এইচ অ্যান্ড অ্যাম, ওয়ালমার্টের মতো অনেক মার্কিন ব্র্যান্ডের বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা নতুন কার্যাদেশ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। তাই এখনই সময় কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। দক্ষ শ্রমশক্তি ও প্রস্তুত অবকাঠামো এ ক্ষেত্রে বড় সুবিধা। মান ও সময়মতো ডেলিভারি নিশ্চিত করতে পারলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের স্থায়ী অবস্থান তৈরি হতে পারে বলেও মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৫.৩৪ শতাংশ। কিন্তু নতুন ৫০ শতাংশ শুল্কের কারণে ভারতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পাবে। ইউএসটিআরের তথ্য মতে, ভারত ২০২০ সালে ৩০২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে; ২০২১ সালে ৪২০ কোটি ডলার, ২০২২ সালে ৫৬৯ কোটি ডলার; ২০২৩ সালে ৪৪৭ কোটি ডলার এবং ২০২৪ সালে ৪৭০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
বাংলাদেশের সামনে বড় সুযোগ : ভারতের চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি মার্কিন বাজারে শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশ এই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা এই খাতের রপ্তানি বাড়াতে পারে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, যেমন—হিমায়িত মাছ, চিংড়ি, শাকসবজি ও ফলমূল, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে। ভারতের কৃষিপণ্যের ওপর উচ্চ শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে এই পণ্যের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ সুযোগ পেতে পারে। তবে এই খাতে রপ্তানি বাড়াতে গুণগত মান এবং আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করতে হবে।
ভারতের আইটি সেবা রপ্তানির ওপর উচ্চ শুল্কের প্রভাব পড়লে বাংলাদেশ এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোর কাছে আকর্ষণীয় বিকল্প হতে পারে। বাংলাদেশের তরুণ জনশক্তি এবং তুলনামূলক কম শ্রমমূল্য এই খাতে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির কারণে বিদেশি কম্পানিগুলো যদি ভারত থেকে উৎপাদন সরিয়ে নিতে চায়, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশকেই গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে। আবার চীন থেকেও ধীরে ধীরে উৎপাদন সরিয়ে আনছে অনেক কম্পানি। ফলে ভারত-চীন উভয়ের বাইরে তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে আসতে পারে।
সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জও আছে উল্লেখ করে বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলেন, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা, এলডিসি সুবিধা শেষ হওয়ার পর কর সুবিধার সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে উত্তোরণে উপায় খুঁজে বের করা; বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, কাঁচামালের দাম কাঁচামালনির্ভরতা ও মূল্য ওঠানামা বড় ধরনের বাধা হতে পারে। এ জন্য তারা মার্কিন বাজারে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো, লিড টাইম কমিয়ে আনতে অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং কারখানায় কর্ম পরিবেশের উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে বলে পরামর্শ দেন তাঁরা।
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সহসভাপতি মো. শিহাব-উদ-দোজা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মার্কিন শুল্ক ইস্যু বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হলেও সরকারের নীতি-সহায়তা আর বন্দরের দক্ষতা বর্তমানে বড় বাধা। এ জন্য এখনই কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বেশি দামি পোশাকের কদর বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চায়না ও ভারতের কার্যাদেশের বড় অংশ স্থানান্তরিত হবে বাংলাদেশে। এ জন্য ক্রেতার বিনা মূল্যে কাঁচামাল (এফওসি) আমদানিতে তিন বাধা তুলে দিতে হবে। এটা হলে কৃত্রিম তন্ত্রের কাপড় (এমএমএফ) বিনামূল্যে ক্রেতারা রপ্তানিকারকদের পাঠাবেন। সেই কাপড়ে তৈরি পোশাক (উচ্চমূল্যের পোশাক) রপ্তানিতে দেশের রপ্তানি আয় বাড়বে।’ তিনি বলেন, বর্তমানে ৭০ শতাংশ মৌলিক পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এফওসি করা গেলে এমএমএফ পোশাকের রপ্তানি বাড়বে। বর্তমানে এই কাপড়ের তৈরি পোশাকের (উচ্চমূল্যের পোশাক) বৈশ্বিক বাজার ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশের হিস্যা এখানে মাত্র ২৫ শতাংশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মার্কিন শুল্ক কাঠামোতে যে অযৌক্তিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা তৈরি হলেও এর ফলে তৈরি অনিশ্চিত বিষয়গুলো নিয়েও দেশের উদ্যোক্তাদের আরো সতর্ক থাকা উচিত। এ ছাড়া ভারত চীন এবং ইরান থেকে পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপের ক্লজ রয়েছে শুল্ক কাঠামোতে। তাই বাংলাদেশের জন্যও মার্কিন শুল্ক চুক্তি বুমেরাংও হতে পারে।’
তবে মার্কিন বর্তমান শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য সোনালি সময় উল্লেখ করে বিজিএমইএ পরিচালক শাহ মোহাম্মদ রাঈদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উচ্চমূল্যের পোশাকের রপ্তানি বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ উচ্চমূল্যের পোশাকের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশ সারা পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ছে উচ্চমূল্যের পোশাকের কদর। তবে তিনি কারখানার কর্মপরিবেশ, পরিবেশবান্ধব কারখানা এবং ব্রান্ডিংয়ে জোর দেওয়া গেলে বাংলাদেশ সস্তা থেকে উচ্চমূল্যের পোশাকের বিশ্ববাজারের নেতৃত্ব দেবে।’
আপস না করার ঘোষণা মোদির : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ‘দ্বিগুণ’ শুল্ক আরোপ করার এক দিন পর কড়া বার্তা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, কৃষক ও জেলেদের স্বার্থে ভারত কোনোভাবেই আপস করবে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী নয়াদিল্লিতে ‘এমএস স্বামীনাথন জন্মশতবার্ষিকী’ উপলক্ষে এক সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘আমাদের কাছে কৃষকদের স্বার্থই সবার আগে। ভারত কখনো কৃষক, মৎস্যজীবী বা খামারিদের স্বার্থে আপস করবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, এর জন্য বড় মূল্য দিতে হতে পারে, তবু আমরা তৈরি।’