<p>আল কোরআনের আলোকে সুন্নাহভিত্তিক সংগঠিত ও পরিচালিত আদর্শবাদী রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র বলে পরিচিত। এরূপ রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান না হলেও তা হবে ইসলামী রাষ্ট্র। মুসলিম রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্র এককথা নয়। কোনো রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক, এমনকি সব নাগরিক মুসলমান হলেও সে রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র নাও হতে পারে। তবে এরূপ রাষ্ট্রকে অবশ্যই মুসলিম রাষ্ট বলা যেতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্র হবে আদর্শভিত্তিক ও আদর্শবাদী।  অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সেই আদর্শের বাস্তব রূপায়ণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে সেই আদর্শের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণই ইসলামী রাষ্ট্রের একমাত্র পরিচয়।</p> <p><strong>ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা</strong></p> <p>ইসলামী রাষ্ট্রে নিরাপত্তার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু বৈদেশিক আক্রমণের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ দিক থেকে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ধারণা ভিন্ন। এর জন্য উন্নত দেশগুলোতে উন্নত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীসহ নানা ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি একটু আলাদা। ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবিক অর্থে একটি নিরাপদ রাষ্ট্র। এখানকার সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার ও জনগণ সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। ইসলামী রাষ্ট্রে সমাজ কিভাবে নিরাপদ থাকবে, এর নিরাপত্তা কিভাবে বিধান করতে হবে, তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে কোরআন ও সুন্নাহ। বাইরের শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশনাও আছে ইসলামে। মুসলমানদের সম্মান, সম্পদ ও রক্ত যাতে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিপতিত না হয়, সে জন্য মহানবী (সা.) সতর্ক করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৯৩)</p> <p>মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমন কাজকে মহানবী (সা.) হারাম ঘোষণা করেছেন। অমুসলিমের নিরাপত্তার ব্যাপারে আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন, ‘(মুসলিম রাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসকারী) কোনো অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না।’ (বুখারি)</p> <p>সমাজের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চোরের হাত কাটার বিধান, নারীর সম্ভ্রম রক্ষা, তাঁর সম্মান ও শরীরের নিরাপত্তার জন্য তাঁর প্রতি না তাকানোর বিধান ইসলামে সুস্পষ্ট। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টিও ইসলামে গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়েছে। এ জন্য জাকাত, ফিতরা ও উশরের বিধান চালু করা হয়েছে। আর এ নিরাপত্তার বিধানগুলো নিশ্চিত করার জন্য জাকাত প্রদানে আপত্তিকারী কিংবা অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।</p> <p>এভাবে রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ের নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিধান ও রাষ্ট্রের পক্ষে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনকে ঈমানের অঙ্গ ঘোষণা করে ইসলাম মহান ধর্ম ও জীবনবিধানের মর্যাদা সমুন্নত করেছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা এবং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদার লোকেরা! জিহাদের জন্য তোমরা অস্ত্র ধারণ করো, অতঃপর ক্ষুদ্র বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে কিংবা সবাই একত্রে রওনা হও ও ঝাঁপিয়ে পড়ো।’ (সুরা : আন-নিসা, আয়াত : ৭১)</p> <p><strong>ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকৌশল</strong></p> <p>আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় নিরাপত্তার বিষয়ে দুনিয়াবি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বহু কর্মপরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মূল ভিত্তি হচ্ছে ইসলামী আদর্শ। আধুনিক অস্ত্র, বিপুল সমরাস্ত্রকে ইসলাম কোনো দেশের নিরাপত্তার জন্য একমাত্র অবলম্বন বা কৌশল বলে মনে করে না। বরং মানুষের মানবিক ও আদর্শিক ঐক্য ও সংহতিকে গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। নিম্নে ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা তথা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কৌশল সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—</p> <p>ক. আদর্শিক শক্তি</p> <p>সমরবিদ্যায় পারদর্শীদের মতে, কোনো দেশের প্রতিরক্ষার বিষয়টি সে দেশের সামরিক শক্তি, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র এবং আধুনিক মারণাস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং প্রতিরক্ষার বিষয়টি নির্ভর করে দেশের সব জনগণের নিজস্ব আদর্শের শক্তি, নৈতিক বল ও মানবিক শক্তি এবং আল্লাহর মদদের ওপর। আদর্শিক শক্তিতে বলীয়ান মানুষ শত্রুর যেকোনো কঠিন আক্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারে। এর নমুনা আমরা দেখেছি রাসুলে করিম (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের জীবনে এবং পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে। আমরা এর জলজ্যান্ত উদাহরণ পাই বদর, খন্দক, ইয়ারমুকসহ অসংখ্য যুদ্ধে।