খালেদা জিয়ার আজকের প্রত্যাবর্তন ছিল রাজকীয়। চার মাস লন্ডনে চিকিৎসার পর গতকাল মঙ্গলবার দেশে ফিরেছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই রাজনীতিবিদ। বিমানবন্দর থেকে গুলশানে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত জনতার ভিড়ে অনেকটা ‘তিল ধারণের ঠাঁই’ না থাকার অবস্থা সৃষ্টি হয়। লাখো জনতা তাঁকে শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছে।
বিশেষ লেখা
বেগম জিয়ার ত্যাগ ও প্রাপ্তি সবার জন্য শিক্ষণীয়
বিশেষ প্রতিনিধি

বেগম জিয়ার এই রাজকীয় প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ এবং সবার জন্য একটি শিক্ষা। খালেদা জিয়াকে যেভাবে জনগণ বরণ করে নিল, ভালোবাসায় সিক্ত করল, তা থেকে শুধু রাজনীতিবিদরা নন, আমরা সবাই অনেক কিছু শিখতে পারি।
প্রথমত, সম্মান কখনো জোর করে আদায় করার বিষয় না। আইন করে, জোর করে বাধ্য করে কাউকে সম্মানিত করা যায় না। সম্মান জনগণের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। আপনার কাজ, আপনার চিন্তা-চেতনা এবং আপনার জীবনাচরণ সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করে।
খালেদা জিয়ার আজকের এই অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের দ্বিতীয় শিক্ষা হলো ধৈর্য। সবাইকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। হুটহাট তাড়াহুড়া করে কিছু হয় না। আমরা যদি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব গত ১৭ বছর বিএনপি তীব্র অত্যাচার-নির্যাতন, জুলুম-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বিএনপির এমন কোনো নেতা নেই, যিনি নিপীড়িত হননি, জেলে যাননি, যাঁর বিরুদ্ধে মামলা নেই। কিন্তু এ সব কিছুর পরও বিএনপি ধৈর্যহারা হয়নি। বিএনপি আগ্রাসী কোনো তৎপরতা করেনি। জ্বালাও-পোড়াও, বিশৃঙ্খলার মধ্যে যায়নি; বরং জনগণকে বিএনপি সংগঠিত করেছে। এটিই খালেদা জিয়ার রাজনীতি। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু নন, বিশ্বের রাজনীতিতে সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত রাজনীতিবিদের প্রতীক। তিনি বিনা অপরাধে দীর্ঘ দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন। নির্জন সেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল। অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছিল তাঁর ওপর। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে বিএনপি প্রতিবাদ করেছে শান্তিপূর্ণভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। খালেদা জিয়ার এই তিল তিল আত্মত্যাগ তাঁকে করছে অপরাজেয়, জীবন্ত কিংবদন্তি। জনগণই তাঁকে নিয়েছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাই রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের জন্য খালেদা জিয়া একটি বড় অনুকরণীয় উদাহরণ।
রাজনীতিতে শর্টকাট কোনো পথ নেই। রাজনীতিতে ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। অপেক্ষা করতে হবে। সময় আপনার গতিপথ নির্ধারণ করবে।
খালেদা জিয়ার আজকের এই বিপুল জনসমর্থন আরেকটি বিষয় সবার জন্য শিক্ষণীয় করে তুলবে। সেটি হচ্ছে আদর্শে অটল থাকা। খালেদা জিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তিনি আদর্শবান একজন রাজনীতিবিদ। বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসেছিলেন এক প্রতিকূল বাস্তবতায়। যখন জিয়ার আদর্শের দল বিএনপি ষড়যন্ত্রের শিকার, তখন দেশ ও দল রক্ষার জন্য তিনি নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সর্বস্তরের জনগণের অভিপ্রায়ে। ১৯৮৩ সাল থেকে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনোই তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসেই জনপ্রিয়তা পান তাঁর আপসহীনতার জন্য। ১৯৮৬ সালে প্রহসনের নির্বাচনে তিনি যেতে পারতেন, হয়তো তিনি এমপি হতেন, তাঁর দলও স্বৈরাচারের জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্ত হতো। কিন্তু খালেদা জিয়া সে পথে যাননি। বরং তিনি দাঁত কামড়ে লড়াই করেছেন। স্রোতের বিপক্ষে সাঁতার কেটে তিনি স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছেন। ১৯৯১ সালে এ জন্য তাঁকে জনগণ ক্ষমতায় বসিয়েছিল। আবার একইভাবে দেখা যায় ২০০৭ সালে এক-এগারোর ভয়ংকর সেই ষড়যন্ত্রের সময় খালেদা জিয়া আপস করেননি। এক-এগারোর নথিপত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেই সময় সবচেয়ে নির্যাতিত ব্যক্তির নাম বেগম খালেদা জিয়া। একজন মায়ের সামনে যখন তাঁর দুই সন্তানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, মাকে করা হয় বন্দি—তখন তাঁরচেয়ে নির্যাতিত আর কে হতে পারে? কিন্তু খালেদা জিয়া সব অত্যাচার-জুলুমের মধ্যেও মাথানত করেননি। তিনি শুধু প্রতিবাদ করেছেন এবং তাঁর নিজের বিশ্বাস ও আদর্শে অটল থেকেছেন। এটিই খালেদা জিয়ার রাজনীতি। তিনি যদি চাইতেন তাহলে এক-এগারোর ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে আপস করতে পারতেন। তাঁকে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি ও তাঁর সন্তানরা জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন দেশের জন্য। রাজনীতিবিদদের এটি একটি বড় শিক্ষা। একটি আদর্শ এবং নীতিকে ধারণ করতে হয়। সেই আদর্শে অবিচল থাকতে হয়। খালেদা জিয়া এই আদর্শবাদিতার একটি বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই আদর্শের চর্চার অভাব আমরা দেখি বিরোধী দলে থাকলে এক রকম, ক্ষমতায় থাকলে সেই নেতাই স্বৈরাচার হয়ে ওঠেন। কিন্তু খালেদা জিয়া এ বিষয়ে তাঁর বিশ্বাস ও অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসেননি।
