<h3><strong>ইসলামের মৌলিক বিধানগুলো মদিনায় ফরজ হয় কেন</strong></h3> <p>ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো, তথা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, জিহাদ ইত্যাদি মহানবী (সা.)-এর মাদানি জীবনে ফরজ হয়। নামাজ হিজরতের ১১ মাস আগে রজবের ২৭ তারিখে মিরাজের রাতে ফরজ হয়, তবে পড়ার নির্দেশ হয় প্রথম হিজরিতে। জিহাদ ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে, রোজা ও জাকাত ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরিতে, হজ ফরজ হয় অষ্টম, মতান্তরে নবম হিজরিতে। এসব বিধান মদিনায় ফরজ হওয়ার রহস্য হলো, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়া মানুষ তা পালন করবে না। ইসলামী সরকার মুসলিম প্রজাদের এসব বিধান পালন করতে বাধ্য করবে। তাই দেখা যায়, মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রে বেনামাজি, রোজা বর্জনকারী, জাকাত অস্বীকারকারী এবং ফরজ হজ বর্জনকারী কেউ ছিল না।</p> <p> </p> <h3><strong>এক মাস রোজা রাখার নির্দেশের পর সান্ত্বনা!</strong></h3> <p>আল্লাহ তাআলা রোজার বিধান ফরজ করার ক্ষেত্রে প্রথমত সান্ত্বনামূলক বাণী পেশ করেছেন। যেমন—তিনি ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে (রোজা) তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)</p> <p>রোজা ফরজ করার সঙ্গে সঙ্গে এই সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে যে রোজা একটু কষ্টকর হলেও এই বিধান নতুন নয়; বরং পূর্বেও সব উম্মতের ওপর তা ফরজ ছিল। তারা যেহেতু রোজা পালন করতে পেরেছে, তোমরাও পারবে। রোজাকে ভয় করবে না, কষ্টকর মনে করবে না। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, উম্মতে মুহাম্মদির রোজা সহজ করে দেওয়া হয়েছে, যদিও আগের উম্মতের রোজা আরো কষ্টসাধ্য ছিল।</p> <p> </p> <h3><strong>মুসাফির ও রুগ্ণ ব্যক্তির জন্য অবকাশ</strong></h3> <p>আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের ওপর যা কিছু ফরজ করেছেন, তাতে বান্দাদের দুর্বলতার প্রতিও তিনি লক্ষ রেখেছেন। ফলে মুসাফির ও রুগ্ণ ব্যক্তিদের প্রতি এ অনুগ্রহ করেছেন যে তারা সফর কিংবা অসুস্থ অবস্থায় রোজা না রেখে অন্য সময় তথা সফর থেকে ফিরে এলে এবং অসুস্থতা কেটে গেলে রোজা রাখতে পারবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করতে হবে। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৪)</p> <p>এতে সেই ব্যক্তি আল্লাহর দেওয়া অনুকম্পাও ভোগ করল এবং আল্লাহর ফরজও পালন করল এবং রোজার মহামূল্য পুণ্য থেকেও বঞ্চিত    হলো না।</p> <p> </p> <h3><strong>প্রথম দিকে রোজা রাখা ঐচ্ছিক ছিল</strong></h3> <p>ইসলামের প্রথম দিকে যেহেতু রোজার অভ্যাস ছিল না, তাই অনবরত এক মাস রোজা রাখা তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই রোজা রাখতে সক্ষম ব্যক্তিদের এ সুযোগ দেওয়া হয় যে অসুস্থ বা সফরের কোনো ওজর না থাকলেও শুধু অনভ্যাসের কারণেই যদি তোমাদের জন্য রোজা রাখতে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তোমাদের এখতিয়ার আছে। ইচ্ছা করলে রোজা রাখতে পারো, আবার ইচ্ছা করলে একটি রোজার পরিবর্তে একজন দরিদ্রকে দুই বেলা পেটভরে খাওয়াবে। কেননা সে যখন এক দিনের খাবার অন্যকে দিল, তখন যেন এক দিনের পানাহার থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করল। ফলে একপর্যায়ে রোজার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা হলো। আল্লাহর বাণী, ‘আর রোজা যাদের অতিশয় কষ্ট দেয়, তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদইয়া—একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৪)</p> <p> </p> <h3><strong>কেন এই রোজা রাখার বিধান</strong></h3> <p>রোজার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন।   (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)</p> <p>তাকওয়া হলো এমন এক সদাসতর্ক মানসিক অবস্থা, যা কাঁটাময় পথে পথিককে বাঁচাতে সাহায্য করে। তাকওয়া থাকলে মানুষ সব নিষিদ্ধ ও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকবে এবং সব আদিষ্ট কাজ পালন করবে। রোজা বিভিন্নভাবে তাকওয়া সৃষ্টি করে। প্রথমত, রোজা হলো লৌকিকতামুক্ত ইবাদত। দ্বিতীয়ত, রোজা দ্বারা প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের প্রশিক্ষণ হয়। তৃতীয়ত, রমজান মাসের ২৪ ঘণ্টা চলে ইবাদতের অনুশীলন। চতুর্থত, রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনা দুর্বল হয়। পঞ্চমত, রোজা একটি সংবেদনশীল সমাজ গঠনে সাহায্য করে; কারণ সারা দিন উপবাস থেকে রোজাদার গরিব-দুঃখীর কষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়। তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য ছয়টি—১. সত্যের সন্ধান, ২. সত্য গ্রহণ, ৩. সত্যের ওপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা, ৪. আল্লাহভীতির মহান স্বভাব সৃষ্টি করা, ৫. দায়িত্বসচেতনতা, ৬. আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ভয় নিয়ে সব কাজ সম্পাদন করা।</p> <p>রমজান মুসলমানদের জীবনে পরিবর্তন আনার মোক্ষম সুযোগ। রোজা নিছকই উপবাস থাকা, পানাহার ও কামাচার বর্জনের নাম নয়; এর বিশেষ তাৎপর্য ও দর্শন রয়েছে। রয়েছে এর দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপকারিতা। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, ‘মানুষের কুপ্রবৃত্তি ও আবেগের ওপর বিবেকের সর্বদা প্রভাব বিস্তার করা উচিত। কিন্তু মানবীয় দুর্বলতার কারণে অনেক সময় বিবেকের ওপর মানুষের আবেগ প্রাধান্য লাভ করে। তাই আত্মশুদ্ধি ও আত্মজাগৃতির জন্য ইসলাম রোজাকে মৌলিক ইবাদতগুলোর অন্তর্ভুক্ত করেছে। রোজা রাখার দ্বারা মানুষের কুপ্রবৃত্তি ও আবেগের ওপর বিবেক পরিপূর্ণভাবে বিজয়ী হয়। এতে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জিত হয়। রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষের নিজের অক্ষমতা ও অপারগতা এবং আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও কুদরতের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। রোজার মাধ্যমে অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়, দূরদর্শনের ধারণা প্রবল হয়। আসবাব ও উপকরণের হাকিকত খুলে যায়। পাশবিকতা ও পশুত্ব অবদমিত হয়। ফেরেশতাদের নৈকট্য লাভ হয়। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের সুযোগ হয়। অন্তরে মানবিকতা ও সহমর্মিতার বন্যা বয়ে যায়। রোজা দেহ-আত্মার সুস্থতার কারণ। রোজা মানুষের জন্য এক রুহানি খাদ্য, যা পরকালে মানুষের জন্য খাদ্যের কাজ দেবে। সর্বোপরি রোজা আল্লাহর ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন।’ (আহকামে ইসলাম আকল কি নজর মে, পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৫)</p> <p>প্রকৃতপক্ষে দুটি বিপরীত বস্তু দেহ ও মনের সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি। দেহ মাটির তৈরি। আর রুহ বা আত্মা আল্লাহর হুকুম বা নূরের তৈরি। মাটি নিম্নগামী আর রুহ ঊর্ধ্বগামী। মাটির বৈশিষ্ট্য যখন মানুষের মধ্যে প্রবল হয়, তখন সে মনুষ্যত্বটুকুও হারিয়ে ফেলে। বরং চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে আত্মার শক্তি যখন তার মধ্যে প্রবল হয়, তখন সে মারেফতে এলাহি অর্জনে সক্ষম হয়। এমনকি উৎকর্ষের বিচারে ফেরেশতাকুলকেও ছাড়িয়ে যায়। মানুষ পশু নয়, নয় তো ফেরেশতা। পশুসুলভ গুণ ও ফেরেশতাসুলভ স্বভাবের সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি। এ দুয়ের দ্বন্দ্বও চিরন্তন। মুসলিম দার্শনিক শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রহ.)-এর মতে, ‘যখন প্রবল পশুসুলভ গুণ ফেরেশতাসুলভ গুণ প্রকাশের পথে বাধা দেয়, তখন তাকে গুরুত্ব দিয়ে অবদমিত করা জরুরি। আর পশুসুলভ গুণের প্রাবল্য, উন্নতি ও ক্রমবৃদ্ধি ঘটে পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে। তাই পশুত্ব অবদমনে এই উপকরণগুলোর সংকোচনের বিকল্প নেই।