মানবিক করিডর একটি স্পর্শকাতর বিষয়। দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোনো কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না। দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ইস্যুতে সেনাবাহিনী আপসহীন। এ ছাড়া সরকার ও সেনাবাহিনী একে অপরের বিপরীতে দাঁড়ায়নি এবং দেশের জন্য মানুষের কল্যাণে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
সেনা সদরের ব্রিফিং
মানবিক করিডরের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না
- দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ইস্যুতে আপস নেই
- সরকার ও সেনাবাহিনী একে অপরের বিপরীতে দাঁড়ায়নি
- ৩০ হাজার ইউনিফর্ম কেএনএফের কি না গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে
- কখনোই বর্ডার কম্প্রোমাইজ করা হবে না
- পুশ ইন কোনোভাবেই কাম্য নয়
নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে সেনা সদরের পক্ষে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এবং সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম।
করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে বলে অনেকের ধারণা, সেই চ্যালেঞ্জ সেনাবাহিনী আমলে নিচ্ছে কি না এবং চ্যালেঞ্জ নিলে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন—এমন প্রশ্নে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এমন কোনো কাজে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না।’
নির্বাচন ও করিডর নিয়ে সেনাবাহিনী ও সরকার মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান দেখছি না।
করিডরের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না এবং এ বিষয়ে সেনাবাহিনী কী ভাবছে—এমন আরেক প্রশ্নে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘করিডরের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এটা আমাদের দেশ, আমাদের সবার দেশ।
করিডর ইস্যুতে এবং সীমান্তে আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) চলাচল বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নাজিম-উদ-দৌলা আরো বলেন, ‘যেভাবে কথা আসছে যে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিশাল মতপার্থক্য হয়েছে, বিভেদ রয়েছে, মিডিয়ায় বিষয়টি যেভাবে আসছে, এ রকম আসলেই কিছু হয়নি। সরকার ও সেনাবাহিনী খুব সুন্দরভাবে একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করছে।
চট্টগ্রামের একটি কারখানায় সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফের ৩০ হাজার পোশাক পাওয়ার বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘কেএনএফ মূলত বম কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠন। পোশাক পাওয়ার সংবাদটি একটি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ। সংগঠনটির অস্ত্রের ব্যবহার আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখছি। তাদের আক্রমণে আমাদের কয়েকজন সেনা সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন এবং আহতও হয়েছেন। সেই প্রেক্ষাপটে নিশ্চয়ই এটা ভালো কোনো খবর নয়। ৩০ হাজার ইউনিফর্ম পাওয়ার ছবি দেখার পর আমরা সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেছি—এ বিষয়ে আমাদের জানতে হবে। এ পোশাক কাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, সেটা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এটা নিয়ে এরই মধ্যে কাজ চলছে। এই সংগঠনের সঙ্গে অন্যদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বম কমিউনিটির জনসংখ্যা মাত্র ১২ হাজার। সুতরাং এই ৩০ হাজার ইউনিফর্ম কেএনএফের জন্য ছিল কি না, সেটা খুঁজে দেখার সুযোগ আছে। বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি। বিষয়টি দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। বিষয়টিকে আমরা হালকাভাবে নিইনি, তা নিশ্চিত করে বলতে পারি। এ ব্যাপারে যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার আমাদের দায়িত্বের মধ্যে যেটা পড়ে, সেটা আমরা করব।’
