<p>আজকাল স্বামী-স্ত্রী তালাকের বিধান জানা ও তদনুযায়ী আমল করার পরিবর্তে নিজেদের মনে এমন সব ভুল ও বানোয়াট মাসআলা স্থির করে রাখে, যার সঙ্গে শরিয়তের কোনো সম্পর্ক নেই। নিচে কিছু উল্লেখ করা হলো—</p> <p> </p> <p><strong>১. তিন তালাক ছাড়া কি তালাক হয় না?</strong></p> <p>কেউ কেউ মনে করে যে শুধু এক বা দুই তালাক দেওয়ার দ্বারা তালাক হয় না, তালাকের জন্য একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া অপরিহার্য। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তালাকের সঠিক পদ্ধতি হলো—শুধু এক তালাক দেওয়া। পরবর্তী সময় আবারও প্রয়োজন হলে শুধু এক তালাকই দেবে। এর চেয়ে বেশি দেবে না। তিন তালাক দিয়ে ফেললে দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর একই মজলিসে কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া কবিরা গুনাহ। তবে এমনটি করলে তালাক কার্যকর হবে এবং তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে।</p> <p> </p> <p><strong>২. তালাকের সঙ্গে কি ‘বায়েন’ শব্দ ব্যবহার করা জরুরি?</strong></p> <p>অনেকে মনে করে শুধু তালাক বললে তালাক হয় না বরং তালাকের সঙ্গে ‘বায়েন’ শব্দও যোগ করা আবশ্যক। এটিও ভুল ধারণা। শুধু তালাক শব্দ দ্বারাই তালাক হয়ে যায়। ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। উপরন্তু এ শব্দের সংযোজনও নাজায়েজ। তবে কেউ যদি এক তালাক বায়েন বা দুই তালাক বায়েন দেয়, সে মৌখিকভাবে রুজু করার (আবার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার) পথ বন্ধ করে দিল। এখন শুধু একটি পথই খোলা আছে। তাহলো নতুনভাবে শরিয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো। অথচ শুধু তালাক বললে এক তালাক বা দুই তালাক পর্যন্ত মৌখিক রুজুর পথ খোলা থাকে।</p> <p> </p> <p><strong>৩. তালাক পতিত হওয়ার জন্য কি সাক্ষীর উপস্থিতি জরুরি?</strong></p> <p>অনেকের ধারণা, স্বামী তালাকের সময় কোনো সাক্ষী না রাখলে তালাক পতিত হয় না। এটাও মনগড়া মাসআলা। সাক্ষীর প্রয়োজন হয় বিবাহের সময়। তালাকের জন্য এক বা একাধিক কোনো সাক্ষীরই প্রয়োজন নেই।</p> <p> </p> <p><strong>৪. একসঙ্গে তিন তালাক দিলে কি তালাক হয় না?</strong></p> <p>অনেকে এই ভুল ধারণাও প্রচার করে যে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া হলে তালাক হয় না কিংবা শুধু এক তালাক হয়। এটিও একটি মারাত্মক ভুল। একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া জায়েজ না হলেও কেউ যদি এই নাজায়েজ কাজ করে তাহলে তার স্ত্রীর ওপর তিন তালাক ঠিকই পতিত হয়। এ ক্ষেত্রে তার মৌখিকভাবে রুজু করার অধিকার অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি নতুন করে বিবাহ পড়িয়ে নেওয়ার দ্বারাও তারা একে অন্যের জন্য হালাল হয় না।</p> <p> </p> <p><strong>৫. স্বামীর তালাকের শব্দ কি স্ত্রীর শোনা জরুরি?</strong></p> <p>অনেকের ধারণা, তালাকের শব্দ স্ত্রীর শুনতে হবে নচেৎ তালাক হবে না। এ জন্য অনেকে বলে থাকে যে স্বামী যখন তালাকের শব্দ উচ্চারণ করছিল তখন আমি কানে আঙুল দিয়ে রেখেছি। অথচ এগুলো ভুল, তালাকের শব্দ স্ত্রী না শুনলেও তালাক পতিত হবে। তাই কানে আঙুল দিয়ে লাভ নেই।</p> <p> </p> <p><strong>৬. তালাকনামায় কি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বাক্ষর করা ছাড়া তালাক হয় না?</strong></p> <p>অনেকের ধারণা, তালাকনামায় স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বাক্ষর করা ছাড়া তালাক হয় না। অথচ ইসলামের বিধান হলো—যেহেতু তালাক বিবাহের মতো দ্বিপক্ষীয় কাজ নয় বরং তালাক এক পক্ষ থেকেই পতিত হয়ে যায়, আর তালাকের অধিকারী হচ্ছে পুরুষ, তাই তালাকনামায় স্বামী স্বাক্ষর করলেই তালাক হয়ে যায়, স্ত্রীর স্বাক্ষর জরুরি নয়।</p> <p>(বি.দ্র. : এখানে ইসলামী শরিয়তের বিধানের কথা বলা হয়েছে। প্রচলিত আইন বা রীতি নিয়ে এখানে কোনো বক্তব্য নেই। অতএব, একটি বিধানকে অন্য বিধানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, আমলে নেওয়া না নেওয়ার দায়ভার একান্তভাবে ব্যক্তির। বি.