তৃতীয়ত, সাফল্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। খালেদা জিয়া একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি তাঁর সংগ্রামী জীবনে সব কিছু অর্জন করেছেন ত্যাগের মাধ্যমে। তিনি বাংলাদেশে ত্যাগের রাজনীতির প্রতীক। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন পর জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। মুক্ত হয়ে তিনি তাঁর ছেলের কাছে গেছেন। সেখানে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি চাইলেই লন্ডনে আরাম-আয়েশের জীবনে থাকতে পারতেন। ছেলের সঙ্গে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারতেন এই অসুস্থ অবস্থায়। কিন্তু তিনি দেশমাতৃকার টানে ফিরে এসেছেন। খালেদা জিয়া হলেন সেই বিরল রাজনীতিবিদ, যিনি জুলুম-নির্যাতনের মুখেও দেশকে ভালোবেসেছেন। দেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন, দেশ ত্যাগ করেননি। এখন খালেদা জিয়ার ফিরে আসার কি দরকার ছিল? ছিল। তাঁর আদর্শের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়নে জনগণের কাছে ফিরে এসে জনগণের স্বপ্ন পূরণের জন্য ফিরে আসার দরকার ছিল। এই জনগণই তাঁকে ‘দেশমাতা’ উপাধি দিয়েছে। আর এ কারণেই জনগণের সান্নিধ্যে তিনি বারবার ফিরতে চান। সবার জন্য যে বার্তাটা খালেদা জিয়া তাঁর প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে দিলেন তা হলো, এখনো তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তির নাম খালেদা জিয়া। তিনিই এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক। কাজেই খালেদা জিয়া যে আদর্শ লালন করেন, খালেদা জিয়া যে দলের প্রধান সেই দলকে কেউ যদি এখন ষড়যন্ত্র করে মাইনাস করতে চায়, রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়, তাহলে খালেদা জিয়ার পক্ষে যে জনগণ অটুক ঐক্যের ইস্পাত ঐক্য নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, সেটি গতকাল প্রমাণিত হলো। বেগম জিয়ার আগমন এবং জনগণের বিপুল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তাঁকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে জনগণ গণতন্ত্র চায়, জনগণ একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে জনগণের একজন নেতাকে দেখতে চায়। এই বার্তাটি যত তাড়াতাড়ি সবাই বুঝবে ততই সবার ভালো হবে। খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা হিমালয়সম, বঙ্গোপসাগরের মতো। এই জনপ্রিয় নেতা যে ডাক দেবেন জনগণ তা করতে যে প্রস্তুত, তা গতকালের লাখো জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে দিল। খালেদা জিয়া শুধু রাজনীতিবিদদের জন্য নয়, সবার জন্য শিক্ষণীয়, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে আদর্শবান ব্যক্তির বড় অভাব। এই সময় বেগম জিয়া যেন আদর্শের বাতিঘর। সবার জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য। আজকের জনস্রোতের বার্তাটি সবাই আশা করি অনুধাবন করবেন।
সম্পর্কিত খবর

ব্যর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ


বেশি দামে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। প্রয়োজন হলে ডলার কিনব, আবার প্রয়োজন হলে বিক্রিও করব।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাজারে ‘আপওয়ার্ড সিগন্যাল’ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। এতে করে ডলারের রেট একদিকে পুরোপুরি বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকছে, অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত উপস্থিতিও বজায় থাকছে। এই কৌশল মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ এবং আইএমএফের শর্ত পূরণ উভয় উদ্দেশেই সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি ডলার কিনেছে। গত ২৩ জুলাই এই নিলামে কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয় ১২১.৯৫ টাকা, যা আগের তুলনায় ০.৪৫ টাকা বেশি। এর মাধ্যমে মাত্র আট দিনের ব্যবধানে নিলামে ডলারের রেট উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যাংকের দর দেখে ১২১ টাকা ৯৫ পয়সায় এক কোটি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত পদক্ষেপ। এই নিলামে ডলারের কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১২১.৯৫ টাকা।
ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ও বাজারে প্রতিক্রিয়া : শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। তবে এবার আগের মতো অনেক ব্যাংক আগ্রহ দেখায়নি। কারণ অনেক ব্যাংক ধারণা করছে, সামনে ডলারের দাম আরো বাড়বে। তাই তারা অপেক্ষা করছে। চড়া দর সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাজারে প্রত্যাশা কিভাবে গড়ে উঠছে।’
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ মনে করেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো চাচ্ছে, যে ডলার রয়েছে সামনে সেটা দিয়েই দায় পরিশোধ করবে। তা ছাড়া চলতি মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। যে কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে তেমন আগ্রহী ছিল না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মারুফ বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে যা উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে। এটা দিয়ে বোঝায় যে ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে গেছে এবং যে পরিমাণ তারল্য রয়েছে, আসলে এত দরকার নেই।’
বাজার পরিস্থিতি ও এলসির চাপ : পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সম্প্রতি ডলারের বাজার কিছুটা টাইট। কারণ ব্যাংকগুলো আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তবে আগামী সপ্তাহে ডলারের প্রবাহ বাড়লে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের বাজার স্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। আগের অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে, তবে আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দরকার।’
স্পট ও আন্ত ব্যাংক বিনিময় হার : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ জুলাই স্পট বিনিময় হার ছিল ১২১.৯৪ টাকা। আন্ত ব্যাংক বাজারে ডলার লেনদেন হয় ১২১.৬০ থেকে ১২২.০২ টাকার মধ্যে। শীর্ষস্থানীয় আরেক ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, ‘বুধবার আন্ত ব্যাংক বাজারেই ডলারের দাম ১২২ টাকা ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপওয়ার্ড সিগন্যালের ফলে আগামীকাল এটি আরো বাড়তে পারে।’
আইএমএফের শর্তে বাজারভিত্তিক নীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের ঋণচুক্তির আওতায় এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ করে নির্দিষ্ট রেটে ডলার কেনে না। মে মাস থেকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হওয়ায় এখন নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা হয়। এতে করে ডলারের মূল্য নির্ধারণে বাজার প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, ‘আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেরা রেট নির্ধারণ করত। এখন মার্কেট রেটেই লেনদেন হচ্ছে। এই পদ্ধতিই দীর্ঘ মেয়াদে বাজারকে আরো স্বচ্ছ করবে।’

ফিরে দেখা ২৫ জুলাই ’২৪
মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব জাতিসংঘের
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ। ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে এই প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে এক ব্রিফিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশে শিগগিরই শান্তি ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছে বিএনপিও।
এদিকে এদিনই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে প্রবাসী ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে বিক্ষোভ করে তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চায় সরকার। বিশ্বের নানা দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস, হাইকমিশন এবং অনাবাসিক মিশনগুলোর মাধ্যমে হোস্ট গভর্নমেন্টের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এদিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা খোলা ছিল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস। রাজধানীতে দূরপাল্লার গণপরিবহনে যাত্রীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। কারফিউ বলবৎ থাকায় রাজধানীতে ছিল কঠোর সেনা টহল।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, এদিন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর কেবল কোটা সংস্কারের ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই।’ তিনি বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটবে না।
অন্যদিকে ২৩ জুলাই (২০২৪) প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আংশিক বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’। বিবৃতিতে ৯১ জন শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের সহযোগিতা, রংপুরের আবু সাঈদসহ নিহত সবার কবর জিয়ারত, রুহের মাগফিরাত কামনা এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো।
