তাঁরা নিজেদের মতো ব্যবসা করার জন্য সোহাগের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান।’
তিনি বলেন, ‘৯ জুলাই এই হত্যাকাণ্ডের পর ১০ জুলাই সোহাগের বোন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার পর ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করি এবং এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব ও তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।’
পুুলিশ জানায়, গত ১১ জুলাই পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১) ও তারেক রহমান রবিনকে (২২) গ্রেপ্তার করে। এ সময় রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব আলমগীর (২৮) ও মনির ওরফে ছোট মনির (২৫) নামের আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। শুক্রবার রাতে মো. টিটন গাজী (৩২) নামের আরেক এজাহারভুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিসি বলেন, ‘একটি অপরাধ ঘটলে কে অপরাধী, সেটি বিবেচনায় পুলিশ মামলার তদন্ত করে। তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের কাছে মুখ্য নয়। তাঁরা কেন অপরাধটি করেছেন, এটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’
চাঁদাবাজির কোনো বিষয় ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন কোনো তথ্য পাইনি। যতটুকু জেনেছি, এটা পারস্পরিক দ্বন্দ্বের বিষয়।’
তবে গতকাল নিহতের পরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, সোহাগ হত্যায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের বাদ দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যুবদল নেতাদের এবং আসামি করা হয়েছে নিরীহ মানুষকে।
হত্যায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল রাজধানীর পুরান ঢাকার মিল ব্যারাকে রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স ও ঢাকা জেলা পুলিশ লাইনস পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এই ঘটনাটা বড়ই দুঃখজনক। একটা সভ্য দেশে এমন একটি ঘটনা কখনোই আশা করা যায় না। এটার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
অনেকে অভিযোগ করছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এখনো কঠোর হচ্ছে না। এমন অভিযোগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কঠোর না হলে পাঁচজনকে কিভাবে গ্রেপ্তার করা হলো? গতকাল কাঠমাণ্ডুর বিমানের ফ্লাইটে ফেরত আসার ঘটনায় যে মহিলা টেলিফোন করেছিলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁকেও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর এই অবস্থান মোটেও নির্লিপ্ত নয়।
দুই আসামিকে গ্রেপ্তারের পর র্যাবও গতকাল কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে একটি ব্রিফ করে। বাহিনীটির মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, ‘মিটফোর্ডে যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে, এর মূল তদন্ত ডিএমপি করছে। তারাই তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের বের করবে। আমরা (র্যাব) ছায়াত দন্তের মাধ্যমে ডিএমপিকে সহায়তা করছি। আমরা আমাদের ছায়া তদন্ত গোপনে চালিয়ে যাচ্ছি।’
রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ
সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গতকাল ঢাকাজুড়ে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। গতকাল জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। বিক্ষোভ মিছিলটি বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু হয়ে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়।
বিক্ষোভ মিছিল-পূর্ব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিএনপিকে তো শুধু নির্বাচন চাইতেই দেখি, কিন্তু চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলে না কেন? নির্বাচন চায় অথচ মিটফোর্ডের খুনিদের নিয়ে কথা বলে না কেন? আপনারা কি এখনো দলীয় সন্ত্রাসীদের চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি?’
তিনি বলেন, ‘মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সারা দেশের মানুষকে অবাক করেছে। সোহাগের অপরাধ কী ছিল? শুনছি, তিনি নাকি যুবদলেরই লোক ছিলেন। যে দলেরই হোক, মানুষ তো। তাঁর অপরাধ, তাঁর কাছে চাঁদা চেয়েছে, দেননি। এটা কোনো অপরাধ?’
মিটফোর্ডে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্র অধিকার পরিষদ। গতকাল সংগঠনটির আয়োজিত এক সমাবেশে এই প্রতিবাদ জানানো হয়। সমাবেশে সংগঠনটির সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘জাহেলিয়াত কায়েম করে কোনো সরকার থাকতে পারেনি। আওয়ামী জাহেলিয়াত টিকতে পারেনি, এখন নব্য জাতীয়তাবাদী জাহেলিয়াতও টিকতে পারবে না।’
পুরান ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল : সোহাগ হত্যার প্রতিবাদে পুরান ঢাকায় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। দিনভর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে সাধারণ শিক্ষার্থী, একাধিক রাজনৈতিক সংগঠনসহ সাধারণ জনগণ অংশ নেন।
সকাল ১১টায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল করে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা। মিছিলটি রায়সাহেব বাজার, তাঁতিবাজার অতিক্রম করে মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে শেষ হয়।
একই দিন দুপুর ২টায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। জবির কাঁঠালতলা থেকে শুরু হয়ে পুরো ক্যাম্পাস এবং রায়সাহেব বাজার মোড় প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাসে ফিরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে বিক্ষোভ মিছিলটি শেষ হয়। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের দুই নেতা পদত্যাগ করেছেন।
বিক্ষোভে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা : গতকাল দুপুর ১টার দিকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে বিক্ষোভে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থী সমাজ ব্যানারে এই বিক্ষোভ হয়।
হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের দশম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ফারাবি জিসান বলেন, ‘মিটফোর্ডের সামনে চাঁদাবাজির কারণে একজন মানুষকে পাথর দিয়ে থেঁতলে নৃশংসভাবে মেরে ফেলেছেন যুবদল-ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। অথচ দল দায় না নিয়ে তাঁদের শুধুই বহিষ্কার করেছে। আমরা বলতে চাই, এখানে অবশ্যই দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।’
কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ সাকিব বলেন, ‘বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সবাই মিলেমিশে কাজ করার যেই মানসিকতা তৈরি হয়েছিল, সেটা নষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংসতা বেড়ে গেছে। একজন মানুষকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে একটি মিছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা প্রদক্ষিণ করে এনএসইউর ১ নম্বর গেট এলাকায় এসে শেষ হয়। এ সময় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন।
দুপুর ১টার দিকে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে প্রতিবাদী বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। বিচার দাবিতে দুপুরে ইডেন কলেজের সামনে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন।
মিটফোর্ডের ঘটনায় কিছু রাজনৈতিক দল ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী। গতকাল উত্তরা ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধনকালে তিনি এই মন্তব্য করেন। রিজভী বলেন, ‘গত বুধবার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সত্য উদঘাটনের দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর। তবে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের রাতেই আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।’
হত্যাকাণ্ড সাজানো, দাবি চবি ছাত্রদল নেতার : গতকাল ব্যক্তিগত ফেসবুক পোস্টে সোহাগ হত্যার ঘটনাটি সাজানো বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়।
ফেসবুকে সাজ্জাদ লেখেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গতকালকের খুন ছিল একটা বড় পরিকল্পনার অংশ, একটা সাজানো মঞ্চ, যেটা মঞ্চায়ন করেছে জান্নাতের টিকিট বিক্রি করা গুপ্ত সংগঠন। বিএনপি খুন করেনি অথচ একদল গর্দভ বিএনপির বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।’
জাতীয় পার্টির শোক : সোহাগ হত্যার ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জি এম কাদের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
এইচআরএসএসের উদ্বেগ : সোহাগ হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও শোক প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)। তারা এ ঘটনাকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং দেশের সামাজিক ও বিচারিক ব্যবস্থার ওপর এক ভয়াবহ প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবে বর্ণনা করেছে। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং দ্রুত বিচার দাবি করেন।