বাংলাদেশ একটা ছায়া যুদ্ধের মধ্যে আছে, সেটা বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হচ্ছে। আরসা বাংলাদেশের লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশে ঢুকে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অনেক সময় বিভিন্ন মাধ্যমে খবর আসছে তাদের কাছে ভারি অস্ত্র আছে, তাদের কাছে এই অস্ত্র কোথা থেকে আসছে? আসলে বর্ডার কি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, নাকি আমরা বর্ডার কম্প্রোমাইজ করেছি—এমন প্রশ্নের জবাবে এই সেনাকর্মকর্তা বলেন, ‘যদি এক লাইনে উত্তর দিতে চাই অবশ্যই আমরা বর্ডার কম্প্রোমাইজ করিনি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের গায়ে বিন্দুমাত্র শক্তি থাকবে আমরা কখনোই বর্ডার কম্প্রোমাইজ করব না। এটা আমাদের দেশ, আর দেশকে আমরা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করব।’
তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দেশ, এটা আপনার দেশ। কোনো একটা সম্প্রদায়ের মাধ্যমে এই দেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হতে পারে, সেটা কখনোই হবে না। বাংলাদেশ ও মায়ানমার বর্ডার অত্যন্ত জটিল একটি পরিস্থিতির মুখে আছে। মায়ানমারের সরকারের অস্তিত্ব বিলীনের মুখে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যটিকে প্রায় দখল করে নিয়েছে। তাদের দখলে রাখাইন রাজ্যের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ রয়েছে। আরাকান আর্মি কোনো অথরাইজ সংগঠন নয়। এই জায়গায় না আছে কোনো সরকারের অস্তিত্ব, না আছে আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের বর্ডারে যে পরিস্থিতি তা যেকোনো সময়ের তুলনায় সংবেদনশীল। সে ক্ষেত্রে এই সময়ে ওই এলাকায় কিছু সশস্ত্র গ্রুপের মুভমেন্ট করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার মানে এই নয় যে, এটাকে আমরা স্বীকৃতি দেব বা দেখেও না দেখার ভান করব।’
তিনি জানান, এই ধরনের ঘোলাটে পরিস্থিতিতে এ ধরনের মুভমেন্ট হতে পারে। তবে অবশ্যই এই মুভমেন্টটি উদ্বেগের বিষয় এবং কাঙ্ক্ষিত নয়। এই সীমান্তে সেনাবাহিনীর সাপোর্ট নিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নজরদারি রয়েছে।
ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে নাগরিকদের ‘পুশ ইন’ প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার নাজিম বলেন, ‘এটি কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমানে বিজিবি সীমান্তে বিষয়গুলো মোকাবেলা করছে। তবে যদি কোনো কারণে প্রয়োজন হয় বা সরকার আদেশ দিলে এ বিষয়ে সেনাবাহিনীও কাজ করবে।’
অতি সম্প্রতি অফিসার্স অ্যাড্রেসে নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস নিতান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং গণমাধ্যমে আপনারা যা জানতে পারছেন, এটার সঠিকতা নিয়ে বিবেচনার দাবি রাখে। যদি আমরা কাউকে জানাতে চাইতাম তাহলে আপনাদের (সাংবাদিকদের) ডাকতাম এবং আইএসপিআর বিবৃতি দিত। আমরা কিন্তু এগুলো কিছুই করিনি। এটা আমাদের রেগুলার রুটিন অ্যাপিয়ার। সেনাবাহিনী প্রধান প্রায়ই আমাদের সঙ্গে কথা বলেন, দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন।’
আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। আর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার কোনো ইচ্ছা বা এ ধরনের কোনো আলোচনা আমাদের মধ্যে হয়নি। এ বিষয়ে আমরা কোনো তথ্য দিতে পারছি না।’
এর আগে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর থেকে সেনাবাহিনী দেশের স্বার্থে সবার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে।’ মব তৈরির বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘কেউ যদি মব তৈরি করে বিশৃঙ্খলা করতে চায়, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সেনাবাহিনী।’
ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ৪০ দিনে সেনাবাহিনী ২৪১টি অবৈধ অস্ত্র ও ৭০৯ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৯ হাজার ৬১১টি অবৈধ অস্ত্র ও দুই লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া গত এক মাসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট এক হাজার ৯৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সর্বমোট ১৪ হাজার ২৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে কিশোর গ্যাং, তালিকাভুক্ত অপরাধী, অপহরণকারী, চোরাচালানকারী, প্রতারক ও দালালচক্র, চাঁদাবাজ, ডাকাত ও ছিনতাইকারী উল্লেখযোগ্য।
