এলাকায় এখন সবাই তাঁকে ‘সমন্বয়ক রানা’ নামেই ডাকে। জানা গেছে, জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইদুর রহমানের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত এই হামিদুর রহমান রানা। সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে ভারতীয় সীমান্তবর্তী উপজেলা মহেশপুরে একের পর এক অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, পুড়াপাড়া পশুর হাট থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়, নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে কমিশন ও চাল বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মহেশপুর পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকার বরাদ্দ আছে। এই কাজের ঠিকাদারি নিয়ে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী সোহেল রানার সঙ্গে হামিদুর রহমান রানার বনিবনা হচ্ছিল না। পৌরসভার কাজ বণ্টনের জন্য গত ২২ জুলাই দুপুরে জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবকে নিয়ে মহেশপুরে গিয়ে জনরোষে পড়েন রানা ও অন্যরা। ওই সময় আরেকটি পক্ষ তাঁদের অবরোধ করে রাখে। পরে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে রেহাই পান তাঁরা। রানার বিরুদ্ধে মহেশপুর সীমান্তে চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। সম্প্রতি মহেশপুর উপজেলা প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদাও দাবি করেন রানা। চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ওই কর্মকর্তাকে মবের ভয় দেখান রানা। পরে ভয়ে ওই কর্মকর্তা অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান।
জেলা জুলাই যোদ্ধা সংসদের মুখ্য সংগঠক মেহেদী হাসান বাপ্পী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের লড়াই-সংগ্রামের সময় আমি মাঠে কখনো রানাকে দেখিনি। হঠাৎ একদিন জানতে পারি, সে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা হয়েছে। এর পর থেকে মহেশপুরের বিভিন্ন স্থানে সমন্বয়ক পরিচয়ে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে সে। এ নিয়ে আমরা একাধিক দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোনো ফল পাইনি। তার অপকর্ম নিয়ে প্রতিবাদ করলে উল্টো আমাদের হামলা-মামলার ভয় দেখায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘রানা আগে টাকার অভাবে চলতে পারত না। এখন সে লাখ লাখ টাকার মালিক বনে গেছে। দামি মোটরসাইকেলে চড়ে। এলাকায় বেশ কয়েক বিঘা জমি কিনেছে বলেও শোনা যাচ্ছে। সে মূলত চাঁদাবাজিসহ সীমান্তে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে অল্প দিনে অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছে।’
মহেশপুর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, ‘সমন্বয়ক রানা আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে পৌরসভার ঠিকাদারির কাজ বাগিয়ে নিতে চায়। গত ২২ জুলাই একটি দরপত্রের কাজের ভাগ নেওয়ার জন্য তার সংগঠনের জেলা নেতাদের আমাদের এখানে নিয়ে এসেছিল। পরে আরেকটি গ্রুপের হস্তক্ষেপে তারা পালিয়ে যায়।’ মহেশপুরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খাদিজা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। তবে লোকমুখে সমন্বয়ক রানার অপকর্মের কথা শুনেছি। কেউ তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত হামিদুর রহমান রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে আমার অবস্থান তুলে ধরেছি। আমাদের সঙ্গে এখন বিভিন্ন মানুষ শত্রুতা করছে।’
‘ছোড’ চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি হবিগঞ্জবাসী : এদিকে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন হবিগঞ্জবাসী। শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই চাঁদাবাজদের ভয়ে তটস্থ। বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে দিতে হচ্ছে চাঁদা। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিল্প-কারখানার মালিকরাও এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। জেলা শহরে এক সমন্বয়কের চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় ছুরিকাঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, এই চাঁদাবাজরা হঠাৎ করেই চাঁদাবাজিতে নেমেছে। সংগঠনের জন্য, অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ দরকার—বলে তারা চাঁদা তুলতে তৎপর রয়েছে। এদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এলাকার লোকজন এখন কৌতুক করে তাই বলেন, অকন শুরু হইছে ছোড ছোড চাঁন্দাবাজদের যন্ত্রণা।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলা শাখার সমন্বয়ক এনামুল হক সাকিব শহরের উমেদনগরে চাঁদাবাজি করে আসছিলেন গত বছরের জুলাই থেকেই। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তাঁকে চাঁদাবাজি থেকে থামাতে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবু তাঁকে দমানো যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে সংগঠনের আরেক সমন্বয়ক সোহাগ গাজী রুখে দাঁড়ান। তিনি সাকিবের চাঁদাবাজি বন্ধে জনমতও গঠন করছিলেন। এক পর্যায়ে তাতে সংক্ষুব্ধ হয়ে সাকিব গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রাত ১টার দিকে দলবলসহ শহরের সিনেমা হল রোডে সোহাগ গাজীকে ছুরিকাঘাত করেন। ছুরিকাঘাতে আহত সোহাগকে পরে আধুনিক জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করান আশপাশের লোকজন। ওই অপরাধের জেরে চলতি বছরের গত ৬ মে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয় সাকিবকে। এরপর আরো কিছু অপরাধের তথ্য পেয়ে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে সাকিবকে শহরের চৌধুরী বাজার এলাকা থেকে গত ৬ জুলাই রাতে গ্রেপ্তার করে। সাকিব এখন হবিগঞ্জ কারাগারে রয়েছেন। সাকিব কারাগারে থাকলেও তাঁর অনুসারীরা চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে বলে ভুক্তভোগী অনেকে অভিযোগ করেছেন। তবে তাঁরা ভয়ে থানায় মামলা করতে পারছেন না।
হবিগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর মিয়া জানান, কিছুদিন আগে চার-পাঁচজন যুবক তাঁর দোকানে এসে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য অর্থ দরকার বলে চাঁদা দাবি করে। জাহাঙ্গীর চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়।
সমন্বয়ক পরিচয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকেও বিভিন্ন উপায়ে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে।
জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা নিবাসী মো. রিমন সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বারবার চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠলে রিমনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলা শাখার কোনো সম্পর্ক নেই বলে গত ৯ মে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে। গত ৪ মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অলিপুর প্রাণ কম্পানির কাছ থেকে চাঁদাবাজিসংক্রান্ত একটি চিঠি ছড়িয়ে পড়ে। তাতে লেখা ছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলা কমিটির শীর্ষ নেতারা।
জেলার চুনারুঘাটে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সমন্বয়ক পরিচয়ে এক যুবক লক্ষাধিক টাকা নেন এক ব্যক্তির কাছ থেকে। অর্থ নেওয়ার পর আট মাস পেরোলেও চাকরি জুটিয়ে দিতে পারেননি সেই ‘সমন্বয়ক’।
চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদের এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ছয় মাস ধরে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে প্রায় দিনই তাঁর কাছে কিছু যুবক তদবির করে থাকে।
সদ্য লুপ্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক আরিফ তালুকদার বলেন, ‘সমন্বয়ক পরিচয়ে যারা সেখানে চাঁদাবাজি করতে যাবে, তাদের আটকে রেখে পুলিশে দেওয়ার জন্য আমরা সবাইকে বলেছি। আমরা চাঁদাবাজিকে সমর্থন করি না।’ তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘কেউ যদি চাঁদাবাজি করতে আসে আপনারা সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করবেন। প্রয়োজনে আমাদের ডাকবেন, আমরা শক্ত হাতে বিষয়টি দেখব।’
চাঁদাবাজি পরিস্থিতির বিষয়ে হবিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম শাহাবুদ্দিন শাহীন বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। পরিস্থিতি আমাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে।’