জামা-ব্লাউজ, কাঁথা সেলাই করতেন। পড়াশোনায় মলি বরাবরই ভালো। এইচএসসি পর্যন্ত কখনো দ্বিতীয় হননি। বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু খরচের কথা ভেবে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হলেন। টিউশনি করে চালিয়েছেন খরচ। জিপিএ ৪.৮৮ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন পাকুটিয়া পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে।
সতেরোতেই স্বপ্নভঙ্গ : নবম শ্রেণিতে উঠতেই শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন বলে বিয়ের প্রস্তাব এলেই ‘না’ করে দিতেন মলি। ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষার মাস তিনেক আগে এক নিকটাত্মীয় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। ছেলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে, জুয়েলারির দোকান আছে। মেয়ে সুখে থাকবে ভেবে মা রাজি হয়ে গেলেন। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন—এই শর্তে রাজি হলেন মলি। ধারদেনায় জোগানো দেড় লাখ টাকা যৌতুকে বিয়ে হয়ে গেল।
অকারণে নির্যাতন : শিগগিরই সুখপাখি মরীচিকা হয়ে গেল। মলি জানলেন, এক মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক রয়েছে স্বামীর। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলত, ছেলেদের এমন এক-আধটু দোষ থাকে, ঠিক হয়ে যাবে।
বিয়ের পরে বন্ধ হয়ে গেল মলির কলেজে যাওয়া। বাবার বাড়ি আসাও বন্ধ। শাশুড়ি বলতেন, ‘বউ কাছে না থাকলে প্রেমিকার কাছে যাতায়াত বেড়ে যাবে ছেলের।’
তত দিনে এইচএসসি পরীক্ষা চলে এসেছে। বাবার বাড়ি থেকে পরীক্ষাকেন্দ্র ১০ মিনিটের পথ। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার যাতায়াত করে প্রতিটি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে মলিকে।
পরীক্ষা শেষে স্বামীর ব্যবসায় সাহায্য করতে লাগলেন। বিল-ভাউচার দেখতেন। খেয়াল করলেন, আয়-ব্যয়ের বিস্তর তফাত। মাস শেষে টানাটানি শুরু হয়। খোঁজ নিয়ে জানলেন, শুধু পরকীয়া নয়, স্বামী নেশাও করেন। এটা জানার পর থেকে অমানবিক নির্যাতন শুরু হয় বলে মলি জানান।
একের পর এক বাধা : এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পান মলি। আশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন। শাশুড়ি তা চাইলেও স্বামী চাননি বলে জানান মলি। অনেক অনুনয়-বিনয়ে স্থানীয় কলেজে ভর্তির অনুমতি মিলল। করটিয়া সাদত কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ষষ্ঠ হয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন।
স্বামী চাইতেন না মলি পড়াশোনা চালিয়ে যান। পড়তে দেখলেই বই ছিঁড়ে ফেলতেন। মলি বইয়ের পাতাগুলো কুড়িয়ে আবার জোড়া লাগাতেন। মলির কথা, মদ্যপ স্বামী বাসায় ফিরতেন রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে। সংসারের কাজ গুছিয়ে ১১টার দিকে পড়তে বসতেন মলি। গেট খোলার আওয়াজ পেলে বই রেখে দিতেন। এভাবে বিবিএ প্রথম বর্ষ শেষে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। সবাই বোঝাত, বাচ্চা নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তত দিনে তাঁর স্বামী মাদকেও আসক্ত হয়ে পড়েন।
এটাই বুঝি মাতৃত্ব : ২০১৬ সালে মা হলেন মলি। ছেলের নাম রাখলেন সমৃদ্ধ। সন্তান জন্মের পর বেশ কিছুদিন ছিলেন বাবার বাড়িতে। শ্বশুরবাড়ি ফিরে দেখেন, জুয়ায় হেরে স্বামীর চার লাখ টাকা দেনা। মলির গয়নাও বিক্রি করে দিয়েছেন। মলি জানান, এসব নিয়ে কিছু বললেই চলত নির্যাতন।
এর মধ্যে ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সরকারের সহযোগিতায় দেশে ফেরেন মলির বাবা। কিন্তু মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ হতো কম। মা-বাবাকে নির্যাতনের কথা কিছুই জানাতেন না। সমাজে হেয় হওয়ার শঙ্কায় সংসার ছাড়ার কথা ভাবেননি।
