<p>জগৎ সংসারের অনেক বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার জবাব মানুষের জানা থাকে না। কোরআনের ভাষায়, ‘জ্ঞানের অতি সামান্যই তোমাদের দেওয়া হয়েছে...।’ এভাবেই কিংবদন্তির জন্ম হয় বিস্ময় ও রহস্যের কিনারা না পেয়ে। কিংবদন্তি কি সত্য, নাকি ঐতিহাসিক—তা বিশ্লেষণসাপেক্ষ বিষয়। তবে এটা বলা যায়, কিংবদন্তি অর্ধসত্য ও অর্ধ-ঐতিহাসিক। সত্যের খোলস ইতিহাস এবং ইতিহাসের কঙ্কাল কিংবদন্তি। ওই কঙ্কালে কল্পনার লেবাস লাগিয়ে ইতিহাস হেঁটে চলে মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায়। জনশ্রুতি, গল্প-গীত ইত্যাদির যত্নে কিংবদন্তি বেঁচে থাকে পরম সম্মানে এবং বড় হয় গর্বের মান্যতায়। এদিক বিবেচনায়, মহাকালের স্রোতধারায় ঐতিহ্যের স্মারক জেলা শহর কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ।</p> <p>শোলাকিয়া ঈদগাহর ঐতিহ্যে গর্বিত শহর কিশোরগঞ্জের অনন্য অহংকার, দুই শতাব্দী প্রাচীন পাগলা মসজিদ। পাগলা মসজিদের দানবাক্সে দৈনিক প্রায় লাখ টাকা জমা পড়ে। দানবাক্স খুললেই পাওয়া যায় স্বর্ণালংকার, বৈদেশিক মুদ্রা, অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী। মুসলিম-অমুসলিম সবাই এ মসজিদে দুই হাত খুলে দান করে। কারণ মানুষের বিশ্বাস, একনিষ্ঠ মনে এখানে মানত বা দান করলে রোগ-শোক, বালা-মসিবত দূর হয়।</p> <p>গত ৭ জুলাই ২০১৮ শনিবার মসজিদের পাঁচটি দানবাক্সে পাওয়া গেছে ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ১৭ টাকা। ৩১ মার্চ ২০১৮ পাওয়া যায় ৮৪ লাখ ৯২ হাজার ৩৭৫ টাকা। সাধারণত তিন-চার মাস পর দানবাক্স খুললেই এমন বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়। ৬ জানুয়ারি ২০১৮ পাওয়া গেছে এক কোটি ২৭ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭১ টাকা। ২০১৭ সালের এপ্রিলে পাওয়া গেছে এক কোটি ছয় লাখ ৯৩ হাজার ৩২ টাকা। ২০১৭ আগস্ট এক কোটি ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ১৭০ টাকা। ২০১৬ সালে দুই কোটি ৪৫ লাখ ৫২ হাজার ৬৪৪ টাকা। ২০১৫ সালে প্রচুর পরিমাণ টাকা ও ২৩৮ ভরি সোনা, ৮৬ ভরি রুপা, হীরার আংটিসহ অন্যান্য মূলবান সামগ্রী নিলামে তুলে মসজিদে প্রচুর আয় হয়।</p> <p>‘পাগলা মসজিদ’ কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত। মসজিদটিতে রয়েছে পাঁচতলা উঁচু দৃষ্টিনন্দন মিনার। কিংবদন্তি রয়েছে, সহসা প্রমত্তা নরসুন্দার বুকে পানিতে ধ্যানরত এক ভাসমান দরবেশের আবির্ভাব হয়। তাঁর কল্যাণেই নদীর মাঝে চর জেগে ওঠে। নদীর তীরবর্তী রাখুয়াইল গ্রামের এক গৃহস্থের গাভি নিয়মিত নদী সাঁতরিয়ে গিয়ে ওই দরবেশের ভাণ্ডে ওলানের দুধ দিয়ে আসত। এতেই গাভির দরিদ্র মালিক ও স্থানীয় লোকজনের চরম বৈষয়িক উন্নতি হয়। এমন আরো অসংখ্য কেরামতিতে বিমুগ্ধ মানুষজন ওই দরবেশের খেদমতে হুজরাখানা তৈরি করে। দরবেশের মৃত্যুর পর তাঁর হুজরাখানার পাশেই পাগলা সাধকের স্মৃতিতে ‘পাগলা মসজিদ’ নির্মিত হয়। এ জনশ্রুতির ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।</p> <p>‘পাগলা মসজিদ’ কিশোরগঞ্জের জীবন্ত কিংবদন্তি। আরেক জনশ্রুতি হলো, হয়বতনগরের প্রতিষ্ঠাতাদের পরিবারের এক নিঃসন্তান বেগমকে জনগণ ‘পাগলা বিবি’ বলে ডাকত। দেওয়ানবাড়ির এ বেগম নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে ‘পাগলা বিবি’র নামে পরিচিতি পায়। মাকসুদ হাসিলের নানা কিংবদন্তি রয়েছে পাগলা মসজিদ সম্পর্কে।</p> <p>হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির ১০ শতাংশ ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে গড়ে ওঠা পাগলা মসজিদের বর্তমান জমির পরিমাণ তিন একর ৮৮ শতাংশ। মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে এতিমখানা ও মাদরাসা। এখানে ছেলে-মেয়েদের থাকা-খাওয়া, পোশাকসহ লেখাপড়ার খরচ বহন করা হয়।</p> <p>কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি। তাঁর তদারকিতে মসজিদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত স্বচ্ছ। পাগলা মসজিদের অর্থায়নে এলাকার অন্যান্য প্রাচীন মসজিদের সংস্কার ও উন্নয়ন করা হচ্ছে। এলাকায় দরিদ্র অসহায় অসুস্থ অসচ্ছল পরিবারের জন্য পাগলা মসজিদ থেকে অনুদান দেওয়া হয়। লেখাপড়া, চিকিৎসা, অভাবী নারীর বিয়ের সময় সাহায্য করা এ মসজিদের গণমুখী কার্যক্রমের অংশ।</p> <p>সবাই মিলে শান্তি-সহাবস্থান, জান্নাতি পরিতৃপ্তির স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে এই মসজিদ টিকে থাকবে অনন্তকাল। এ ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের বিজয়কেতন উড়িয়ে তাওহিদের বার্তা শোনায় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য ও ভাটি বাংলার কিংবদন্তিতুল্য ঐতিহ্য কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ। তবে কিংবদন্তি তো কিংবদন্তিই। কেননা রহস্যাবৃত লোকজ ভাবনাই কিংবদন্তির অবলম্বন। অন্যদিকে সভ্যতার পাথরচাপা সত্য সামান্য ঝলকানিতে মিলিয়ে যাবে না, যদি ক্যামেরা-ক্যাসেট হাতে মানুষ লোকায়ত বাংলার মেঠোপথে একটু পা বাড়ায়। আর তখন কিংবদন্তিগুলো হয়ে উঠবে জীবন্ত এবং বিশ্বাসের কাছাকাছি প্রায় সত্য।</p> <p><strong>লেখক : </strong>বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর</p>