জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির মধ্যেই ‘জুলাই ঘোষণা’ প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি দলের কাছে ঘোষণাপত্রের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এই ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।
সরকারের একটি সূত্র বলেছে, আগামী ৫ আগস্টের মধ্যেই এই ঘোষণা হতে পারে।
সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দলিল, যা ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দেবে, সেই ঘটনার পটভূমি ও পরিণতি তুলে ধরবে এবং ভবিষ্যতে এসব বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার ভিত্তি গড়বে। সরকারের নেতৃত্বে এটি তৈরি হচ্ছে, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতেই এর চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যদি সবাই বা বেশির ভাগ পক্ষ একমত হতে পারে, তাহলে ২০২৫ সালের ৫ আগস্টের আগেই এটি ঘোষণা করা হতে পারে।
যদিও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সরকার ব্যর্থ হলে ৩ আগস্ট তারা তাদের নিজস্ব বিকল্প ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি ছিল অভ্যুত্থানকারীদের। সে লক্ষ্যে গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই ঘোষণা দেওয়ার কথা থাকলেও সরকারের হস্তক্ষেপে তা স্থগিত করতে হয়। এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ঘোষণা না আসায় গত ২৯ জুন এক সভায় এনসিপি ঘোষণা দেয়, আগামী ৩ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তারা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করবে।
ওই সভায় দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো ঘোষণা প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ছাত্র-জনতার ঐক্যে এনসিপি নিজ উদ্যোগেই এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবে। তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘জুলাই মার্চে’ অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই এ ঘোষণা তৈরি হয়েছে এবং এতে জনগণ ও শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।
জানা যায়, এ বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে। এরই মধ্যে জুলাই ঘোষণার একটি খসড়াও তৈরি করে তা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির কাছে সরকার এই প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বিএনপি তাদের মতামত সরকারের কাছে পাঠিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে। তারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে তাদের মতামত সরকারের কাছে পাঠাবে। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘আমরা একটি প্রস্তাব পেয়েছি। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে পাঠাব। সব দলের মতামত নিয়েই এটি চূড়ান্ত করা উচিত।’
তবে অনেক দল এ বিষয়ে এখনো অন্ধকারে আছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বাম দলের অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁদের কিছুই জানানো হয়নি। ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আমাদের তেমন কিছু জানা নেই। আমাদের কাছে কিছু পাঠানো হয়নি।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের আলোচনা অনেক দিন ধরেই চলছে। তবে এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সিপিবির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। ঘোষণাপত্র করতে হলে তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই করতে হবে।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, খসড়া প্রণয়ন করতেও হলে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হওয়া দরকার। এখনো বাসদকে কিছু জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘অন্য কোনো দলের কাছে পাঠানো হলেও জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া আমাদের কাছে পাঠানো হয়নি। এটি প্রণয়ন করা সময়সাপেক্ষ বিষয়। খসড়া পেলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত দেওয়া হবে।’
বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, ‘গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের স্বীকৃতির জন্য জুলাই ঘোষণাপত্র প্রয়োজন। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা এখনো অন্ধকারে।’ গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই এটি প্রণয়ন করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জানা যায়, জুলাই ঘোষণার খসড়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলকে একনায়কতান্ত্রিক ও গণবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, সংবিধান একপক্ষীয়ভাবে সংশোধনে সব কিছুই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ও শাসনব্যবস্থার বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে গণ-অভ্যুত্থান ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রস্তুত করে। খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম। আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করা হবে, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।’
এতে আরো বলা হয়, ‘আমরা এই ঘোষণা প্রদান করলাম যে, ১৯৭২ এবং ১-১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণসমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। আমরা এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম যে এই ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।’ এ ছাড়া ঘোণাপত্রের খসড়ায় প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ (দ্বাদশ সংসদ) ভেঙে দেওয়ার এবং ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথাও উল্লেখ করা হয়।
গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এই উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে জানায়। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ওই রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়।
জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে গত ১৬ জানুয়ারি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।