<p>মসজিদ মুসলমানদের ইবাদতগার এবং মানসিক প্রশান্তির অত্যন্ত পবিত্র স্থান। একজন মুসলমানের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে মসজিদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বেশির ভাগ মুসলমান প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামায়াতের সঙ্গে আদায় করেন। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মসজিদ দেখতে পাওয়া যায় না। মুসলিম দেশ তো বটেই, অমুসলিম দেশেও মসজিদের অভাব নেই। লাখ লাখ মসজিদের মিনার থেকে প্রতিদিন উচ্চারিত হয় আজানের সুমধুর ধ্বনি। মসজিদগুলোর মধ্যে কতগুলো সাধারণ মিল থাকলেও দেশ, পরিবেশ ও জনসংখ্যাভেদে মসজিদের আকার, আকৃতি, গঠনপ্রণালী, শৈল্পিক ও স্থাপত্যকলায় পরিলক্ষিত হয় নানা বৈচিত্র্য। আধুনিক যুগে মসজিদ নির্মাণের বেলায় আরো কতগুলো জরুরি বিষয় সামনে এসেছে। সময়ের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে এর ব্যবস্থাপনা, ব্যয় নির্বাহে আসছে আধুনিকতা। বিশেষ করে প্রকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা বিবেচনায় রেখে এখন ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি হচ্ছে মসজিদ।</p> <p>আধুনিক বিশ্ব ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের ভারে বিপর্যস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে বেড়েছে দূষণ ও বংশগত পরিবর্তন। বৃদ্ধি পেয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। ফলে পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে অগণিত মানুষ, প্রাণী জাতি ও উদ্ভিদ। গ্রিন হাউস অ্যাফেক্টের কারণে মানবসভ্যতা একটি চরম অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস’ ঘোষিত রিপোর্টে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অধঃপতনকে বড় বিপর্যয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ৮২ শতাংশ বন্য জীবজীবন এবং ৫০ শতাংশ উদ্ভিদ এরই মধ্যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। ১৮৫২ এবং ১৯৪৭ সালের সময়কালে দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক বন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এই ভয়ংকর চিত্র মানবতাকে ভাবিয়ে তুলেছে।</p> <p>ফলে পৃথিবীর দেশে দেশে পরিবেশবাদী মানুষ, চিন্তাশীল বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা পরিবেশ সংকট নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাচ্ছেন এবং এই সংকট উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনের নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশ দূষণের করালগ্রাস থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য দেশে দেশে বনায়ন ও সবুজায়নসহ কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য চলছে নানা উদ্যোগ। তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব মিল-কারখানা, অফিস-বাড়ি। পণ্যসামগ্রীর মোড়ক পরিবেশসহনীয় করার জন্যও নেওয়া হচ্ছে কৌশল। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই অনেক দেশ পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে। </p> <p>‘পরিবেশবান্ধব’ কথাটি দ্বারা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন অবস্থাকে বোঝায়। অতএব, পরিবেশবান্ধব মসজিদের অবকাঠামো এবং গঠনপ্রণালী এমন হবে, যা মুসল্লিদের সর্বোচ্চ পরিবেশগত উপকার সাধনে সক্ষম।</p> <p>পরিবেশবান্ধব ধারণার বাস্তব প্রয়োগ হলো, কার্যক্ষেত্রে স্বল্প পরিমাণ শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা, শক্তির অপচয় রোধ করা, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপন্ন, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা, সবুজ বনায়ন এবং পানির পুনঃব্যবহারের কৌশল অবলম্বন করা। অর্থাৎ প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যয় (তাবজির) ও অপচয় (ইসরাফ) রোধ করে কম সম্পদে সর্বোচ্চ উপকার আদায় নিশ্চিত করা। ইসলাম পনেরো শ বছর আগেই অপচয় (ইসরাফ) ও অপব্যয় রোধ করার বিধান চালু করেছে এবং সাহাবিরা এর বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্য করে না, বরং তারা আছে এই দুইয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ৬৭)</p> <p>সুরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এবং আহার করবে ও পান করবে। কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’</p> <p>সুরা বনি ইসরাঈলের ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই।’