল (সা.) সেই একত্ববাদের তীর্থঘরে বিজয়ী বেশে ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। ৮ম হিজরির ১৮ মতান্তরে ২০ রমজানে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সে অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে। তিনি বিজয়ী অথচ বিনয়ী হয়ে এই পবিত্র নগরে প্রবেশ করেন। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ব, ক্ষমা, শান্তি এবং ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিজয়ানন্দ উদ্যাপনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।</p> <p>পটভূমি : ৬ষ্ঠ হিজরিতে রাসুল (সা.) ওমরার উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে বের হন। হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে মক্কার কুরাইশরা তাঁর পথ রোধ করে। দুই পক্ষের মধ্যে ১০ বছরের জন্য সন্ধি হয়। সন্ধিতে যেকোনো পক্ষের সঙ্গে অন্য গোত্রের মৈত্রীচুক্তির অনুমোদন থাকে। সে মতে বনু বকর কুরাইশদের সঙ্গে আর বনু খোজায়া মুসলিমদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে। কুরাইশরা এই সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে। বনু খোজায়ার লোকেরা হারাম শরিফে আশ্রয় নিলেও তাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে তাদের প্রচুর লোক নিহত হয়। এই ঘটনার পর বনু খোজায়ার নেতা আমর ইবনে সালিম রাসুল (সা.)-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তিনি তাদের সাহায্য করার আশ্বাস দেন। তিনি মক্কার কুরাইশদের কাছে এই মর্মে একটি বার্তা প্রেরণ করেন—১. খোজায়া গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করতে হবে, ২. অথবা বনু বকরের সঙ্গে কুরাইশের মৈত্রীচুক্তি বাতিল করতে হবে, ৩. অথবা হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে। কুরাইশরা তৃতীয় শর্ত গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের ভুল সিদ্ধান্ত বুঝতে পেরে সন্ধি নবায়নের জন্য আবু সুফিয়ানকে মদিনায় প্রেরণ করে। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়ে মক্কায় ফিরে যায়।</p> <p>মক্কা অভিমুখে যাত্রা : অষ্টম হিজরির ১০ রমজানে সম্পূর্ণ গোপনে মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু হয়। এই অভিযানে বিভিন্ন মিত্র গোত্রের লোকেরা মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়। এভাবে মোট সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার। তারা ১২ দিন পথচলার পর মারউজ জাহরান নামক গিরি-উপত্যকায় পৌঁছে শিবির স্থাপন করে।</p> <p>মক্কায় প্রবেশ : মক্কা নগরের চারপাশে প্রায় এক হাজার ফিট উঁচু পাহাড়। চারকোণে ৪০টি প্রবেশ পথ। এ জন্য মহানবী (সা.) সৈন্যদের চার ভাগে বিভক্ত করেন। একটি দল ছাড়া বাকি তিনটি দল বিনা রক্তপাতে মক্কায় প্রবেশ করে। আবু সুফিয়ান খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর দলকে আটকে দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ হয়। এতে ১২ জন কুরাইশ নিহত হয় এবং দুজন মুসলিম শহীদ হন। মহানবী (সা.) মক্কায় প্রবেশ করে কাবাঘর তওয়াফ করলেন। তখন কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। রাসুল (সা.) হাতের ছড়ি দ্বারা মূর্তিগুলো নিচে ফেললেন। দেয়ালের ছবিগুলো মোছার নির্দেশ দিলেন। তখন তিনি বলতেছিলেন, সত্য সমাগত। মিথ্যা দূরীভূত। এরপর তিনি মক্কায় ১৯ দিন অবস্থান করলেন। ৯ জন ছাড়া সব মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। মহানবী (সা.) মক্কায় প্রবেশ করে লোকদের বলেন, হে কুরাইশরা! তোমাদের সঙ্গে আমার কেমন আচরণ করা উচিত বলে মনে করো? তারা বলল, দয়া ও করুণা হে আল্লাহর নবী! আমরা আপনার কাছ থেকে ভালো ছাড়া কিছুই আশা করি না। এরপর তিনি ঘোষণা করলেন, আমি তোমাদের ঠিক তাই বলব যা ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের বলেছিলেন। আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা যেতে পারো কারণ তোমরা মুক্ত।