স.)</p> <p> </p> <p><strong>৭. রাগের অবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক হয় না?</strong></p> <p>তালাক তো দেওয়াই হয় রাগ হয়ে। কজন আছে শান্তভাবে তালাক দেয়? আসলে তো এমনই হওয়া উচিত ছিল যে, যদি বাস্তবসম্মত ও অনিবার্য প্রয়োজনে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় তাহলে বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝে-শুনে, আলেমদের থেকে সঠিক মাসআলা জেনে নিয়ে মাসআলা অনুযায়ী তালাক প্রদানের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে।</p> <p>কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ মাসআলা জানার চেষ্টাও করে না, আর বড়দের সঙ্গে পরামর্শও করে না। নিজের ইচ্ছাবিরোধী কোনো কিছু পেলেই রাগেরবশে তালাক দিয়ে ফেলে। আর তা এক বা দুটি নয়, একনিঃশ্বাসে তিন তালাক। যখন রাগ প্রশমিত হয় তখন অনুতপ্ত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের কথা বানাতে থাকে। বলে, আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি, তালাকের ইচ্ছা ছিল না। জেনে রাখা উচিত যে সুস্পষ্ট তালাক পতিত হওয়ার জন্য নিয়তের প্রয়োজন নেই। নিয়ত থাকা বা না থাকা সর্বাবস্থায় তালাক শব্দ বলে ফেললে বা লিখে দিলেই তালাক হয়ে যায়। তেমনিভাবে রাগের অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়।</p> <p>অবশ্য কেউ যদি প্রচণ্ড রাগের ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়ে, আর এ অবস্থায় সে কী বলেছে তার কিছুই মনে না থাকে, তাহলে ওই অবস্থার তালাক কার্যকর হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ৩/২৪৪)</p> <p> </p> <p><strong>৮. ঠাট্টা করে তালাক দিলে কি পতিত হয় না?</strong></p> <p>হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়। অনেকের ধারণা—এটি তো দুষ্টুমি মাত্র। এতে কি আর তালাক হবে? হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তিন জিনিস ঠাট্টা করে করলেও পতিত হয়ে যায়। বিবাহ, তালাক ও ‘তালাকে রজঈ’ ফেরত নেওয়া।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৯৪)</p> <p>শেষ কথা এই যে দাম্পত্য জীবন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনেক বড় একটি নিয়ামত। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কর্তব্য এই নিয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং একে অন্যের সব অধিকার আদায় করা। স্ত্রীর জন্য উচিত নয় কথায় কথায় স্বামীর কাছে তালাক চাওয়া। আবার স্বামীর জন্যও জায়েজ নয় আল্লাহ তাআলার দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করা। বিয়ে, তালাক ও দাম্পত্য জীবনের সব বিধান ও মাসআলা শিক্ষা করা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য জরুরি। বিশেষত, স্বামীর কর্তব্য হলো—তালাকের মাসআলা ও এর পরিণতি সম্পর্কে অবগত না হয়ে কখনো তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা।</p> <p>আর যদি কোনো কারণে তালাক দেয় এবং এমনভাবে দেয় যে এখন আর তাদের একসঙ্গে থাকা শরিয়তে বৈধ নয়, তাহলে তাদের আল্লাহকে ভয় করা উচিত। টালবাহানা, অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে অথবা মূল ঘটনা গোপন রেখে একসঙ্গে বাস না করা অপরিহার্য। বাস্তবেই যদি তালাক হয়ে যায় এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, এর পরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একসঙ্গে বাস করে, তাহলে তা হবে কবিরা গুনাহ এবং উভয়েই ব্যভিচারের গুনাহে লিপ্ত হবে।</p> <p>মহান আল্লাহ আমাদের সত্য জেনে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।</p> <p> </p> <p><strong>বি.দ্র. : এই লেখায় ইসলামী শরিয়তের বিধান তুলে ধরা হয়েছে। এটি মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য, যারা ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক জীবনযাপনে আগ্রহী। প্রচলিত আইন বা রীতির সঙ্গে এটাকে মিলিয়ে দেখা বা না দেখার দায়ভার লেখকের নয়।     —বি. স.</strong></p>