সন্তান জন্মের পরও এতটুকু বদলায়নি স্বামী। সংসার, সন্তান আর স্বামীর অকথ্য নির্যাতন—এসবের মধ্য দিয়ে দিন কাটত মলির। ডায়রিয়া হয়ে এক রাতে তাঁর ছেলেটার যায় যায় অবস্থা। ডাক্তারের কাছে নিতে বলায় সেদিনও মার খেয়েছিলেন। বললেন, ‘অনেকবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছি। একবার তো ফ্যানের সঙ্গে কাপড়ও বেঁধেছিলাম। ছেলেটি ওই রুমেই ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ ওর মুখটা দেখে আর ঝুলে যেতে পারিনি। এটাই মনে হয় মাতৃত্ব।’
আবার ক্লাসে ফেরা : দিশাহারা মলি ভাবলেন, আবার ফিরবেন ক্লাসে। অনেক যুদ্ধ করে দুই বছর পর ভর্তি হলেন দ্বিতীয় বর্ষে। নিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সুব্রত কুমার সাহা এবং সহপাঠীদের কাছ থেকে দারুণ সমর্থন পেয়েছিলেন তখন। এদিকে তাঁর ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলছিল। টিকতে না পেরে একপর্যায়ে মুখ খুললেন। মলি জানালেন, কয়েকবার সালিস বসল। দোষ স্বীকার করে শুধরানোর কথা বলতেন মলির স্বামী। কিন্তু সেটা কথার কথাই।
দুঃসহ সেই স্মৃতি : মলির স্মৃতিতে দুঃসহ একটি দিন ৩১ আগস্ট, ২০১৯। রাত ২টায় ঘরে ঢুকলেন মদ্যপ স্বামী। মলি বিছানায় নিয়ে বসালেন। বোঝাতে লাগলেন, অন্তত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি যেন এসব ছাড়েন।
মলি বলেন, এসব কথা তাঁর মন তো গললই না, উল্টো শুরু হলো মারধর। একপর্যায়ে এমনভাবে গলা চেপে ধরল— দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সেদিন শাশুড়ি ছুটে না এলে হয়তো মলির গল্পটা অন্য রকম হতো।
খুব ভোরে মলি ফোন দিলেন বাবাকে—‘যদি মেয়েকে জীবিত দেখতে চাও, তবে এখনই আসো।’ সকালে বাবার সামনেই আরেক দফা মারধরের শিকার হন। প্রতিবেশীদের সহায়তায় এক কাপড়ে বেরিয়ে এলেন মলি। শরীরভর্তি মারের দাগ। সঙ্গে দুই বছরের ছেলে। শেষ হলো তাঁর পাঁচ বছর, সাত মাস ২০ দিনের সংসার।
ছেলের জন্য নাশতা নিয়ে আসতেন : বাবার বাড়িতেও সমাজের কানাকানি, অহেতুক সমালোচনা স্থির হতে দিচ্ছিল না মলিকে। এসব সয়ে দুই মাইল হেঁটে গিয়ে টিউশনি করেছেন। টিউশনিতে নাশতা দিলে ব্যাগে ভরে ছেলের জন্য নিয়ে আসতেন। একদিন ছাত্রীর মা দেখে ফেলল। তারপর থেকে তিনি মলির ছেলের জন্য অনেক কিছু পাঠাতেন।
মলি তখন তৃতীয়বর্ষে। হিসাববিজ্ঞানের ছাত্রী। গণিত প্রাইভেট পড়া জরুরি। গ্রামে শিক্ষক নেই। ৮০ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরে যেতে হবে। যাতায়াত ভাড়া এবং টিউশন ফি কোথায় পাবেন?
এগিয়ে এলেন সেই অধ্যাপক সুব্রত কুমার। বিনা পয়সায় পড়ালেন। এমবিএ পর্যন্ত বইও দিতেন। সে সময় এক বন্ধুর ফেসবুক পেজে সাহায্য করতেন মলি। সেই সূত্রে সন্ধান পেলেন মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র নাথের। সব শুনে তিনি মলিকে মাসিক বৃত্তির আওতায় আনলেন। তাদের ‘নব আলো’ প্রকল্পের মাধ্যমে এককালীন আর্থিক সাহায্যও করলেন, যা দিয়ে বাড়িতে ছাগল পালন শুরু করলেন মলি। বললেন, ‘চন্দ্র নাথ দাদা জীবন বদলে দিয়েছে আমার। সুব্রত স্যারের কাছেও কৃতজ্ঞ।’
সামনে সুদিন : সিজিপিএ ৩.৪৩ পেয়ে বিবিএ এবং ৩.৬৭ পেয়ে শেষ এমবিএ সম্পন্ন করেন মলি। এর মধ্যে আবার চাকরির প্রস্তুতি। সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে অনেক মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন। এই প্রথম ব্র্যাক থেকে অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে নিয়োগপত্র পেলেন।
মলির ছেলেটা এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ক্লাসে প্রথম। মলির ধ্যানজ্ঞান এখন এই ছেলে আর মা-বাবাকে ঘিরে। বললেন, ‘সামনে অনেক দায়িত্ব। মা-বাবার ছায়া হয়ে থাকতে চাই। আর চাই ছেলেটাকে মানুষ করতে, যাতে সে নারীকে সম্মান করতে শেখে।’