ব্রিফিংয়ে আরো জানানো হয়, ৪০ দিনে যৌথ অভিযানে ৪৮৭ জন মাদক ব্যবসায়ী এবং আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চার হাজার ৪০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৪০ দিনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে।
এ ছাড়া বলা হয়, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত শিল্পাঞ্চল এলাকার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গত এক মাসে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ভেজাল শিশু খাদ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং বিপণনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া যশোর ও সাতক্ষীরা জেলায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ জেলি মিশ্রিত চিংড়িসহ সিন্ডিকেটের সদস্যদের আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের বিরুদ্ধে এমন অভিযান স্থানীয় জনগণের মাঝে স্বস্তির আস্থা সৃষ্টি করেছে।
সেনা সদর আরো জানায়, জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত চার হাজার ৫৯৬ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে, যার মধ্যে ৩৬ জন এখনো চিকিৎসাধীন।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঈদের আগে ও পরে মিলে দুই সপ্তাহের বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে নির্বিঘ্নে যান চলাচল নিশ্চিত করতে ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল ও মহাসড়কে দিনরাত টহল পরিচালনা, গাড়ির অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য স্পর্শকাতর স্থানে চেকপোস্ট স্থাপনসহ টিকিট কালোবাজারি অথবা অধিক দামে টিকিট বিক্রি রোধ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ঈদুল ফিতরের মতোই মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে জনসাধারণকে নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোসহ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘনভাবে ঈদ উদযাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা হবে।
কোরবানির পশুর হাটে চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তা বিধান নিয়ে ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর হাটকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়, মূল সড়কের পাশে পশুর হাটের অবস্থান হওয়ায় রাস্তাঘাটে যানজটের সৃষ্টি হয়; যার ফলে জনসাধারণের মাঝে দুর্ভোগ ও জানমালের নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনী নিয়মিত টহল ও বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে পশুর হাটে চাঁদাবাজি ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সচেষ্ট থাকবে।
সম্পর্কিত খবর

ট্রাম্পের নতুন বাজেট প্রস্তাব
যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন ২ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী
কালের কণ্ঠ ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল’ বিলের কারণে ২০ লাখের বেশি মার্কিন অভিবাসী এবং সে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন। একই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাস করা প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি অভিবাসীও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এই বিলের আওতায় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রায় এক লাখ কোটি ডলার কাটছাঁট করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে নথিপত্রহীন মানুষজন স্বাস্থ্যসেবা হারাবেন।
ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, মিশিগানসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে চার লাখের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করেন।
জানা গেছে, মেডিকেইড ও স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য সহায়তার প্রোগ্রাম এসএনএপি থেকে প্রায় ৭৯ হাজার ৩০০ কোটি ডলার, অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট থেকে ৩০ হাজার কোটি ডলার এবং মেডিকেয়ার থেকে কাটছাঁট করা হবে ৫০ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ বছরের বেশি প্রবীণ ব্যক্তিদের অনেকেই মেডিকেইডের ওপর ভিত্তি করে জীবন যাপন করেন। হোম কেয়ার, নার্সিং কেয়ার, ওষুধপত্রের ব্যয় সরকারি মেডিকেইডের খাত থেকে পেয়ে থাকেন তাঁরা। সূত্র : এপি

প্রবাসীদের ভোট