</p> <p>জয়ের প্রভাব : মক্কা বিজয়ের পর পবিত্র কাবাঘর শিরক ও মূর্তির অবিচার থেকে মুক্ত হয়। আরবে ইসলামের অগ্রযাত্রা অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপ মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সমীহ করতে শুরু করে।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/05.May/11-05-2020/1/3_kalerkantho-2020-11-pic-5.jpg" style="height:483px; margin:12px; width:800px" /><strong>তাবুক</strong> <strong>যুদ্ধ</strong></p> <p>তাবুক যুদ্ধ ছিল মহানবী (সা.)-এর জীবনের শেষ যুদ্ধ, যা রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের কাফের ও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবম হিজরির রজব মাসে এই যুদ্ধ শুরু হলেও রমজানে কিছু খণ্ড যুদ্ধ হয়। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু : ৩/১৬২৭)</p> <p>মদিনা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম তাবুক। এটি মদিনা থেকে ৬৯০ কিমি দূরে এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে ৬৯২ কিমি দূরে অবস্থিত। উভয় পক্ষ সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিলেও তাদের মধ্যে কোনো লড়াই হয়নি। সম্মুখযুদ্ধের আগেই রোমান বাহিনী রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে যায়।</p> <p>পটভূমি : হুনাইন যুদ্ধের পর আউস গোত্রের নেতা ও খ্রিস্টান ধর্মীয় গুরু আবু আমের নিরাশ হয়ে সিরিয়া চলে যায়। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক তখন খ্রিস্টানদের কেন্দ্রভূমি ছিল। সেখানে গিয়ে সে রোম সম্রাটকে মদিনায় আক্রমণ করতে প্ররোচনা দিতে থাকে। অন্যদিকে মদিনার মুনাফিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাঁর নির্দেশনায় মুনাফিকরা কোবা মসজিদের অদূরে ‘মসজিদে জিরার’ নির্মাণ করে। ৮ম হিজরিতে মুতা যুদ্ধ শেষে মহানবী (সা.) মদিনা অভিমুখে রওনা দেন। পথিমধ্যে আল্লাহ তাআলা তাঁকে মসজিদ নির্মাণের ষড়যন্ত্রের কথা অবগত করেন। তিনি মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের মসজিদ গুঁড়িয়ে দেন। এরপর সংবাদ এলো, মদিনায় আক্রমণের উদ্দেশ্যে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস ৪০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করেছে এবং তাদের অগ্রবর্তী দল সিরিয়ার বালকা এলাকায় পৌঁছে গেছে।</p> <p>যুদ্ধের প্রস্তুতি : রোমানদের রণপ্রস্তুতির সংবাদ যখন পৌঁছায় তখন ছিল গ্রীষ্মকাল ও ফল পাকার মৌসুম। মদিনায় তখন অভাব-অনটন ও প্রচণ্ড রোদ ছিল। এরই মধ্যে রাসুল (সা.) যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। কারণ আরব সীমান্তে রোমানদের প্রবেশের আগেই তাদের পথরোধ করতে হবে। যাতে আরব ভূখণ্ডে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি না হয়। যুদ্ধে রণকৌশল হিসেবে তিনি একদিকে যেতে বলে অন্যদিকে চলে যেতেন। এবার সরাসরি রোমানদের প্রতিরোধের কথা বলে যুদ্ধের ঘোষণা করলেন। যুদ্ধের অর্থ জোগানের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করলেন। মুসলিমদের মধ্যে দানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। আবু বকর (রা.) তাঁর ঘরের সব কিছু এনে হাজির করলেন। পরিবারের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ছাড়া কিছুই রাখলেন না। ওমর (রা.) তাঁর পুরো সম্পদের অর্ধেক নিয়ে এলেন। উসমান (রা.) পরিমাণে সবচেয়ে বেশি দান করলেন। তাঁর দানে ছিল ৯০০ উট, ১০০ ঘোড়া, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা, ২০০ রৌপ্যমুদ্রা। এভাবে প্রত্যেকেই মনখুলে দান করলেন। এমনকি মহিলারাও তাদের গলার হার, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের দুল, আংটি ইত্যাদি দান করতে কৃপণতা করল না। মুসলিম শিবিরে যুদ্ধের প্রস্তুতির সাড়া পড়ে গেল। তাদের আগ্রহ উদ্দীপনা দেখে