<p>দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি মুসলিম দেশ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (সিয়াকো) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি তাঁর ব্রুনেই সফরে দেশটির সুলতান হাজি হাসান আল বলখিয়ার সঙ্গে এক বৈঠকে এই প্রস্তাব দেন তিনি।</p> <p>বাংলাদেশের পক্ষে উত্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য পাঁচটি দেশের সমন্বয়ে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরাম গঠন করা হবে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেই ফোরামের সদস্য হবে। ব্রুনেইয়ের সুলতান হাসান বলখিয়া প্রস্তাবটিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন। বিষয়টি এগিয়ে নিতে ‘অনুকূল বিবেচনা’ করবেন বলে জানিয়েছেন।</p> <p>বর্তমানে বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রচণ্ড প্রভাব রোধে অর্থনৈতিক উন্নয়নে আঞ্চলিক ফোরাম ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, পারস্পরিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্যে অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর প্রভাব মোকাবেলায় এবং দেশীয় অর্থনীতির অস্তিত্ব রক্ষা ও তার বিকাশে আঞ্চলিক সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।</p> <p>গত ১৯ এপ্রিল (শুক্রবার) জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সংস্থাটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ইকোসক) আয়োজিত উন্নয়নে অর্থায়ন (এফএফডি) বিষয়ক ফোরামের সভায় বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর তাগিদ দেওয়া হয়। বলা হয়, বাংলাদেশ ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছতে চাইলে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত সিয়াকো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।</p> <p>দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা এখন সর্বত্র আলোচিত। মালদ্বীপের অর্থনৈতিক বিকাশ বিশ্বের বৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশগুলোর দৃষ্টি কেড়েছে। মালদ্বীপের অর্থনীতিতে প্রভাব বাড়াতে চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে; অন্যদিকে তেলসমৃদ্ধ ব্রুনেই, শিল্পে অগ্রসর মালয়েশিয়া ও দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ ইন্দোনেশিয়া যে আগামী দিনে এশিয়ান অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নতুন এই অর্থনৈতিক অঞ্চল আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশে এবং এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।</p> <p>বাংলাদেশের প্রস্তাবিত সিয়াকোর সঙ্গে আঞ্চলিকতার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সহযোগিতা ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করো। পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না...।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মুসলিমরা হলো এক দেহের মতো। যদি তার চোখ ব্যথিত হয়, তাহলে তার সারা দেহ ব্যথিত হয়।</p> <p>সুতরাং মুসলিম দেশগুলো তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামী ভ্রাতৃত্বকে গুরুত্বারোপ করবে—এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সংবিধানেও পররাষ্ট্রনীতিতে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সংবিধানের ২৫ ধারার ২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি সংরক্ষণ ও জোরদার করতে সচেষ্ট হয়।’</p> <p>তুরস্কের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের এক গবেষণা প্রতিবেদনে মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. বিলাল বাগ্স ও ড. সালার ইয়র্টসেভেন যৌথভাবে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। ‘তুর্কি অ্যান্ড দ্য ওআইসি : গ্রেটার ইকোনমিক কো-অপারেশন, অপরচুনিটিজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনে মুসলিম আর্থিক সংকট, উচ্চ বেকারত্বের হার, পশ্চাৎপদ শিল্পের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি ব্যাপক সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুসলিম বিশ্ব পৃথিবীর ২৩ শতাংশ ভূমি, ৬০ শতাংশ তেল এবং ৬১ শতাংশ গ্যাসের অধিকারী। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর জনশক্তির ২৪ শতাংশ তরুণ (২৪ বছর বয়স), পৃথিবীর শিল্পপণ্যের ৭০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ওআইসির শীর্ষ ১০ অর্থনীতির দেশে, বেশির ভাগ মুসলিম দেশের অর্থনীতি সম্ভাবনাময় ও বিকাশমান। সুতরাং দেশগুলোর ঐক্য ও সংহতি মুসলিম দেশগুলোর ভাগ্য বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।</p> <p>মুসলিম দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো কার্যকর কোনো আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক ফোরাম গড়ে তুলতে না পারলেও ডি-৮, জিসিসি, ওআইসির অর্থনৈতিক ফোরাম, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) মতো সংস্থাগুলো এরই মধ্যে আশার আলো দেখাতে সক্ষম হয়েছে। সিয়াকোর এই ধারাই একটি নতুন সম্ভাবনাময় প্রস্তাব। এটি আগামী দিনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতিকে সংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।</p> <p><strong>লেখক :</strong> ইনচার্জ, ধর্ম বিভাগ, কালের কণ্ঠ</p> <p>kasemsharifcu@gmail.com</p>