</p> <p>আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।’ তিনি আরো বলেন, ‘এমনকি তোমরা বড় একটি বহমান নদীর তীরে বসে অজু করলেও পানির অপচয় করবে না।’ (তিরমিজি)</p> <p>অতএব, মহান আল্লাহ এবং ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) পানি, বাতাস, সূর্যের আলোসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সতর্কভাবে ব্যবহার করা এবং এগুলোর অপব্যয় এবং অপচয় রোধ করার তাগিদ দিয়েছেন। আর এই মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। পরিবেশবান্ধব মসজিদের ধারণা নতুন কিছু নয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) নির্মিত মদিনার মসজিদে নববী পরিবেশবান্ধব মসজিদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশ পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে পরিবেশবান্ধব মসজিদের ধারণা এবং ইতিহাসের ওপর কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।</p> <p> </p> <p><strong>কোবা</strong> <strong>মসজিদ</strong><strong>, </strong><strong>মদিনা</strong></p> <p>মহানবী মুহাম্মদ (সা.) নির্মিত ইসলামের প্রথম মসজিদ এটি। মদিনা শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কোবা গ্রামে এই মসজিদ নির্মিত হয় ৬২২ সালে (প্রথম হিজরি সালে)। এটি সৌদি আরবের মদিনায় নির্মিত প্রথম পরিবেশবান্ধব মসজিদ। কোবা মসজিদের দেয়াল মাটির ইট এবং খেজুরগাছের গুঁড়ির সংমিশ্রণে নির্মিত। খেজুরপাতার সঙ্গে মাটি মিশিয়ে এর ছাদ নির্মাণ করা হয়। পরে এই মসজিদ ভেঙে ফেলা হয় এবং নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন সময় ইসলামের খলিফারা কয়েকবার কোবা মসজিদের সংস্কার সাধন করেন। প্রথম সংস্কার করেন তৃতীয় খলিফা উসমান বিন আফফান (রা.)। এরপর খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজ মসজিদে প্রথম মিনার নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে ৪৩৫ হিজরি সালে আবু ইয়াল হোসাইনি মসজিদটি সংস্কার করেন এবং তিনি মসজিদে ‘মিহরাব’ স্থাপন করেন। তারপর বহুবার কোবা মসজিদের সংস্কার সাধন করা হয়। সর্বশেষ কোবা মসজিদ সংস্কার করা হয় ১৯৮৪ সালে। তখন এটিতে সাতটি প্রধান প্রবেশদ্বার, চারটি সমান্তরাল মিনার এবং ৫৬টি ছোট ছোট গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদের মর্যাদা সম্পর্কে স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই যে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর প্রথম দিন থেকে তা বেশি হকদার যে তুমি সেখানে সালাত কায়েম করতে দাঁড়াবে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০৮)</p> <p>উল্লেখ্য, আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রতি শনিবার হেঁটে অথবা উটে সওয়ার হয়ে কোবা মসজিদে যেতেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। তিনি অন্যদেরও এটা করার উপদেশ দেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রথম জুমার নামাজ কোবা মসজিদেই পড়েছিলেন।  </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/05.May/04-05-2020/1/2_kalerkantho-2020-4-pic-5.jpg" style="margin:12px; opacity:0.9" /></p> <p><strong>খলিফা</strong> <strong>আল</strong><strong>-</strong><strong>তাজির</strong> <strong>মসজিদ</strong><strong>, </strong><strong>দুবাই</strong>  </p> <p>এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দেইরাতে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম পরিবেশবান্ধব মসজিদ। দুবাইয়ের বন্দর সাঈদ এলাকায় স্থাপিত এই মসজিদ ২০১৪ সালে খুলে দেওয়া হয়। খলিফা আল তাজির এই মসজিদ নির্মাণের জন্য ২০ মিলিয়ন দিনার দান করেন। তাঁর নামানুসারেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়। ৪৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মিত এই মসজিদে তিন হাজার ৫০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। দ্বিতলবিশিষ্ট মসজিদটিতে নারীদেরসহ তিনটি নামাজের হল আছে। এখানে ৬০০ নারী একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। তা ছাড়া মসজিদ এলাকায় ইমাম, মুয়াজ্জিন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আলাদা আবাসন ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মসজিদের বাইরে বিশাল কার পার্কিং ও উন্মুক্ত সবুজ চত্বর মসজিদের শোভাকে বৃদ্ধি করেছে। আল তাজির মসজিদের দুটি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ২৫ মিটার। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহার যথাক্রমে ২০ ও ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়েছে। এ জন্য মসজিদে লাগানো হয়েছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এলইডি বাতি ও সোলার প্যানেল। দিনে স্বাভাবিক আলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য মসজিদের সব জায়গায় ‘ডেলাইট সেন্সর’ বসানো হয়েছে। সব মিলে এটি একটি সর্বাধুনিক আদর্শ মসজিদ।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/05.May/04-05-2020/2/11_kalerkantho-2020-4-pic-5.jpg" style="height:483px; margin:12px; width:800px" /></p> <p><strong>মসজিদ</strong> <strong>আল</strong><strong>-</strong><strong>জিকরা</strong><strong>, </strong><strong>ইন্দোনেশিয়া</strong> </p> <p>ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভা প্রদেশের পাহাড়ি শহর সেনটুলে আল-জিকরা মসজিদ অবস্থিত। এই মসজিদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, পানি সংরক্ষণ, নির্মাণসামগ্রী, ভবনের অভ্যন্তরস্থ স্বাস্থ্য পরিবেশ সবই পরিবেশবান্ধব কৌশলে স্থাপিত হয়েছে। মসজিদটির উচ্চতা ও বায়ুচলাচল ব্যবস্থার কারণে সতেজ বায়ু সহজে ভেতরে প্রবেশ করে এবং আলো ও শীতাতপের জন্য বিদ্যুৎ খরচ কম হয়। মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পানির পুনর্ব্যবহারোপযোগী ব্যবস্থা। এতে পানির অপচয় যেমন কমেছে, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারও হ্রাস পেয়েছে। মসজিদের বাইরে ৪০ শতাংশ এলাকা উন্মুক্ত এবং সবুজ ঘাসে ঢাকা। এতে মসজিদের শোভা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি পরিবেশ দূষণ কমেছে অনেকাংশে। পরিবেশবান্ধব এই মসজিদের উদ্যোক্তা হাইউ প্রাভোউ। মসজিদটি নির্মাণের পর ২০১৭ সালে খুলে দেওয়া হয়। এর উদ্বোধনকালে ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট দেশে ২০২০ সালের মধ্যে আরো এক হাজার পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/05.May/04-05-2020/1/5_kalerkantho-2020-4-pic-5.jpg" style="height:483px; margin:12px; opacity:0.9; width:800px" /></p> <p><strong>ডিজনি</strong> <strong>বড়</strong> <strong>মসজিদ</strong><strong>, </strong><strong>মালি</strong></p> <p>মালির ডিজনি মসজিদ আফ্রিকার একটি বিস্ময়। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বৃহত্তম মাটির তৈরি মসজিদ।  মসজিদটি মাটি ও গাছের ডাল দিয়ে নির্মিত। এটি হাতে তৈরি মাটির মসজিদ হওয়ায় পরিবেশ দূষণের পরিমাণ এখানে প্রায় শূন্য। স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত ১০ ফুট উচ্চতার এই মসজিদের ভিত্তি মাটির তৈরি। মসজিদের দেয়াল মাটি, বালু, ধানের তুষ এবং পানির মিশ্রণে তৈরি ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর এতে সেঁটে দেওয়া হয়েছে কাঠ। মসজিদে তিনটি মিনার আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ডিজনি বড় মসজিদটি তিনবারে নির্মিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। ডিজনির ২৬তম মুসলিম শাসক কওই কুনবরো ১৩ শতকে প্রথমবার এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি একটি নদীর তীরে অবস্থিত। ষোলো শতকে এক প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ডিজনি শহরসহ বড় মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। তখন মসজিদটি দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্নির্মাণ করা হয়। তৃতীয়বার বর্তমান মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৭ সালে।