<p>প্রকৃতিগতভাবেই এ দেশের মানুষ ভাবুক, সংস্কৃতিমনা ও শিল্পরসিক। এ দেশের নিসর্গ সৌন্দর্য যেমন সবার স্বচ্ছ মনকে আকর্ষণ করে, তেমন প্রকৃতিনির্ভর কালি-তুলির আঁচড়ও সবাইকে আকৃষ্ট করে। তাইতো অনেকে ঘরের নান্দনিক শোভা বর্ধনের জন্য সৃজনশীল কর্ম, চিত্রকলা, পশু-পাখি ও মানুষের চিত্র দিয়ে সাজান নিজের রুম। বেডরুমের মাথার ওপর শোভা পায় নিসর্গ প্রকৃতির অনিন্দ্য পেইন্টিং।</p> <p>ভাষা সৃষ্টির আগে মানুষ মনের ভাব অপরকে জানাত ছবি এঁকে। তাই একে আদিকালের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর অনেকটাই লেখা হয়েছে আদিম ভাস্কর্য, শিলালিপি, স্থাপত্য আর গুহাচিত্রকে কেন্দ্র করে। প্রাচীনকালে ফুল, পাতা ও বিভিন্ন নকশার ওপর রং ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে উঠেছিল ইসলামী চিত্রকলা। ইসলামী জীবনাদর্শকে সঙ্গী করে ২০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে এসব চিত্রকলার ভিত্তি রচিত হয়েছিল।</p> <p>উপমহাদেশে মুসলিম শাসন শুরুর পর এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ইমারত পাওয়া যাবে না, যেখানে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার হয়নি। এর মধ্যে অসামান্য অবদান ছিল তুর্কি ও আফগান শাসকদের। ১২০৫ সালে তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে শিলালিপিতে আরবি ও ফারসি ক্যালিগ্রাফির যাত্রা শুরু হয়। সুলতানি ও মোগল আমলের ১২০৫ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৪০০ চিত্রকলার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব শিলালিপি মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ, মাজার, কবরস্থান, প্রশাসনিক ইমারত ইত্যাদিতে স্থাপন করা হয়েছে। এর বেশির ভাগ নকশাচিত্রে কোরআন-হাদিসের বাণী, সমকালীন বিষয়, স্থাপনের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা সে সময়ের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা করা যায়।</p> <p>মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমান্বয়ে পারস্য, মেসোপটেমিয়া, মিসর, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন প্রভৃতি দেশে ইসলামী চিত্রকলা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে উত্তর ভারতে ইসলামের প্রথম আবির্ভাবের পর এ অঞ্চলের শিল্প ও সংস্কৃতি ইসলামের প্রভাবে বদলে যেতে থাকে। তখন স্থানীয় সব মসজিদ ও স্থাপত্যগুলোতে ইরানি ধারার ইসলামী চিত্রকলার ছাপ স্পষ্ট হতে থাকে। গুজরাট, বাংলা, কাশ্মীর, পাঞ্জাব ও দক্ষিণাঞ্চলের বহু স্থাপনায় এর সাক্ষ্য বহন করছে। মোগল চিত্রকলার প্রভাবে সতেরো-আঠারো শতক ছিল মুসলিম বাংলার চিত্রকলার উজ্জ্বলতম সময়। এ সময় বাংলার মুসলমান চিত্রশিল্পীরা লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, শাহনামা, আমির হামজা, শহীদে কারবালা, ইউসুফ-জুলেখা ইত্যাদি পুঁথিকে নানা বর্ণে চিত্রিত করেছেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় মোগল চিত্রকলা উচ্চাঙ্গে পৌঁছে। সম্রাট আকবর চিত্রকলার যে ধারা শুরু করেছিলেন, জাহাঙ্গীর তাকে পূর্ণতা দেন। তাঁর সময়ে বিমূর্ত ধারার বদলে চিত্রে বাস্তব ঘটনাবলি গুরুত্ব পেতে থাকে। তার আগে রাজদরবারের দৃশ্য, শিকার ইত্যাদি অঙ্কন হলেও পরবর্তীকালে এসবের পাশাপাশি উৎসব, যুদ্ধের দৃশ্য, মসজিদের নকশা আঁকা শুরু হয়। তখনকার মসজিদগুলোও সুশোভিত হয়েছিল ইসলামী চিত্রকলার মোহনীয় স্পর্শে। বর্তমানে মসজিদের দেয়ালে ও শিলালিপিতে বিচিত্র ধরনের লতা-পাতা ও ফুলের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। আজকাল সারা বিশ্বে মসজিদ নির্মাণে বিভিন্ন নকশা ও বাহারি চিত্রসংবলিত মোজাইক ও টাইলস ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদের গালিচা, কার্পেট, জায়নামাজে ব্যবহার করা হয় নান্দনিক চিত্রকর্ম। ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের নিদর্শন রয়েছে ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে সুলতান নুসরাত শাহ কর্তৃক নির্মিত মসজিদের শিলালিপিতে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বাংলার উত্কীর্ণ লিপির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনাটি হচ্ছে লালমনিরহাটের হারানো মসজিদ ইস্টকলিপি। পোড়ামাটির তৈরি ইটে উত্কীর্ণ করে কালেমা তাইয়েবা এবং ৬৯ হিজরি লেখা হয়েছিল। বর্তমান সময়ের ইরাকের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক ইউসুফ জিন্নুনের মতে, সমুদ্রপথে এ লিপির বাংলায় আগমন এবং উন্নতি সাধনের কারণেই একে ‘খত আল বাহরি’ নাম দেওয়া হয়। ‘খত আল বাহরি’র অর্থ সমুদ্রলিপি।