রাজনীতিতে আশা-নিরাশার দোলাচল। এক পক্ষ নির্বাচনের জন্য মরিয়া, আরেক পক্ষ রয়েসয়ে সংস্কার শেষ করে তবেই নির্বাচনের ব্যাপারে একাট্টা। পাল্টাপাল্টি এই অবস্থানের মধ্যেই কিছুটা মনোযোগ হারিয়ে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। বিশেষ করে অর্থনীতির মূল সূচকগুলোর বেশির ভাগই গতিহীন।
বিশেষ লেখা
শিল্প ব্যবসাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখা উচিত
- ফারুক মেহেদী

দেশের শীর্ষ অনেক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে কথা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সত্যিকার অর্থে একটি ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়নি এখনো। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক অবস্থায় ফেরেনি। এখনো কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ। কথায় কথায় জ্বালাও-পোড়াও, বিক্ষোভ-ভাঙচুর। যখন-তখন মব সন্ত্রাসে আক্রান্ত হচ্ছে শিল্প-কারখানা, ব্যবসা ও উদ্যোগ। সম্প্রতি বিনিয়োগ সম্মেলনের সময়ও মব সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে বেশ কিছু বিদেশি ব্র্যান্ডের আউটলেট। অনেক দিন ধরেই বিনিয়োগে মন্দা চলছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই ডলারের উচ্চ দরের কারণে আমদানিতে লাগাম টানা হয়। বলতে গেলে ডলার বাঁচাতে আমদানিকে নিরুৎসাহই করা হয়। এর সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হলে মুদ্রাপ্রবাহ কমাতে সুদের হার ক্রমাগত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক অস্থিরতা আগের সরকারের সময়কাল থেকে শুরু হলেও তা অন্তর্বর্তী সরকার এসেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বরং বর্তমান গভর্নরও মুদ্রানীতি আরো কঠোর করে সুদের হার কয়েক দফা বাড়িয়েছেন। এতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে বড় ধাক্কা লেগেছে। আর ১০টি দুর্বল ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রচারেও ভুল বার্তা যায় সর্বত্র। বিভিন্ন কারণে বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার আইনি পদক্ষেপেরও কিছু প্রভাব পড়ে। এর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি না হওয়া আর ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাওয়াই বড় কারণ। গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ নতুন বিনিয়োগে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। এমনিতেই উদ্যোক্তারা আস্থাহীনতায়, তার মধ্যে গ্যাসের দাম লাগামহীন বাড়ানোর ফলে উদ্যোক্তারা রীতিমতো হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। দেশের উদ্যোক্তারা যখন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, তখন বিদেশি বিনিয়োগ আসাও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে দেশে এখন বিনিয়োগ পরিস্থিতি মন্দাই বলা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেও বিনিয়োগে মন্দার নেপথ্যের দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তথ্য বলছে, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিও কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর অর্থ হলো, দেশে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। সাদা চোখে আমদানি না হওয়ায় ডলারের সাশ্রয় আর রিজার্ভের উন্নতি মনে হলেও অর্থনীতি ও ব্যবসায় এর নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। মূলধনী যন্ত্রপাতি না আসা মানে মানুষের কাজের সুযোগ কমে যাওয়া। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। আর সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকও বলেছে, সামনে নতুন করে আরো ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্র হবে।
অর্থনীতির হিসাব বলছে, একটি উদীয়মান অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত আমদানি না হলে, বিনিয়োগ না হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সর্বত্র। কর্মসংস্থান হয় না। মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে না। আয় হয় না। আয় না হলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এতে অর্থনীতিতে হয়তো মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমিয়ে রাখা যায়, কিন্তু টাকার প্রবাহ না থাকলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমার পাশাপাশি সরকারেরও রাজস্ব আয় হয় না। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আয়ে। এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি চলছে অর্থনীতিতে। বড় অঙ্কের এই টাকা আয় না হওয়ার একটা বড় কারণ হলো অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কম। ফলে আমদানি থেকে শুল্ক আদায় কম, পণ্য বেচাকেনা থেকে ভ্যাট আদায় কম। সর্বোপরি ব্যক্তির আয় কমে যাওয়ায় আয়কর আদায়ও কম।
সরকারের রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় খরচও করতে পারছে না। মানে সরকারের বিনিয়োগ হচ্ছে না সন্তোষজনক হারে। বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ কমছে। বাজেট কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এতে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের আয় কমে যায়। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষের চাহিদা কমছে। যার প্রভাবে উৎপাদনশীলতা কম। আবার আমদানি কমার কারণেও উৎপাদনে স্থবিরতা তৈরি হয়।