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/05.May/04-05-2020/1/3_kalerkantho-2020-4-pic-5.jpg" style="height:483px; margin:12px; opacity:0.9; width:800px" /></p> <p><strong>রাজা</strong> <strong>ফয়সালবিল্লাহ</strong> <strong>মসজিদ</strong></p> <p>মালয়েশিয়ার এই মসজিদ সাবেক ক্রাউন প্রিন্স হাজি ফয়সালবিল্লাহর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।</p> <p>মালয়েশিয়ার সিলানগার সাইবারজয়া এলাকায় ১০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মালয়েশিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্থাপিত হয়েছে রাজা ফয়সালবিল্লাহ সাইবারজয়া মসজিদ। অত্যাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব এই মসজিদ ১১ হাজার ১৬৮ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতল এই মসজিদে আট হাজার ৩০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। ২০১৫ সালে মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয়। মসজিদের নামাজের প্রধান স্থান বরাবর নির্মিত গম্বুজটি দুই স্তরবিশিষ্ট গ্লাসের প্যানেল দিয়ে তৈরি। ফলে দিনের আলো সহজেই মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে। এতে দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর প্রয়োজন হয় না। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য মসজিদে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। মসজিদের ছাদও এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে তা তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং মসজিদের ভেতর ঠাণ্ডা থাকে। ফলে বিদ্যুতের ব্যবহারও এতে অনেকটা কমেছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য লাগানো হয়েছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এলইডি বাতি। পানির চাহিদা মেটানোর জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং তা পুনর্ব্যবহারের প্রযুক্তি মসজিদে স্থাপন করা হয়েছে। মসজিদে প্রাকৃতিকভাবে বায়ু চলাচলব্যবস্থাকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে বৈদ্যুতিক পাখা এবং শীতাতপ মেশিনের খুব একটা প্রয়োজন না পড়ে। আধুনিকতার ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে বসানো আছে ‘লাইট সেন্সর’। ফলে প্রয়োজন ছাড়া বাতিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বয়স্ক মুসল্লিদের ব্যবহারের জন্য মসজিদে একটি অ্যালাভেটর স্থাপন করা হয়েছে। আর অক্ষম শিশুদের জন্য রয়েছে খেলার মাঠ।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/05.May/04-05-2020/2/12.jpg" style="height:483px; margin:12px; width:800px" /><strong>কেমব্রিজ</strong> <strong>কেন্দ্রীয়</strong> <strong>মসজিদ</strong></p> <p>এটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় পরিবেশবান্ধব মসজিদ। কেমব্রিজ শহরের রোমসি এলাকার মিল রোডে স্থাপিত এই মসজিদ ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের লেকচারার ড. টিমোথি উন্টার ২০০৮ সালে এই মসজিদ প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এর জন্য তহবিল জোগাড় করার চেষ্টা চালান। ২০০৯ সালে চার মিলিয়ন ইউরো খরচ করে মসজিদের জন্য এক একর জায়গা ক্রয় করা হয়।</p> <p>স্থাপত্য প্রকৌশলী মার্কস বারফিল্ড, প্রফেসর কেইথ ক্রিটিচলো এবং প্রখ্যাত ইসলামিক গার্ডেন ডিজাইনার ইমমা ক্লার্ক মিলে মসজিদের ডিজাইন তৈরি করেন। অপূর্ব সুন্দর এই মসজিদে এক হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। তা ছাড়া মসজিদে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের জন্য আলাদা একটি জায়গা আছে। রয়েছে শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা। মসজিদে স্থাপন করা হয়েছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এবং অন্যান্য শক্তি ক্ষয়রোধক ব্যবস্থা। এলইডি বাতিসহ মসজিদের ছাদে বৃষ্টির পানির জলাধার এবং পানির পুনর্ব্যবহারোপযোগী প্রযুক্তিও এতে সংযুক্ত হয়েছে। এর অনবদ্য নির্মাণশৈলীর কারণে বছরজুড়ে সূর্যের আলো মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। সব মিলিয়ে এটি ইউরোপের একটি বিরল পরিবেশবান্ধব মসজিদ। প্রতিনিয়ত অনেক পর্যটক এই অসাধারণ মসজিদটি দেখার জন্য ভিড় করেন।