</p> <p>বিভিন্ন যুগে মসজিদের অনেক ছবি আঁকা হয়েছে। অন্য সব মুসলিম দেশের মতো ইরানি শিল্পীরা কাবাঘরের ছবিও এঁকেছেন। শিরাজের ‘আতিক মসজিদ’ ও ‘খোদায়ি খনেহ’ ছবি দুটি জগদ্বিখ্যাত। এসব ছবিতে নকশাচিত্রের পাশাপাশি দেয়াল, সিঁড়ি, গম্বুজ, মিনার ইত্যাদির যে গঠনচিত্র আঁকা হয়েছে, যা সারা পৃথিবীর স্থাপত্যকলা সম্পর্কিত তথ্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করেছে।</p> <p>ইসলামের বিধান মতে, এসব ক্যালিগ্রাফি ও চিত্রকলায় যদি মানুষ বা প্রাণীর ছবি অঙ্কিত না থাকে, তাহলে তা ঘরে টাঙানো জায়েজ। কারণ, ইসলামে প্রাণীর ছবি আঁকা এবং তা ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।</p> <p>একবার আয়েশা (রা.) একটি ছোট ছবি আঁকা বালিশ কিনলেন। ঘরে প্রবেশের সময় তাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দৃষ্টি পড়লে তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন না। আয়েশা (রা.) তাঁর মুখমণ্ডল দেখেই তা বুঝতে পেরে বলেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে তাওবা করছি। আমি কি গুনাহ করেছি? রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ছোট্ট বালিশটি কোথায় পেলে?’ তিনি বলেন, ‘আমি এটা কিনেছি, যাতে আপনি এতে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করতে পারেন।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা এসব ছবি অঙ্কন করেছে, কিয়ামতের মাঠে তাদের আজাব দেওয়া হবে। তাদের বলা হবে, তোমরা যাদের সৃষ্টি করেছিলে তাদের জীবিত করো।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘যে ঘরে ছবি থাকে সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।’ (বুখারি, হাদিস : ২৪১৭)</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘কিয়ামতের মাঠে সেসব লোক সবচেয়ে বেশি আজাব ভোগ করবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৭৫২)</p> <p>আমাশ (রহ.) মুসলিম (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি মাসরুক (রহ.)-এর সঙ্গে ইয়াসার ইবনে নুমাইরের ঘরে ছিলাম। তিনি তাঁর ঘরের মধ্যে প্রাণীর ছবি দেখতে পেয়ে বলেন, আমি আবদুল্লাহর কাছে শুনেছি, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের মধ্যে সে ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা কঠিন শাস্তি দেবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি তৈরি করে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৪২৬)</p> <p>আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে থাকা প্রাণীর ছবি বা ছবিযুক্ত সব জিনিস ধ্বংস করে ফেলতেন।’ (মিশকাত, হাদিস : ৬২৪২)</p> <p>আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) লিখেছেন, ‘প্রাণীর ছবি তৈরি করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। চাই তা সম্মানের জন্য তৈরি করা হোক অথবা অন্য কারণে। কেননা ছবি তৈরির মধ্যে স্রষ্টার সাদৃশ্য রয়েছে।’ (উমদাতুল কারি : ৪৫১)</p> <p>ইমাম নববী (রহ.) তাঁর মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রাণীর ছবি তৈরি করা হারাম। কেননা এতে স্রষ্টার সাদৃশ্য প্রকাশ পায়।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘ছবির মাধ্যমে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে।’ (শরহে নববী)। যেসব ছবি ঘরে রাখা জায়েজ সেগুলো হলো—গাছপালা, চন্দ্র-তারকা, পাহাড়-পর্বত, পাথর, সাগর, নদ-নদী, সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, কাবাঘর, মদিনা শরিফ, বায়তুল মোকাদ্দাস বা যেকোনো মসজিদের মতো পবিত্র স্থানের ছবি।</p> <p>এ ব্যাপারে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যদি তোমাকে ছবি বা মূর্তি বানাতেই হয়, তাহলে কোনো বৃক্ষ বা এমন জিনিসের ছবি আঁকো, যাদের জীবন নেই।’</p> <p>মহান আল্লাহ আমাদের উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন।</p> <p>লেখক : শিক্ষক, জামিয়াতু ইলয়াস আল ইসলামিয়া টঙ্গী, গাজীপুর।</p>