মুনাফিকদের গাত্রদাহ হলো। তারা মুমিনদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করল। আল্লাহ তাআলা তাদের জবাবে বলেন, ‘আল্লাহ তাদের প্রতি ঠাট্টা করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৭৯)</p> <p>তাবুক অভিমুখে যাত্রা : ৩০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে নবী (সা.) তাবুক অভিমুখে বের হন। এটা ছিল তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় সেনা অভিযান। সাধ্যমতো দান করলেও বিশাল এই সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য ও পানীয় পর্যাপ্ত ছিল না। তাই পথিমধ্যে খাবারের সংকট ও প্রচণ্ড খরতাপে খাবার পানির অভাব দেখা দেয়। বাহন সংকট থাকা সত্ত্বেও উট নহর করে খাদ্যাভাব পূরণ করতে হয়। গাছের ছাল-পাতা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হয়। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় নিরুপায় হয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে ছুটে আসে মুসলিম সৈন্যরা। তারা পানির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলে। নবী (সা.) আল্লাহর কাছে পানি প্রার্থনা করলে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। সব সৈন্য সেই পানি পান করে এবং পাত্রে সংরক্ষণ করে।</p> <p>যাওয়ার পথে হিজর এলাকা মুসলিম বাহিনীর সামনে পড়ে। এখানে সামুদ জাতি ধ্বংস হয়েছিল। তাদের পাহাড়কাটা ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ পড়েছিল। নবী (সা.) সেখানে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন এবং কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলেন। তাবুক স্থানে মুসলিম বাহিনী পৌঁছার পর রোমকরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা লড়াই করার সাহস হারিয়ে ফেলে। তাদের সীমান্তের বিভিন্ন শহরে বিক্ষিপ্ত হয়ে রণক্ষেত্রে থেকে পলায়ন করে। এভাবে তৎকালীন পরাশক্তি রোম সাম্রাজ্যকে বিনা যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজিত করে।</p> <p>যুদ্ধের প্রভাব : আরব উপদ্বীপে মুসলমানের প্রভাব ও প্রতিপত্তির চূড়ান্ত ধাপ ছিল তাবুক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর স্পষ্ট হয়ে যায় আরব উপদ্বীপে ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের অস্তিত্ব বিলীনের পথে। তাবুক যুদ্ধের পর আরবের পৌত্তলিকসহ মুসলমানের অন্যান্য শত্রুরা সাহস হারিয়ে ফেলে এবং আরবরা সব দ্বিধা ত্যাগ করে দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে।</p> <p> </p> <p><strong>স্পেন</strong> <strong>বিজয়</strong></p> <p>ইসলামের ইতিহাসে স্পেন বিজয় একটি উজ্জ্বল ও গৌরবময় অধ্যায়। ৯২ হিজরির ২৮ রমজান মোতাবেক ৭১১ সালে স্পেন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উমাইয়া শাসনামলে মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশে এবং তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে হিস্পানিয়া অঞ্চলের ভিজিগথ রাজ্যের পতন হয়। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকা ছাড়িয়ে ইউরোপে ইসলামের বিজয়কেতন উড্ডীন হয়। এর পর থেকে প্রায় আট শ বছর স্পেনে মুসলিম শাসন অব্যাহত থাকে।</p> <p>পটভূমি : ৮৯ হিজরিতে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক মুসা বিন নুসাইরকে ইফরিকিয়ার গভর্নর পদে নিযুক্ত করেন। বর্তমান মরক্কো, লিবিয়া, আলজেরিয়া ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তৎকালীন ইফরিকিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্পূর্ণ ইফরিকিয়া মুসলিমদের শাসনাধীন হওয়ার পর তিনি আইবেরীয় উপদ্বীপে ইসলাম প্রসারের মনস্থ করেন। তখন আইবেরীয় উপদ্বীপ ভিজিগথ রাজা শাসন করত। এই উপদ্বীপে আনদুলুস নামে একটি অঞ্চল ছিল। বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল সেই আনদুলুসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন তানজাহ অঞ্চলের গভর্নর ইউলিয়ান মুসলিমদের আনদুলুস আক্রমণের জন্য আহ্বান করে। কারণ আনদুলুসের রাজা রডারিক কর্তৃক তার কন্যা শ্লীলতাহানির শিকার হয়।