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/05.May/04-05-2020/2/13_kalerkantho-2020-4-pic-5.jpg" style="margin:12px" /></p> <p><strong>দ্বিতীয়</strong> <strong>হাসান</strong> <strong>মসজিদ</strong></p> <p>দ্বিতীয় হাসান মসজিদ মরক্কোর কাসাব্লাংকায় অবস্থিত। এটি আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম মসজিদ। আটলান্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত হাসান মসজিদটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যার একটি অংশ রয়েছে সাগরের পানির ওপর। ফলে মুসল্লিরা নামাজ যেমন পড়তে পারেন, তেমনি ইচ্ছা হলে অনায়াসে আটলান্টিকের অপরূপ শোভা উপভোগ করতে পারেন। মসজিদটি ২২ একর জমির ওপর স্থাপিত হয়েছে। সাগরের ঢেউ যাতে মসজিদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। রাজা দ্বিতীয় হাসানের উদ্যোগে মসজিদটির কাজ শুরু হয় ১৯৮৬ সালের ১২ জুলাই। দিন-রাত দুই হাজার ৫০০ শ্রমিক সাত বছর ধরে মসজিদ নির্মাণের কাজ করেন। অবশেষে মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৯৩ সালে। এর বাইরে এই বিশাল মসজিদ নির্মাণ এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কাজ করে ১০ হাজার শিল্পী ও কারিগর। মসজিদের স্থপতি ছিলেন ফরাসি স্থাপত্যবিদ মাইকেল পিনসাউ। দ্বিতীয় হাসান মসজিদ নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৫৮৫ মিলিয়ন ইউরো। বিভিন্ন ব্যক্তি ও পেশার ১২ মিলিয়ন মানুষ এই মহৎ কাজে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। এঁদের প্রত্যেককে রসিদ ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। এরপরও এই বিশাল কাজের ব্যয়ভার বহন করতে এগিয়ে আসে কুয়েত ও সৌদি আরব। মূল মসজিদটি লম্বায় ৬৬০ ফুট এবং প্রস্থে ৩৩০ ফুট। এর মিনারের উচ্চতা ৬৮৯ ফুট, যা বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ। দ্বিতীয় হাসান মসজিদের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এখানে আরো বেশ কয়েকটি স্থাপনা যুক্ত করা হয়েছে। ৫২ হাজার ১০০ বর্গফুট এলাকাজুড়ে একটি অত্যাধুনিক মাদরাসা নির্মাণ করা হয়েছে। আছে একটি অনবদ্য মিউজিয়াম, যাতে মরক্কোর দীর্ঘ ইতিহাস পরস্ফুিটিত হয়েছে। রয়েছে একটি বিশাল লাইব্রেরি, যেটিকে ইসলামী বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরি হিসেবে গণ্য করা হয়। মসজিদ চত্বরে পারিবারিক বনভোজন করার জন্য উপযুক্ত স্থাপনাসহ ৪১টি ঝরনা নির্মাণ করা হয়েছে, যা গোটা পরিবেশকে আরো নয়নাভিরাম করে তুলেছে। দ্বিতীয় হাসান মসজিদের মুসল্লি ধারণক্ষমতা এক লাখ পাঁচ হাজার। মসজিদের ভেতরের অংশে ২৫ হাজার এবং বাইরের অংশে ৮০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। মরক্কোর দ্বিতীয় হাসান মসজিদ বিশ্বের পরিবেশবান্ধব মসজিদগুলোর অন্যতম। মসজিদের বিদ্যুৎ, পানি সংরক্ষণ, অজু এবং বায়ু চলাচলব্যবস্থা দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। মসজিদের ছাদে বৃষ্টির পানির জন্য জলাধার বানানো হয়েছে এবং পানি পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থাও রয়েছে। গরমের দিনে বড় বড় জানালা দিয়ে সাগরের নির্মল বাতাস সহজে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে বিদ্যুৎ খরচও খুব কম হয়। সাগরের তীরে মসজিদটির অবস্থানের কারণে এই সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে। মরক্কো সরকার এই মসজিদ ছাড়াও দেশে ছোট-বড় আরো ৬০০ মসজিদকে পরিবেশবান্ধবরূপে রূপান্তরিত করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।