২৫ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট চালু, কারফিউ তুলে দেওয়াসহ ‘জরুরি’ চার দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হয়। তবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে না পারায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি তারা। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে আরেক অংশের একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এর সমন্বয়ক হান্নান মাসুদের বরাত দিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, পরদিন ২৬ জুলাই বাদ জুমা সারা দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা ও শোক মিছিল করা হবে।
নিহত ১৭০ জনের বেশি, আহত হাজারের বেশি— জাতিসংঘ : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হালনাগাদ তথ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ১৭০ জনেরও বেশি লোক নিহত এবং হাজারের বেশি আহত হয়েছে। তাদের অনেকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণদের প্রতিবাদ কর্মসূচির পর অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। অন্তত দুজন সাংবাদিক নিহত এবং আরো অনেকের আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কয়েক শ লোকের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিনই এক যৌথ বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ণ জবাবদিহির আহবান জানান জাতিসংঘের ১৩ জন স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বাংলাদেশে সহিংস দমন-পীড়নের অভিযোগ এনে তা বন্ধ করার আহবান জানান।
ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বিচার চাইলেন জনগণের কাছে : এদিন সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন ঘুরে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় তাঁকে চোখের পানি মুছতেও দেখা যায়। পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের জনগণকে তাদের (দেশব্যাপী তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের) বিচার করতে হবে। আমি জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাইছি। ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়ার মতো আমার আর কোনো ভাষা নেই।’
মামলা ও গ্রেপ্তার : ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র দিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নাশকতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে এদিনও অভিযান অব্যাহত ছিল। এদিন বিকেলে রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোড থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য আন্দালিব রহমান পার্থকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রসঙ্গ শুল্ক
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২৯ জুলাই চূড়ান্ত আলোচনা
নিজস্ব প্রতিবেদক

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রধান বাণিজ্য আলোচনাকারী সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) বাংলাদেশকে আগামী ২৯ জুলাই তৃতীয় ও চূড়ান্ত শুল্ক আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সংবাদ সংস্থা বাসসকে এই তথ্য জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, এর আগে বাংলাদেশ ২২ জুলাই ইউএসটিআরের কাছে নিজেদের অবস্থানপত্র পাঠায় এবং ২৬ জুলাই চূড়ান্ত দফার আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেয়।
বাণিজ্যসচিব জানান, ইউএসটিআর ২৯ জুলাই দিন ধার্য করেছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ শুল্ক হার হ্রাস করবে। কারণ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের জন্য ১৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার জন্য ১৯ শতাংশ, ভিয়েতনামের জন্য ২০ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের জন্য ১৯ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে মার্কিন পণ্য, যেমন—তুলা, গম, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), বিমান ও অন্যান্য কৃষিপণ্য শুল্কমুক্ত আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ ২০ জুলাই মার্কিন গম সরবরাহকারীদের সঙ্গে সাত লাখ টন গম আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে সাংবাদিকরা শুল্ক আলোচনার সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চান। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে, এমন কোনো কাজ করা হবে না।
শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রচারণা নাকচ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে আমরা কেন এমন কাজ করব? তাহলে তো আন্ত মন্ত্রণালয় মিটিংয়ের দরকার হয় না। কিছু জিনিস মেনে নিয়ে কাজটা করে ফেললেই তো হয়ে যায়। সম্পূরক শুল্কের মতো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোতে লবিইস্ট নিয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায় না।’