আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। যদি কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবে।
১৭৭৬ সালে আমেরিকান বিপ্লবের সময় দেশটির রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস তাঁর প্রভাবশালী পুস্তিকা ‘থটস অন গভর্নমেন্ট’-এ আনুপাতিকতার প্রথম প্রস্তাবনাগুলি দিয়েছিলেন। তবে আধুনিক বিশ্বে সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আর বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি দেশ, অর্থাৎ প্রায় ৫৪ শতাংশ রাষ্ট্র, তাদের আইনসভা নির্বাচনে কোনো না কোনো ধরনের পিআর পদ্ধতি অনুশীলন করে। মূলত উন্নত বিশ্বে পিআর পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বেশি। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডির ৩৬টি সদস্য দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে এই ব্যবস্থা প্রচলিত। তবে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নের একাধিক উপায় রয়েছে। প্রধান তিনটি উপায় হলো—মুক্ত তালিকা, গোপন তালিকা ও মিশ্র পদ্ধতি।
আরেকটি তথ্যৈ দাবি করা হয়েছে, তালিকাভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনীব্যবস্থা ৮৫টি দেশে রয়েছে। মিশ্র সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনীব্যবস্থা সাতটি দেশে ব্যবহৃত হয়।
আর একক স্থানান্তরযোগ্য ভোটদান, যা আয়ারল্যান্ড, মাল্টা, অস্ট্রেলিয়ার সিনেট ও ভারতের রাজ্যসভা সদস্য নির্বাচনে ব্যবহৃত হয়।
মোটামুটিভাবে ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি (আংশিক); এশিয়ায় ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া ও নেপাল; আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া; লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা এবং উত্তর আমেরিকায় আংশিকভাবে কানাডার পিআর পদ্ধতিই আলোচনার দাবি রাখে। তবে বিশ্বে পিআর পদ্ধতির একটি ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে ইসরায়েল, যেখানে পুরো দেশই একক ভোট এলাকা। যে দল মাত্র ৩.২৫ শতাংশ ভোট পায়, তারাও আসন পায়। এতে ছোট দলগুলো সব সময় সংসদে প্রবেশ করে।
কিন্তু এ পদ্ধতির কারণে দেশটির সরকার নানা ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জটিলতার মুখে রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, পিআর পদ্ধতি মোটেও জাদুর কাঠি নয়। সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাংবিধানিক সংস্কার ও জনসচেতনতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা বিবেচনায় ধাপে ধাপে আংশিকভাবে পিআর পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হতে পারে, যাতে করে ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই ও ন্যায্য নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তোলা যায়। ‘পিআর’ বিষয়ে একটি বহুল প্রচারিত মত, এটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সরকারে যেতে সাহায্য করে। কিন্তু বেশির ভাগ গবেষণাই দেখিয়েছে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিরা খুব সামান্যই নিজ নিজ গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত হয়।
বিশ্বমানের ডাকসাইটে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফ্রেজার ইনস্টিটিউটের মতো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিদ্ধান্ত দিয়েছে পিআর পদ্ধতিকে যতটা ন্যায্য ও সাম্যবাদী মনে হয়, ততটা মোটেই নয়। বরং পৃথিবীর যে দেশেই পদ্ধতিটির প্রয়োগ রয়েছে, সে দেশেই শাসনতান্ত্রিক জটিলতা না কমে বরং বেড়েছে। হানাহানি, বিভাজন, সংকীর্ণতা, অনৈক্য ও ক্ষুদ্র স্বার্থের লড়াই বেড়েছে।
বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতির দিকে নজর দিচ্ছে কিছু রাজনৈতিক দল, যেমন—জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টি। তবে বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে। পিআর পদ্ধতিতে এমপির সঙ্গে সরাসরি ভোটারের সম্পর্ক থাকে না। ভোটার শুধু ভোট দেন। আর নেতা নির্বাচন করে দল। অথচ এখনো বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ দিনশেষে মার্কা দেখেই ভোট দেন। তাই পিআর পদ্ধতি তাদের মাঝে অধিকতর হতাশার জন্ম দিতে পারে।
অনুন্নত দেশে পিআর পদ্ধতির সবচেয়ে বাস্তব সমস্যা হলো—প্রায়ই জোট সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য থাকে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো—পিআর ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের প্রতি জনগণের প্রত্যক্ষ চাপ বা জবাবদিহি কম থাকে। এই ব্যবস্থা কোনো দেশ বা সমাজের মধ্যে জাতিগত, ধর্মীয়, আঞ্চলিক বা সম্প্রদায়গত বিভাজন বাড়িয়ে তুলতে পারে। কারণ এ ব্যবস্থায় বিশেষ সম্প্রদায়ভিত্তিক দলগুলো সহজেই সংসদে প্রতিনিধিত্ব পেতে পারে, যা বিভাজনমূলক রাজনীতির জন্ম দেয়। বিশেষত এই ব্যবস্থায় ছোট দলগুলো অনেক সময় অতিরিক্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তারা জোট সরকারের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এসব দল তখন নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করতে পারে এবং বড় দলগুলো বাধ্য হয় তাদের শর্ত মানতে। হালে পিআর পদ্ধতির কারণে ইতালিতে বারবার সংকট তৈরি হয়েছে।
এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ছোট দলগুলো জোট সরকারের জন্য অনেক অন্যায্য শর্ত আরোপ করতে পারে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সময় ব্যাঘাত ঘটে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে ওঠে এবং বারবার জোট সরকার গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। একই সঙ্গে পিআর ব্যবস্থা সরাসরি ভোটিং প্রক্রিয়ার তুলনায় কিছুটা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা ও আসন বণ্টনের জন্য জটিল হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন হয়, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরো দীর্ঘায়িত করে এবং নির্বাচনী ব্যয়ও বাড়ায়।
আবার পিআর পদ্ধতিতে এককভাবে ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে সরকার গঠন সম্ভব হয় না। ফলে ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জোট সরকার গঠন করতে হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি একটি নতুন ধারণা। তবে পদ্ধতিটি এখনো বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য কি না, সেই প্রশ্নের সুরাহা এখনো হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলোই পিআর পদ্ধতি অনুসরণে লাভবান হয়, অনুন্নত দেশগুলো সহজে জটিলতা এড়াতে পারে না।