</p> <p> </p> <p><strong>পরিশেষে</strong></p> <p>মসজিদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মুসল্লিরা দিন ও রাতে অন্তত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা মসজিদে নামাজ ও জিকির-আজকারে সময় কাটান। কেউ কেউ আরো বেশি সময় নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতে মসজিদে অবস্থান করেন। নিবিড় ও একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করার সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদ। তাই এর পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা হওয়া চাই সবচেয়ে বেশি উন্নত এবং অবশ্যই পরিবেশবান্ধব। এখানে হাজার হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়েন। ফলে মসজিদে দরকার হয় প্রচুর পানি, বিদ্যুৎ এবং যথেষ্ট শব্দসঞ্চালন ব্যবস্থা। বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে ইমামের খুতবা, কোরআন তিলাওয়াত পৌঁছানোর জন্য উন্নত শব্দসঞ্চালন ব্যবস্থা খুবই জরুরি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অজু ইবাদতের অত্যাবশ্যকীয় অংশ। মসজিদে বিপুলসংখ্যক মুসল্লির অজুর জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। তাই মসজিদ এমনভাবে তৈরি করা হবে, যেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায় এবং অজুর পানি পুনর্ব্যবহার করে অন্যান্য কাজে লাগানো যায়। কেননা, বিশুদ্ধ পানির অভাব বর্তমান পৃথিবীর একটি প্রকট সংকটে পরিণত হয়েছে। পানি আল্লাহর একটি বড় নিয়ামত। তাই পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং এর অপচয় রোধ করা খুবই প্রয়োজন। আল্লাহ পানিকে তাঁর একটি নিয়ামত বলে ঘোষণা করেছেন। সুরা ওয়াকিয়ার ৬৮ ও ৬৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যে পানি পান করো সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? বৃষ্টিভরা মেঘ থেকে তোমরা কি তা বর্ষণ করো, না আমি বৃষ্টি বর্ষণকারী?’</p> <p>সুরা ক্বাফের ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি আসমান থেকে বরকতময় পানি নাজিল করেছি। অতঃপর তা দ্বারা আমি উৎপন্ন করি বাগ-বাগিচা ও কর্তনযোগ্য শস্যদানা।’</p> <p>পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানবজীবনে পানির গুরুত্ব ও অবদান সম্পর্কে মহান আল্লাহ জোর দিয়েছেন। তাই মসজিদে পানির অপচয় রোধে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থার প্রবর্তন করা খুবই জরুরি। অজুর পানি ব্যবহারের পর এই পানি আমরা মসজিদ এলাকার বাগানের গাছপালার পরিচর্যায় ব্যবহার করতে পারি। তাই পরিবেশবান্ধব মসজিদের অন্যতম একটি উপাদান হলো বাগান। বাগানের গাছপালা ছায়া দিয়ে পরিবেশকে শুধু শীতলই রাখে না, শরীর সুস্থ রাখার জন্য প্রচুর অক্সিজেনও সরবরাহ করে। বাগানের গাছে পাখি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ আশ্রয় তৈরি করে। তাই বাগান নির্মল পরিবেশের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য ধারণ করার উদ্দেশ্যে বাগানের বিশেষত্ব রয়েছে। বাগান সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা তাওবার ৭২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও নারীদের জান্নাতের (বাগান) ওয়াদা দিয়েছেন, যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, তাতে তারা চিরদিন থাকবে।’</p> <p>সুরা আন-নিসার ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে (বাগান), যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ।’ আল্লাহর রাসুল (সা.)ও বিষয়টির প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি গাছ লাগায়, তাতে ফল ধরে এবং এই ফল কোনো মানুষ বা পাখি খায়, তা হলে এটি তার জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (সহিহ বুখারি)। এসব কারণে পরিবেশবান্ধব মসজিদের ধারণা এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। পরিবেশবান্ধব মসজিদগুলোতে প্রাকৃতিক আলো ও বায়ু চলাচলব্যবস্থা থাকায় শীতাতপ, পাখা ও আলোর বাতির প্রয়োজন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। মসজিদে স্থাপিত সোলার ব্যবস্থার ফলে বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণের যে সংকট চলছে পরিবেশবান্ধব মসজিদগুলো সেখানে দর্শনীয় অবদান রাখছে। </p> <p>লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক</p>