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ৪৮)</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2019/05 May/21-05-2019/Kalerkantho_19-05-21-07.jpg" style="height:381px; width:665px" /></p> <h3><strong>সাধারণ অবকাশ বাতিল করে সবলদের ওপর রোজার অপরিহার্যতা</strong></h3> <p>মানুষ যখন রোজা রাখতে অভ্যস্ত হয়ে গেল, তখন আর সাধারণ অবকাশ বাকি থাকেনি। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা এই মাসে যেন রোজা রাখে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)</p> <p>এ নির্দেশ দ্বারা প্রথম পর্যায়ে উল্লিখিত অবকাশমূলক নির্দেশ সুস্থ-সবল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে রহিত হয়ে যায়। তবে যেসব ব্যক্তি অতিরিক্ত বার্ধক্যজনিত কারণে রোজা রাখতে অক্ষম কিংবা দীর্ঘকাল রোগভোগের দরুন দুর্বল হয়ে পড়েছে অথবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়েছে, সেই সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে অবকাশমূলক নির্দেশটি এখনো প্রযোজ্য। (জাসসাস, মাজহারি) সহিহ বুখারি ও মুসলিমে রয়েছে, যখন ‘ওয়াআলাল্লাযিনা ইউতিকুনাহু’ (যারা রোজা রাখতে সক্ষম) শীর্ষক আয়াতটি নাজিল হয়, তখন এই মর্মে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল যে যার ইচ্ছা সে রোজা রাখতে পারে, আর যে রোজা রাখতে না চায়, সে ফিদইয়া দিয়ে দেবে। তারপর যখন ‘ফামান শাহিদা মিনকুমুুশ শাহরা ফাল ইয়াসুমহু’ (যে ব্যক্তি রমজান মাস পায়, সে যেন রোজা রাখে) নাজিল হলো, তখন রোজা অথবা ফিদইয়া দেওয়ার ইখতিয়ার রহিত হয়ে যায় এবং সুস্থ-সামর্থ্যবান লোকদের ওপর রোজা অপরিহার্য সাব্যস্ত হয়ে যায়। (মা’আরিফুল কোরআন)</p> <p> </p> <h3><strong>রোজার বিধানে তিন ধাপে পরিবর্তন</strong></h3> <p>ইসলামে রোজার ক্ষেত্রেও তিনটি পরিবর্তনের ধারা দেখা যায়। প্রথমত, মদিনায় এসে রাসুল (সা.) সর্বপ্রথম আশুরার রোজা রাখতেন। এটাই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ফরজ রোজা। তারপর রাসুল (সা.) প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখতেন। এগুলোকে আইয়ামে বিজের রোজা বলা হয়। অতঃপর হিজরতের দেড় বছর পর দ্বিতীয় হিজরির ১০ শাবান মদিনা শরিফে পূর্ণ এক মাস রোজা পালনের হুকুম অবতীর্ণ হয়। দ্বিতীয়ত, গোড়ার দিকে এই নির্দেশ ছিল যে, যে চাইবে রোজা রাখবে আর যে চাইবে না রোজার পরিবর্তে মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। এই বিধান সুস্থ-অসুস্থ, সবল-দুর্বল সবার জন্যই ছিল। পরবর্তী সময়ে সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে সুস্থ-সবল ও বাড়িতে অবস্থানকারীর জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে অসুস্থ, অতি দুর্বল, বার্ধক্যে জর্জরিত ও মুসাফিরের জন্য রোজা না রাখার বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তৃতীয়ত, আগে রাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে আগে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস বৈধ ছিল বটে; কিন্তু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাতে জেগে উঠলেও পানাহার ও স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ ছিল। পরে সুরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াত নাজিল করে আল্লাহ তাআলা মাগরিব থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত রমজানের রাতে পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি দান করেন। এভাবেই যুগে যুগে রোজার ক্রমবিকাশ ধারা সূচিত হয়।