৪৯ কোটি টাকার প্রকল্পে অস্পষ্টতা সমন্বয়হীনতা
এম আর মাসফি

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে চায় সরকার। পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের এই উদ্যোগকে সময়োপযোগী বলে মনে করা হলেও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পাঠানো উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) রয়েছে নানা অস্পষ্টতা, সমন্বয়হীনতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি। কোন কোন দেশ থেকে ভোট নেওয়া হবে, কত ভোটারকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিংবা বিদেশে ভোটগ্রহণে কূটনৈতিক সহযোগিতার পরিকল্পনা—এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রস্তাবে স্পষ্ট নয়। এতে প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন নিজেই প্রশ্ন তুলেছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের লক্ষ্যে ‘দেশের বাইরে ভোটদান সিস্টেম উন্নয়ন এবং বাস্তবায়ন’ শীর্ষক প্রকল্প প্রস্তাব করেছে ইসি। প্রকল্পের আওতায় ভোটিং সিস্টেম উন্নয়ন, অনলাইন ভোটিং সফটওয়্যার ডেভেলপ, নিরাপত্তা যাচাই এবং পোস্টাল ভোটিং (আইটি সাপোর্টেড) পদ্ধতি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ, যার প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ ভোটার বিদেশে অবস্থান করছেন।
প্রস্তাব অনুযায়ী, ডাক বিভাগের সহযোগিতায় পোস্টাল ব্যালট পাঠানো হবে বিদেশে অবস্থানরত নিবন্ধিত ভোটারের কাছে।
তবে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রস্তাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।
ব্যয় প্রাক্কলনেও অসংগতি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এসব বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, অস্পষ্ট বিষয়গুলো সংশোধন করে, ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করে এবং আন্ত মন্ত্রণালয় সমন্বয়ের বিষয় যুক্ত করে ডিপিপি পুনর্গঠন করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুর রউফ কালের কণ্ঠকে জানান, প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রস্তাবে বেশ কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। সেগুলো সংশোধনের পর পুনর্গঠন করা হবে।
ইসির পরিকল্পনা উন্নয়ন ও গবেষণা বিভাগের উপপ্রধান মুহম্মদ মোস্তফা হাসান বলেন, প্রথম ধাপে ৫০ লাখ প্রবাসী ভোটারের ভোটগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পিইসি সভার কার্যবিবরণী হাতে পেলে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপিপি সংশোধন করা হবে।
ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, প্রকল্পের মূল লক্ষ্য একটি স্থায়ী সিস্টেম গড়ে তোলা। কতজন ভোট নেবে বা কখন ভোট সংগ্রহ হবে, সেটি ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়নি। কারণ বাস্তবায়ন পর্যায়ে তা নির্ধারণ হবে। তাঁর মতে, বিদেশে ভোটগ্রহণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সীমিত থাকবে, মূলত ডাক বিভাগই দায়িত্ব পালন করবে। পোস্টাল ব্যালটে ভোটগ্রহণের জন্য আরপিও সংশোধনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হবে। তবে নিরাপত্তা, সময়মতো ব্যালট পৌঁছানো, পরিচয় যাচাই এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পোস্টাল সিস্টেমে ব্যালট পাঠানো ও ফেরত আনার দীর্ঘ সময়, বিদেশি সরকারের অনুমতি এবং প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা—সবই জটিল বিষয়।
তাদের পরামর্শ, প্রকল্প বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডাক বিভাগ ও তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের ঘনিষ্ঠ সমন্বয় প্রয়োজন। একই সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ তৈরি, পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু এবং বিদ্যমান আইন, জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭২ ও ভোটার তালিকা আইন-২০০৯-সংশোধন অপরিহার্য।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রবাসীদের ভোটগ্রহণের উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে প্রকল্প প্রস্তাবে থাকা অস্পষ্টতা, ব্যয়ের অসংগতি এবং আন্ত মন্ত্রণালয় সমন্বয়ের অভাব সমাধান না করলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা আসতে পারে।

গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা ভয়ংকর
- সক্রিয় ছিনতাইকারীচক্র ‘ডেঞ্জার গ্রুপ’, ‘হানি ট্র্যাপ’ ও ‘টানা পার্টি’
শরীফ আহমেদ শামীম, গাজীপুর ও শরীফ শাওন, ঢাকা

‘ডেঞ্জার গ্রুপ’, ‘হানি ট্র্যাপ’ ও ‘টানা পার্টি’—এই তিন ছিনতাইকারীচক্র ভয়ংকর হয়ে উঠেছে গাজীপুর মহানগরের চান্দনা চৌরাস্তায়। নারীদের সমন্বয়ে গঠিত চক্রের সদস্য অর্ধশতাধিক। এই চক্রের ‘ডেঞ্জার গ্রুপের’ সদস্যদের হাতেই গত বৃহস্পতিবার রাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন।
জানা গেছে, ‘টানা পার্টি’ পথচারী ও বাসযাত্রীদের ভ্যানিটি ব্যাগ, মানিব্যাগ, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি ছোঁ মেরে নিয়ে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যায়।
চান্দনা চৌরাস্তায় স্থানীয়রা জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে নানা কাজে চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। গাজীপুরে বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরাও চৌরাস্তা হয়ে যাতায়াত করেন।
সূত্র জানায়, হানি ট্র্যাপের সসস্যদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এক ডজনের বেশি সুন্দরী তরুণী। কারো কাছে টাকা বা মূল্যবান কিছু থাকলে তারা টার্গেট করে। টার্গেট করা ব্যক্তিকে তরুণী দিয়ে হানি ট্র্যাপে ফেলে মারধর করে মানিব্যাগসহ জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হয়।
এদিকে ডেঞ্জার গ্রুপের দলনেতা গাজীপুর মহানগরের বাসন থানার মোগরখাল এলাকার মিজান ওরফে কেটু মিজান (৩৪)। খুন, ডাকাতি, ছিনতাইসহ ১৫ মামলার আসামি তিনি। এই মিজান ২৪ ঘণ্টাই মাতাল থাকেন। তাঁর স্ত্রী পারুল ওরফে গোলাপি বেগমও (২৮) হানি ট্র্যাপের সদস্য। তাঁর গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে দুই মামলার আসামি স্বাধীন (২৮), সাত মামলার আসামি ফয়সাল (২৩), দুই মামলার আসামি আল আমিন (২১), আট মামলার আসামি শাহজালাল (৩২), সুমন ওরফে সাব্বির (২৩), কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার লিটন (২৪), সানি (১৬), আকাশ (১৬) ও ইয়াছিন (১৭)। সাংবাদিক তুহিন হত্যা মামলায় শুক্রবার রাতে শহরের শিববাড়ী থেকে স্বাধীনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১-এর গাজীপুর ক্যাম্পের একটি দল।
তা ছাড়া নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার আশরাফুল (১৯), বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের রাকিব (১৮), ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানার কৃষ্ণপুর এলাকার শাকিব হোসেন (২৫), তারাকান্দা থানার রাকিব (২২), মিনারুল ইসলাম (২২), রাজু ওরফে পিনিক রাজু (২১), ফজলু ওরফে তোতলা ফজলু (৩২), মিলন হোসেন (২৩), শহিদুল ওরফে নবাব (২৪), মোবারক (১৯), মামুন (২৪), সিরাজুল ইসলাম সিফাত (২১), দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু (২৮) ও রিপন মিয়াও (২৮) রয়েছেন ছিনতাইকারী দলে। তাঁদেরও আলাদা দলনেতা রয়েছে। তবে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে গাজীপুর মহানগরের বাসনসহ বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। আগে গ্রেপ্তার হয়ে একাধিকবার জেল খেটেছেন সবাই। বাসন থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুর মহানগরের তেলিপাড়ায় বাবার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে ফিরছিলেন দুই যুবক। চান্দনা চৌরাস্তায় পৌঁছলে ছিনতাইকারীরা গাড়ি থামিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লাশবাহী গাড়ির যাত্রীদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। পরে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হন ফয়সাল। তিনি পাবনার চাটমোহরের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে। তার আগে ২১ ফেব্রুয়ারি বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দিনাজপুর যাওয়ার পথে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে একটি পরিবার। লাশ আনতে যাওয়ার কথা বলেও রক্ষা পায়নি তারা। ভুক্তভোগীরা তাৎক্ষণিক পুলিশের সহযোগিতায় অন্য একটি গাড়িতে গন্তব্যে রওনা করেন।
ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম রাজ বলেন, দিন দিন ছিনতাইকারীদের রাজ্যে পরিণত হয়েছে চান্দনা চৌরাস্তা। এসব ছিনতাইকারীর অনেকেই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। পুলিশ অনেক সময় তাদের গ্রেপ্তার করে। কয়েক দিনের মধ্যেই তারা জামিনে বেরিয়ে এসে ফের ছিনতাইয়ে জড়ায়। সাংবাদিক তুহিন খুনের দিন সন্ধ্যায় এই চক্রের সদস্যরা এক অটোচালককে পিটিয়ে তাঁর অটো ছিনতাই করে নিয়েছে। নেশাগ্রস্ত থাকায় সামান্য কারণেই তারা কুপিয়ে সব লুটে নেয়। অটোচালক বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘অনেক সময় চোখের সামনেই ছিনতাই হয়। দেখি কিন্তু কিছু বলতে পারি না।’ ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় গত বছর চান্দনা চৌরাস্তার বনরূপা সড়কে তানজিলা আক্তার (৩৮) নামের এক পোশাক শ্রমিককে ছুরিকাঘাতে খুন করে ছিনতাইকারীরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চান্দনা চৌরাস্তায় ছিনতাইয়ে জড়িতদের প্রায় সবাই অন্য জেলা থেকে আসা। তারা আশপাশের এলাকায় ভাড়া থাকে। অনেকে শিশুকাল থেকেই নানা অপরাধে জড়িয়ে বড় হয়েছে। প্রায়ই ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। কিন্তু সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। তাদের কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আইনজীবী রয়েছেন। টাকা না দিলেও তাঁরা জামিনের ব্যবস্থা করে দেন। পরে কিস্তিতে টাকা নেন তাঁরা। সহজে জামিন না পেলে ছিনতাই রোধ করা সহজ হতো।’
বাসন থানার ওসি মো. শাহীন মিয়া বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশির ভাগ পথচারী বা ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করেন না। এ জন্য অনেক সময় বিষয়টি পুলিশ অবগত থাকে না। তার পরও অপরাধীদের ধরতে চান্দনা চৌরাস্তায় নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।
সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ড ঘটে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার ঈদগা মার্কেটে। গতকালও সেখানে ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করে। প্রায় সবার মুখেই ভয়াল হত্যাকাণ্ড নিয়ে ছিল আলোচনা। ঈদগা মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে বলেন, যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তারা চিহ্নিত ছিনতাইকারী। এর মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক অভিযোগ রয়েছে। প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্রের মহড়া যেন নিয়মিত। জনবহুল এই স্থানে একজন সাংবাদিকদকে যেখানে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, সেখানে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা কতটা নিরাপদ?

সাংবাদিক তুহিন হত্যা
আগের ক্ষোভও খুনের আরেক কারণ
নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর

গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ডে নতুন করে আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে গত শুক্রবার ভোররাতে গাজীপুর মহানগরে অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি)। এ ছাড়া গতকাল শনিবার বিকেলে র্যাব-১৪ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের একটি দল এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শহীদুল ইসলামকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে ইটনা উপজেলা সদরের পুরান বাজার থেকে। পুলিশ ও র্যাব সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত শুক্রবার ভোররাতে গাজীপুর মহানগরে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার অনন্তপুরের হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে মো. শাহজালাল (৩২) এবং পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার পাঁচবাড়িয়ার কিয়ামুদ্দিনের ছেলে মো. ফয়সাল হাসান (২৩)। তাঁরা গাজীপুর মহানগরের চান্দনা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। গ্রেপ্তার শাহজালালের বিরুদ্ধে হত্যা, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অভিযোগে আটটি এবং ফয়সালের বিরুদ্ধে সাতটি মামলা রয়েছে।
