কারো হাতে জাতীয় পতাকা, কারো কণ্ঠে বিজয়ের স্লোগান, কারো চোখে দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের আশা। গণভবনের প্রতিটি চত্বর, প্রতিটি বারান্দা, প্রতিটি করিডর তখন ইতিহাসের স্বাক্ষর হয়ে ওঠে।
শেখ হাসিনার প্রস্থান ছিল এক দীর্ঘ অধ্যায়ের যবনিকা। আর ছাত্র-জনতার প্রবেশ ছিল ভবিষ্যতের এক নতুন সকালের সূচনা।
ছাত্র-জনতা ক্ষোভে গণভবন থেকে টেলিভিশন, চেয়ার, সোফা, টেবিল ফ্যান, কম্বল, পানির ফিল্টার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ফ্রিজে রাখা মাছ-মাংস, খাবারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যায়। শেখ হাসিনা গণভবনে মাছ, ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতরসহ বিভিন্ন পশুপাখি লালন-পালন করতেন। সেগুলোও যে যার মতো করে নিয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা ও গণভবনের বিভিন্ন দায়িত্বে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৫ আগস্ট দুপুরের যে খাবার তৈরি করা হয়, সেই খাবারও খেয়ে নেয় আন্দোলনকারী অনেকে। তবে এসব জিনিস কিছু আবার ফেরত দেওয়ারও ঘটনা ঘটে।
শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সেদিন গণভবনের দেয়ালে অনেকে লিখে রাখে নানা বার্তা। যেমন—‘শেখ হাসিনা স্বৈরাচার’, ‘হাসু আপা পলাইছে’, ‘আবু সাঈদের রক্ত বৃথা যাবে না’, ‘শাপলা চত্বরের বিচার চাই’, ‘ফেনীতে ছাত্র হত্যার বিচার করব’, ‘হাসিনাকে জয়বাংলা করে দেওয়া হবে’, ‘কিলার হাসিনা’—এমন বহু স্লোগান এখনো রয়ে গেছে দেয়ালজুড়ে।
এসব স্মৃতি ধরে রেখে ভবনসহ ১৫ একরের বিশাল আয়তনে গড়ে তোলা হচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর। সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানিয়েছেন, গণভবন ছিল একটি ক্রাইম জোন। এখান থেকেই গুম-খুন ও নিপীড়নের পরিকল্পনা করা হতো। জাদুঘরের মাধ্যমে সেই ইতিহাসই সামনে আনা হবে। ভবনটিকে এমনভাবে সাজানো হবে, যাতে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলের বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।
গণভবনের গেটের সামনে এখনো নিরাপত্তাকর্মীরা দাঁড়িয়ে থাকেন। তবে আগের মতো কড়াকড়ি নেই। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে ১০ ফুট উঁচু বেড়া দিয়ে, বাইর থেকে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না। তবু সাধারণ মানুষ এখনো প্রতিদিন গণভবনের গেটে আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে ভিড় করে। ভবনের ভেতরকার চিত্র অবশ্য এখনো অগোছালো। নানা প্রান্তে ময়লার স্তূপ, মাঠে ও রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা আসবাব, যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী। বিশাল আঙিনা এখন যেন একটি নির্মাণকেন্দ্র। সেখানে কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক, কারিগর ও নকশাকার। কোথায় কী বসানো হবে, কোন দেয়ালে থাকবে কোন ছবি বা স্মারক, তা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
জুলাই স্মৃতি জাদুঘরের কাজ চলছে পুরোদমে, তবে এখনো শেষ হয়নি। শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা বিভাগের পরিচালক তানজীম ওয়াহাব কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট জনসাধারণের জন্য জাদুঘর খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। কাজের প্রায় ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকিটুকু শেষ হলেই নতুন তারিখ ঠিক করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
যা থাকবে জাদুঘরে : জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলার উদ্দেশে গড়ে তোলা হচ্ছে স্মৃতি জাদুঘর, যেখানে শুধু নিদর্শন নয়, উঠবে একটি প্রজন্মের প্রতিরোধ, ত্যাগ আর জাগরণের কাহিনি।
এই জাদুঘর হবে যেন এক টাইম মেশিন, যা দর্শনার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে দুঃশাসনের১৬ বছরের রাতগুলোতে।
প্রদর্শনীর প্রতিটি কক্ষে থাকবে জীবনের ছোঁয়া। শহীদদের রক্তমাখা জামা, প্রিয়জনকে লেখা চিঠি, আন্দোলনের সংবাদ ছাপা পত্রিকার পাতাগুলো, অডিও-ভিডিও দলিল, স্লোগান-বিষণ্নতা-বিজয়গাথার ধ্বনি। দর্শনার্থীরা দেখবে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সেই ভিডিও চিত্র, যা একদিকে একটি অধ্যায়ের ইতি, আবার অন্যদিকে এক নতুন শুরুর সংকেত।
জাদুঘরের মাটিতে তৈরি হচ্ছে প্রতীকী গণকবর। যেখানে মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানাবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম। আরো থাকবে আয়নাঘরের রেপ্লিকা।