</p> <p> </p> <h3><strong>রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে রোজা কেমন ছিল</strong></h3> <p>পবিত্র মাহে রমজানের রোজা ইসলামের মৌলিক বিধানাবলির অন্যতম। তাই রোজা পালনে পদ্ধতিগত ভিন্নতা থাকলেও মৌলিক রোজার বিধান পূর্ববর্তী সব যুগের সব নবীর শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর তাঁকে একটি বিশেষ ফল আহার করতে বারণ করেছেন—এটাই মানব ইতিহাসের প্রথম সিয়াম সাধনা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি ও তোমার সঙ্গী জান্নাতে বাস করতে থাকো এবং যেখান থেকে যা চাও, তা তোমরা খাও, কিন্তু এই গাছটির কাছেও যেয়ো না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৯) কিন্তু শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে তাঁরা সেই নিষিদ্ধ ফল আহার করে ফেলেন। ফলে আল্লাহ তাআলা তাঁদের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন।</p> <p>সেই রোজা ভাঙার কাফ্্্্ফারাস্বরূপ আদম (আ.) ৪০ বছর রোজা রেখেছিলেন। আর ওই নিষিদ্ধ ফলের প্রভাব আদম (আ.)-এর পেটে ৩০ দিন বিদ্যমান ছিল বলে আদম (আ.)-এর শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতকে মহান আল্লাহ এক মাস রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।</p> <p>হজরত মুসা (আ.)ও ৩০ দিন রোজা রেখেছিলেন। তুর পাহাড়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা তাঁকে আরো অতিরিক্ত ১০টি রোজা রাখার আদেশ দেন। ফলে তাঁর রোজা হয়েছিল সর্বমোট ৪০ দিন। হজরত ঈসা (আ.)ও মুসা (আ.)-এর মতো ৪০ দিন রোজা রাখতেন। হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের পর আল্লাহ তাআলা হজরত মারইয়াম (আ.)-কে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সেটি ছিল মৌখিক রোজা। হজরত ইদরিস (আ.) গোটা জীবন রোজা রেখেছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) এক দিন পর পর অর্থাৎ বছরে ছয় মাস রোজা রাখতেন। হজরত নুহ (আ.)-এর যুগে প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালনের বিধান ছিল। তাফসিরবিদ হজরত কাতাদা (র.) বলেন, ‘মাসে তিন দিন রোজা রাখার বিধান হজরত নুহ (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত বলবৎ ছিল।’ এক বর্ণনা অনুযায়ী, ‘হজরত নুহ (আ.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন বাদ দিয়ে সারা বছর রোজা রাখতেন।’ (ইবনে মাজাহ)</p> <p>এ ছাড়া বর্তমানে প্রচলিত ধর্মগুলোতেও বিভিন্ন সংযম, উপবাসপ্রথা   দেখা যায়।</p> <p> </p> <h3><strong>রমজানে স্ত্রীর সঙ্গে শয্যাযাপন</strong></h3> <p>ইসলামের প্রাথমিক যুগে রমজান মাসের রাতগুলোর প্রথমাংশে পানাহার ও স্ত্রীগমনের অনুমতি ছিল। কিন্তু শয়ন করার পর এসব কাজ নিষিদ্ধ ছিল। কিছু সাহাবির পক্ষ থেকে এর ব্যতিক্রম হয়ে যায়। তাঁরা শয়নের পর স্ত্রীসংগম করে বসেন। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিজেদের ত্রুটি স্বীকার করেন এবং এর জন্য ভীষণ অনুতপ্ত হন। অতঃপর তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এর প্রতিকার জানতে চান। হজরত ওমর ইবন খাত্তাব (রা.) একদিন জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! গত রাতে আমি আমার স্ত্রীর কাছে সেই ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম, যা একজন পুরুষ একজন নারীর কাছে করে থাকে। আমার স্ত্রী জানাল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি এটাকে তার বাহানা ভেবে তার সঙ্গে সহবাস করেছি। আর তখনই এ আয়াত নাজিল হয়, ‘রোজার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রীদের সঙ্গে অনাবৃত হওয়া (সহবাস করা) হালাল করা হয়েছে (সুরা : বাকারা, আয়াত ১৮৭)।</p> <p>এ আয়াতে রোজাদারদের জন্য বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগে যা নিষিদ্ধ ছিল, তা বৈধ করা হয়েছে।