আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার ঘাটতি ও দুর্বল তদারকির ফলে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণের বোঝা। চলতি বছরের গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গতকাল রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এরপর মাত্র তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
এই ঋণের হার এখন দাঁড়িয়েছে মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪.১৩ শতাংশে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় বিপজ্জনকভাবে বেশি।
এক দশকে ২০ গুণ বৃদ্ধি
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই জায়গা থেকে বর্তমানে তা প্রায় ২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে চার লাখ কোটির ঘরে পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রশ্রয়, অদক্ষ তদারকি ও শিথিল নীতির ফলে এই চিত্র তৈরি হয়েছে।
২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, গত সরকার খেলাপি ঋণ নানাভাবে লুকিয়ে রেখেছিল। এসব খেলাপি ঋণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এটা বেড়ে ৩০ শতাংশ হতে পারে। সেই হিসাবে প্রতি তিন মাসে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির চিত্র তুলে আনার সময় এর পরিমাণ বাড়ছে।
গোপন খেলাপি এখন প্রকাশ্যে
বিশেষজ্ঞদের মতে, এত দিন ধরে ঋণ পুনঃ তফসিল, ভুল নীতিমালার কারণে রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক খেলাপিকে নিয়মিত হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই সুবিধাগুলো স্থগিত হলে বাস্তব চিত্র বেরিয়ে আসছে।
শীর্ষ গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ
সরকারি দল ঘনিষ্ঠ কিছু গ্রুপ বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা অব্যবহৃত অথবা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে এস আলম, বেক্সিমকোসহ বেশ কটি গ্রুপ এখন খেলাপির তালিকায়। কেউ কেউ জেলে, অনেকে বিদেশে পালিয়ে আছেন।
রাজনৈতিক আশীর্বাদ ও বিশেষ ছাড়ে এদের বছরের পর বছর ধরে নিয়মিত হিসাবভুক্ত করা হয়েছিল।
ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা
ব্যাংকাররা বলছেন, গুটি কয়েক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে গিয়ে গোটা ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট করা হয়েছে। এতে নতুন ঋণ বিতরণে গতি হ্রাস পাচ্ছে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন অর্থায়ন থেকে এবং সাধারণ আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা সংকট বাড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা পরিচালক হেলাল আহমেদ জনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত দেড় দশকে দেশের যেসব অর্থনৈতিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংক খাত। আইন তৈরি করে রাজনৈতিক উদ্দেশে কিছু গ্রাহককে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। নামে-বেনামে বের হয়ে গেছে ব্যাংকের ঋণ। সেগুলো এখন আর ফেরত আসছে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী ব্যাংকের পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে তাঁদের মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় কখনো বেনামে আবার কখনো অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এই নিয়মের একটি দুর্বল দিক হলো অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কোনো সীমা না থাকা। যেটাকে কাজে লাগান তাঁরা। আবার এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণ নেন। বছরের পর বছর ধরে এমন ঘটনা ঘটলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যাঁরা দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক খাতকে রক্ষা করতে হলে এখনই শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।’