</p> <p>পর্যবেক্ষক বাহিনী প্রেরণ : ৯১ হিজরিতে মুসা বিন নুসাইর ৪০০ সৈন্য এবং ১০০ ঘোড়া দিয়ে তারিফ বিন মালিককে আনদুলুস পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি আনদুলুসের বিপরীতে খাদরা দ্বীপে অবতরণ করেন। সেখানে দ্বীপবাসীর সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়। তিনি তাদের পরাজিত করে দ্বীপটি ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর আনদুলুস পর্যবেক্ষণ করে মুসা বিন নুসাইরের কাছে ফিরে আসেন এবং যুদ্ধের জন্য অনুকূল পরিস্থিতির সংবাদ দেন।</p> <p>আনদুলুস অভিমুখে যাত্রা : ৯২ হিজরির রজব মাসে তারিক বিন জিয়াদ আনদুলুস অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। তার সঙ্গে ছিল সাত হাজার বারবার সৈন্য এবং ৩০০ আরব সৈন্যে। পথিমধ্যে শত্রুপক্ষের এক লাখ সেনার বিশাল বাহিনীর সংবাদ পেয়ে তিনি আরো সৈন্যের আবেদন করেন। মুসা বিন নুসাইর পাঁচ হাজার আরব সৈন্য পাঠিয়ে দেন। মোট ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে তারিক আনদুলুস অভিযান পরিচালনা করেন। কথিত আছে, সমুদ্র পার হওয়ার পর তিনি জাহাজগুলো জ্বালিয়ে দেন এবং সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে লোকেরা, তোমরা কোথায় পালাবে? তোমাদের পিছনে সমুদ্র আর সামনে শত্রু। আল্লাহর কসম! সততা এবং ধৈর্য ছাড়া তোমাদের কোনো সম্বল নেয়। শত্রুপক্ষ তোমাদের থেকে বেশি অস্ত্র ও সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের মোকাবেলার জন্য তোমাদের তরবারি ছাড়া কোনো অস্ত্র নেই।’ তার এই ভাষণে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে নতুন শক্তি সঞ্চার হয়। তিনি সেনাদলকে সঙ্গে নিয়ে একটি পাহাড়ে অবস্থান নেন। ইতিহাসে এটি জাবালে তারিক বা তারিকের পাহাড় নামে পরিচিত। যার বর্তমান নাম জিব্রাল্টার। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী খ্রিস্টানদের পরাজিত করে। রাজা রডারিক পালাতে গিয়ে নদীতে ডুবে নিহত হয়।</p> <p>স্পেন জয়ের প্রভাব : স্পেন জয়ের মাধ্যমে ইউরোপের মাটিতে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয় এবং ইউরোপ ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়; বরং ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানে নতুন যুগের সূচনা হয়। স্পেন বিজয়ের পর ইউরোপের মাটিতে বিজয় অভিযানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা না গেলেও ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে তা গভীর প্রভাব ফেলে যায়।</p> <p> </p> <p><strong>আইনে</strong> <strong>জালুতের</strong> <strong>যুদ্ধ</strong></p> <p>ফিলিস্তিনের উত্তরে বাইসান এবং দক্ষিণে নাবলুস শহর। এই দুটি শহরের মধ্যে আইন জালুত প্রান্তর অবস্থিত। এই প্রান্তরে ৬৫৮ হিজরির ২৫ রমজান মোতাবেক ১২৬০ সালে মামলুক এবং মোঙ্গলদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে এটি আইনে জালুত যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে মোঙ্গলদের পরাজয়ের কারণে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের গতি থেমে যায় এবং বহু জাতি ও রাষ্ট্র পতনের হাত থেকে রক্ষা পায়।</p> <p>পটভূমি : মানব ইতিহাসে চেঙ্গিস খান এক ত্রাসের নাম। সে যেদিকেই গিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ৬০৩ হিজরি মোতাবেক ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। এর ২১ বছর পর ১২২৭ সালে এই রক্তপিপাসু যোদ্ধার মৃত্যু হয়। এরপর ১২৫১ সালে মংকে খান মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে হালাকু খানকে পারস্য দেশগুলো করায়ত্ত করার দায়িত্ব দেয়। সে পাঁচ বছর প্রস্তুতি নেওয়ার পর বিভিন্ন অভিযান শুরু করে। ১২৫৮ সালে বাগদাদ শহর দখল করে আব্বাসীয় খেলাফত ধ্বংস করে। ১২৬০ সালে দামেস্ক জয় করে আইয়ুবীয়দের পতন ঘটায়। এরপর সে মিসরের দিকে এগিয়ে যায়।