</p> <p>পানাহার ও স্ত্রীসংগমের শেষ সময় সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ না রাত্রির কালো রেখা থেকে সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রকাশিত হয়। তারপর তোমরা রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো। (সুরা : বাকারা,     আয়াত : ১৮৭)</p> <p>এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা রোজাদারের জন্য রাত থেকে সাহিরর শেষ সময় পর্যন্ত স্ত্রীসংগমসহ পানাহার করা মোবাহ করেছেন। এটাকেই কালো সুতা থেকে সাদা সুতা উদ্ভাসিত হওয়া বলা হয়েছে। হজরত সহল ইবন সাদ বলেন, যখন ‘ওয়াকুলু ওয়াশরাবু’ (আর খাও ও পান করো) নাজিল হয়, তখন ‘মিনাল ফাজরি’ নাজিল হয়নি। ফলে যখন লোকেরা রোজা রাখত, তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের দুই পায়ে কালো সুতা ও সাদা সুতা বেঁধে রাখত এবং উভয় সুতার পার্থক্য যতক্ষণ পর্যন্ত স্পষ্টরূপে দেখা না যেত, ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করতে থাকত। তারপর আল্লাহ তাআলা ‘মিনাল ফাজরি’ (ভোরের আলো) অংশটুকু নাজিল করেন। এতে সবাই জানতে পারল যে এর অর্থ রাত ও দিন। ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, আমাকে হিশাম, তিনি হেসিন শাবি থেকে, তিনি আদি ইবন হাতেম থেকে বর্ণনা করেন, হজরত আদি বলেন, যখন এ আয়াত নাজিল হয় তখন আমি কালো ও সাদা দুটি সুতা নিয়ে আমার বালিশের নিচে রেখে দিলাম। আমার কাছে যখন কালো থেকে সাদার পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে উঠত, তখন আমি পানাহার বন্ধ করতাম। সকাল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে গমন করলাম এবং যা করেছি তা সবই ব্যক্ত করলাম। অতঃপর রাসুল (সা.) বলেন, তোমার বালিশ তো বিরাট লম্বা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, রাতের অন্ধকার থেকে দিনের আলো ফুটে ওঠা। হজরত আদি ইবন হাতেম (রহ.) থেকে আরো বর্ণিত আছে তিনি বলেন, আমি একটি সাদা সুতা ও একটি কালো সুতা ধারণ করতাম। কোনো কোনো রাত এমন হতো যে সাদা ও কালো ভালোভাবে দেখা যেত না। হজরত আদি (রা.) আরো বলেন, আমি একদা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! সাদা সুতা ও কালো সুতা কী? এটা আসলেই কি দুই প্রকার সুতা? রাসুল (সা.) বলেন, তুমি যদি দুই ধরনের সুতা দেখে থাকো, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি লম্বা গর্দানবিশিষ্ট সেজেছ। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, বরং তা হলো রাতের অন্ধকার ও দিনের আলো। (তাফসিরে ইবনে কাসির)</p> <p> </p> <h3><strong>রমজান কোরআন নাজিলের বার্ষিকী </strong></h3> <p>ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান হলো সেই মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)</p> <p>রমজান হলো কোরআন নাজিল হওয়ার বার্ষিকী। কোরআন নাজিল হওয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ মাসে ঘটেছে বলেই দীর্ঘ এক মাস ধরে এর বার্ষিকী পালন করা হয়। এই বার্ষিকী পালনের জন্য যেসব অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে, তার সামষ্টিক ফল হলো তাকওয়া। মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে হজরত ওয়াসেলা ইবন আসকা থেকে বর্ণিত আছে যে মহানবী (সা.) বলেছেন, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সহিফা পহেলা রমজান, তাওরাত ৬ রমজান, জাবুর ১২ রমজান, ইঞ্জিল ১৩ মতান্তরে ১৮ রমজান এবং কোরআন মাজিদ ২৪ রমজান নাজিল হয়। (ইবনে কাসির)</p> <p> </p> <h3><strong>অনুশোচনাকারীর জন্য স্থায়ী অবকাশ</strong></h3> <p>রোজার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা জ্ঞাত ব্যক্তি যখন পীড়া ও সফরের কারণে রোজা পালন করতে পারে না, তখন তার অন্তরে এ অনুশোচনা সৃষ্টি হয় যে আমি আল্লাহর হুকুম পালন করতে পারিনি এবং রোজার অমূল্য বরকত ও রহমত থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আল্লাহ তাআলা বান্দার এ অনুশোচনা ও দুঃখ দূরীভূত করার জন্য এই সহজ পন্থার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে তোমরা অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করতে পারবে এবং আল্লাহর হুকুম পালনের সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে।</p> <p> </p> <p><strong>লেখক :</strong> প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী</p>