</p> <p>ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান বিপুল অস্ত্র ও দুনিয়াবি শক্তিতে বলীয়ান এক হাজার কাফেরের বিরুদ্ধে সহজে বিজয় লাভ করে। খন্দকে ইসলামী আদর্শের শক্তিতে বলীয়ান তিন হাজার মুসলমান আল্লাহর সাহায্যে ছয় গুণ বেশি ১৮ হাজার কাফেরের বিরুদ্ধে জয়ী হয়। আর ইয়ারমুক ময়দানে মুসলমানদের ৪০ হাজার সৈন্য রোমান বাহিনীর দুই লাখ ৪০ হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে বিজয়ী হলো কিভাবে? মুসলমানদের একমাত্র শক্তি ছিল আল্লাহর সাহায্যের ওপর অগাধ বিশ্বাস ও নৈতিক বল। এসব ঘটনা এ কথারই প্রমাণ দেয় যে কোনো মানবগোষ্ঠীর ঈমান ও আদর্শের জোর থাকলে তাদের কোনো শক্তিই পরাভূত করতে পারে না। আমাদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় আজও আদর্শই মূল শক্তি। অস্ত্র, মারণাস্ত্র ও সমরশক্তি সহযোগী মাত্র।</p> <p><strong>খ. নৈতিক ও মানসিক শক্তি</strong></p> <p>শত্রু মোকাবেলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানসিক বল ও নৈতিক শক্তি। মানসিক ও নৈতিক শক্তিতে দুর্বল বিশাল সৈন্যবাহিনী তার বিপুল রণসম্ভারসহ পরাজয় বরণ করেছে, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে ভূরি ভূরি। অথচ কমসংখ্যক সৈন্য ও মারণাস্ত্র নিয়ে ক্ষুদ্র বাহিনী শুধু মানসিক শক্তি ও উন্নত নৈতিকতার জোরে বিরাট সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছে। ইসলামের ইতিহাসে তার প্রমাণের কোনো অভাব নেই। আধুনিককালেও আমরা তার অনেক প্রমাণ লক্ষ করি। এই সেদিনও বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রুশদের বিরুদ্ধে দুর্বল আফগানরা বিজয় লাভ করে। এ জন্য ইসলাম মানসিক মনোবলকে শত্রু মোকাবেলার অন্যতম শক্তি বলে গুরুত্ব দিয়েছে। এ ব্যাপারে কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সাহসহীন হয়ো না, চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা ঈমান ও দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী হও।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৯)</p> <p><strong>গ. দৃঢ় ঐক্য ও শৃঙ্খলা</strong></p> <p>যুদ্ধে জয় এবং শত্রুর মোকাবেলায় ঐক্য ও শৃঙ্খলা যে কত জরুরি, ওহুদ যুদ্ধের ঘটনা থেকে মুসলমানরা সেই শিক্ষা নিতে পারে। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয় লাভের পর শেষের দিকে এসে খানিকটা অনৈক্যের মধ্যে পড়ায় তারা সাময়িকভাবে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিধানের ক্ষেত্রে ঐক্য ও শৃঙ্খলার যে কোনো বিকল্প নেই, তা সহজেই অনুমেয়। আজ গোটা বিশ্বে ও বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের বিপর্যয়, পরাজয় ও পরাধীনতার পেছনে আমরা তাদের মধ্যকার অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলাই লক্ষ করি। মুসলমানরা আজ প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত। আরব জাতির অনৈক্য ফিলিস্তিনে রক্ত ঝরাচ্ছে, মুসলমানদের সামগ্রিক অনৈক্য বসনিয়া, কাশ্মীর, আলজেরিয়া ও আফগানিস্তানে পরাজয়ের গ্লানি সৃষ্টি করেছে। মুসলমানরা অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে কোনোক্রমেই টিকে থাকতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি তো দৃঢ় ঐক্যবদ্ধতা ও পরম শৃঙ্খলাবোধ ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। মুসলমানদের ঐক্যের ব্যাপারে কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না...।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)</p> <p><strong>ঘ. বৈষয়িক ও বস্তুগত শক্তি</strong></p> <p>যেকোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তার আদর্শিক শক্তি ও মনোবল এবং মানসিক দৃঢ়তা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বস্তুগত শক্তিরও। উরত্বপঃরড়হ ড়ভ ডধৎ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধে সাফল্য লাভের জন্য যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম এবং উপযুক্ত যানবাহনের পুরোপুরি ব্যবস্থা থাকা একান্ত জরুরি।’</p> <p>তবে ইসলাম এই বৈষয়িক প্রাধান্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়নি। বৈষয়িক ও বস্তুগত উপকরণকে যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে একেবারে নিরুৎসাহিতও করা হয়নি। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তাদের মোকাবেলায় যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে। এর মাধ্যমে তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এরা ছাড়া তাদের, যাদের সম্পর্কে তোমরা জানো না...।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৬০)</p> <p>ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টিকে কোনোভাবেই হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে অবশ্যই তা রাষ্ট্রের আদর্শেরও বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও যেসব বিষয়ে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সে দিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।</p> <p>লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর</p> <p> ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড</p> <p> </p> <p> </p>