</p> <p> মিসরের অবস্থা : তখন মিসরের ক্ষমতা দখলের জন্য বাহরি মামলুক এবং মাজি মামলুকের মধ্যে চরম বিবাদ চলছিল। বাহরি মামলুকরা শাজার আদ-দুরারকে আর মাজি মামলুকরা সাইফুদ্দিন কুতুজকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। এই পরিস্থিতির মধ্যেই সাইফুদ্দিন কুতুজ সবাইকে ডেকে বলেন, শত্রুপক্ষ আমাদের সীমান্ত এলাকায় আর আমরা অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আগে তাতারদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন একজন শাসকের দক্ষ নেতৃত্ব। শত্রুদের পরাস্ত করতে পারলে পছন্দমতো কাউকে ক্ষমতায় বসানো যাবে। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে সবাই একমত হয় এবং তার নেতৃত্বে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এরই মধ্যে দূত মারফত হালাকু খান সুলতান কুতুজকে আত্মসমর্পণ নতুবা যুদ্ধের হুমকি দেয়। সুলতান তার জবাবে দূতদের হত্যা করেন এবং তাদের কর্তিত মাথা কায়রোর জুলাইলা নামক প্রবেশদ্বারে ঝুলিয়ে রাখেন। ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।</p> <p>আইনে জালুতে অভিযান : এরই মধ্যে হালাকু খান তার সেনাপতি কিতবুকাকে দায়িত্ব দিয়ে পারস্যে চলে যায়। এই সুযোগে সুলতান কুতুজ বিশাল একটি বাহিনী নিয়ে ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সুলতান তাঁর বাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। একটি অংশ সেনাপতি বাইবারসের নেতৃত্বে আগে পাঠান আর তিনি মূল বাহিনী নিয়ে পেছনে থাকেন। সেনাপতির দলটি গাজায় পৌঁছে মোঙ্গলদের ক্ষুদ্র একটি দলের সম্মুখীন হয়। সেখানে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হলে মোঙ্গলরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর মুসলিম বাহিনী আক্কায় পৌঁছে খ্রিস্টানদের সঙ্গে যুদ্ধ না করার শর্তে চুক্তিবদ্ধ হয়। এদিকে সেনাপতি কিতবুকা জর্দান নদী পার হয়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। মুসলিম বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে আইন জালুত প্রান্তরে অবস্থান নেয়। সেনাপতি বাইবারস ময়দানে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয় আর সুলতান কুতুজ পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। মোঙ্গলরা বাইবারসের ক্ষুদ্র দলের ওপর আক্রমণ করে। মুসলিমরা রণকৌশল হিসেবে পিছু হটতে থাকে আর মোঙ্গলরা তাদের পিছু ধাওয়া করে। তখন সুলতান কুতুজ পাহাড় থেকে বের হয়ে মোঙ্গলদের ঘিরে ফেলে। ফলে মোঙ্গলরা আর সুবিধা করতে পারে না। এই যুদ্ধে সেনাপতি কিতবুকাসহ প্রায় ১০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। এভাবে মোঙ্গলদের পতন হয়।</p> <p>যুদ্ধের প্রভাব : এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের পর মোঙ্গলরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে বিশ্ব এক ভয়াবহ যুদ্ধবাজ জাতির আগ্রাসন থেকে রেহাই পায় এবং বহু প্রাণ ও জনপদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।</p> <p> </p> <p><strong>তথ্যসূত্র</strong></p> <p>১. সহিহ বুখারি, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (রহ.)</p> <p>২. আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ইবনু হিশাম </p> <p>৩. আর-রাহীকুল মাখতূম, সফিউর রহমান মুবারাকপুরী </p> <p>৪. তারিখু ইবনি খলদূন, ইবনু খলদূন</p> <p>৫. তারিখুল আনদুলূস, ইসমাঈল ইবনে আমিরুল মুুমিনিন</p> <p>৬. আইনু জালুত বি-কিয়াদাতিল মালিক আল মুযাফফার কুত্জ, ড. শাওকি আবু খলিল</p> <p>৭. কিসসাতুত তাতার মিনাল বিদায়া হাত্তা আইনু জালুত, ড. রাগিব আস-সারজানি</p> <p>৮. নাফহুত তায়্যিব মিন গুসনিল আনদুলুুসির রাতিব, আহমাদ</p> <p>মুহাম্মাদ আল-মাক্কারি</p> <p> </p>