গত শুক্রবার রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জামালপুরের মেলান্দহ থানার মাহমুদপুরের মোবারক হোসেনের ছেলে মিজান ওরফে কেটু মিজান (৩৪), একই জেলার মো. সুলাইমানের মেয়ে ও কেটু মিজানের স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপী (২৫), খুলনা মহানগরের সোনাডাঙ্গা থানার ময়লাপোতার মো. হানিফের ছেলে মো. আল আমীন (২১), শেরপুরের নকলা থানার চিতলিয়ার আব্দুস সালামের ছেলে সুমন ওরফে সাব্বির এবং র্যাব-১ পাবনা জেলার ফরিদপুর থানার সোনাহারা এলাকার মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে স্বাধীনকে (২৮)। জানা গেছে, কেটু মিজানের বিরুদ্ধে গাজীপুর মহানগরের বাসনসহ বিভিন্ন থানায় ১৫টি মামলা রয়েছে। এ নিয়ে গাজীপুরে গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়াল সাত।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু বাদশা মিয়াকে কোপানোর দৃশ্য ধারণ করার জন্যই নয়, ক্ষোভ থেকেও তুহিনকে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশ কমিশনারের দুঃখ প্রকাশ : গতকাল শনিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, ‘বাদশা মিয়াকে কোপানোর দৃশ্য ভিডিও করায় গ্রেপ্তারকৃতরা সাংবাদিক তুহিনকে হত্যায় অংশ নেন। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে তাঁদের শনাক্ত করা হয়। আরো কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দেখে নেওয়ার হুমকি : কেটু মিজানসহ সাত আসামিকে ব্রিফিংয়ের সময় জিএমপি কার্যালয়ে হাজির করা হয়। এ সময় সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে কেটু মিজান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘বেশি দিন জেলে থাকব না। বের হই, দেখে নিব।’ পরে পুলিশ দ্রুত তাঁকে সরিয়ে নেয়।
সাংবাদিক তুহিন খুনের দায় স্বীকার স্বাধীনের : সাংবাদিক তুহিন খুনে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ছিনতাইকারী স্বাধীন। গতকাল সকাল ১১টায় র্যাব-১-এর গাজীপুর ক্যাম্পে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান কম্পানি কমান্ডার এ কে এম এ মামুন খান চিশতি। তিনি জানান, ভিডিও ফুটেজ ও সোর্সের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে শুক্রবার রাতে গাজীপুর মহানগরের শিববাড়ী এলাকা থেকে স্বাধীনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বাধীন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবের কাছে সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন। এ সময় স্বাধীনকে উপস্থিত করা হলে দেখা যায়, তাঁর ঘাড়ে আঁকা উল্কিতে ইংরেজিতে ‘ডেঞ্জার’ লেখা রয়েছে।
গাজীপুরের বাসন থানার ওসি মো. শাহিন মিয়া জানান, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাত আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে শনিবার বিকেলে গাজীপুর মহানগর আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত প্রত্যেকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
ইটনা থেকে গ্রেপ্তার একজন : আমাদের কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকেলে র্যাব-১৪ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের একটি দল সাংবাদিক তুহিন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শহীদুল ইসলামকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে। জেলার হাওর অধ্যুষিত উপজেলা ইটনা সদরের পুরান বাজার থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল সন্ধ্যার দিকে তাঁকে কিশোরগঞ্জের র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার শহীদুল ইসলাম ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার মৃত আবদুল করিমের ছেলে। র্যাব-১৪ (সিপিসি-২) কিশোরগঞ্জের স্কোয়াড্রন লিডার মো. আশরাফুল কবির জানান, তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় অবস্থান শনাক্ত করে শহীদুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাংবাদিক তুহিনকে হত্যার পর শহীদুল ইটনায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। ধরা পড়ার পর তিনি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে র্যাবের কাছে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন। রাতে তাঁকে র্যাব-১-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার ঈদগাহ মার্কেটসংলগ্ন একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন সাংবাদিক তুহিন। এ সময় তিনি হামলার শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের গাজীপুর প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি দুই সন্তানের জনক।