সম্প্রতি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা ঘটা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে ব্যবসা-বিনিয়োগের নাজুক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিকেএমইএ ও বিটিটিএলএমইএর দেওয়া ওই যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা উল্লেখ করেন, উচ্চ দাম দিয়েও তাঁরা গ্যাস পাচ্ছেন না। ফলে চরম গ্যাসসংকটে তাঁদের শিল্পগুলো প্রায় বসে যাওয়ার দশা। এরই মধ্যে রপ্তানিমুখী অনেক পোশাক ও বস্ত্রশিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো বন্ধের পথে। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এভাবে চলতে থাকলে সামনে তাঁদের বৈদেশিক ক্রয়াদেশ বহাল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁরা এও উল্লেখ করেছেন যে সরকারের শীর্ষ মহলে দফায় দফায় চিঠি দিয়েও তাঁরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। তাঁরা জানান, দেশের রপ্তানি আয়ের অন্তত ৮৫ শতাংশ তাঁদের শিল্পের অবদান। তাঁদের ওই শিল্পকে গ্যাস দেওয়ায় অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। তাঁরা আরো জানান, পোশাক খাতের অন্তত ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগই এখন হুমকির মুখে। উদ্যোক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তাঁদের শিল্পগুলো টিকতে না পারলে পরিণামে তা রিজার্ভেও ঝুঁকি তৈরি করবে।
অর্থনীতির আরেক স্তম্ভ পুঁজিবাজারেও আশার খবর নেই। কয়েক মাস ধরেই মন্দার কবলে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্রমাগত পুঁজি হারাচ্ছেন। তাঁরা প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছেন। কিন্তু বাজারে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।
মোটকথা, সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন বেশ চাপের মুখে। উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে যেটা মনে হচ্ছে, অর্থনীতির জন্য এখন সরকারের অগ্রাধিকার ঠিক করা দরকার। একদিকে মুদ্রাবাজারকে স্থিতিশীল করা, সুদের হার ও গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানির দর সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে এনে বিনিয়োগে গতি ফেরানো; অন্যদিকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তাঁদের নিয়ে বসা এবং তাঁদের সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে শোনা উচিত। তাঁরা কী কী সমস্যা মোকাবেলা করছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে কী নীতি-কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। সত্যিকার অর্থে এখন অর্থনীতিতে গতি ফেরানো সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে প্রায় সব মহল থেকেই বলা হচ্ছে। আর এ জন্য সবস্তরের ব্যবসায়ীদের আস্থায় নেওয়াও সমান জরুরি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্ত হাতে দমনের পাশাপাশি তাঁদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ দেওয়া, আমদানি আরো উদার করা, সুদের হার কমিয়ে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো, ডলারের দর আরো সহনীয় রাখা, ঋণ শোধে সহনীয় নীতি সহায়তা দেওয়া, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অগ্রাহ্য করে খেলাপি হওয়ার নীতিমালা আরো সহনীয় করা, ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীদের কোনো ধরনের হয়রানি, নজরদারি বা জেল-জরিমানা, হামলা-মামলা না দিয়ে তাঁদের নিয়ে একসঙ্গে দেশ গঠনে আরো আন্তরিকভাবে কাজ করা। মোটাদাগে এগুলোই এখন সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা উচিত। যেকোনো মূল্যে অর্থনীতিতে মানুষের কাজ আর আয়ের সুযোগ যেন বাড়ে তা দেখতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে সরকার একটি বিশেষ কমিটিও করতে পারে। ওই কমিটি ত্বরিত করণীয় নির্ধারণে সুপারিশ করবে সরকারকে। তার আলোকে সরকার কাজ শুরু করবে।
সম্পর্কিত খবর

মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যার প্রতিবাদ
সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকর্মী
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মীদের অংশগ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। গত রবিবার দুপুরে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় শুরু হওয়া বিক্ষোভ মিছিল শাহবাগ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে শেষ হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুপুর ১টার দিকে ধানমণ্ডির আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাবে উপস্থিত হয়ে ১০ মিনিট অবস্থান করেন। এরপর তাঁরা মিছিল নিয়ে শাহবাগ হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে যান।
এ সময় হাসপাতাল ও আশপাশে থাকা বিএনপির ব্যানার ছিঁড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবিসংবলিত ব্যানার পদদলিত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর অনেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে রাজপথে সক্রিয় হচ্ছে। কেউ কেউ আবার বিএনপির প্ল্যাটফর্মে ঢুকে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে।
রাজনৈতিক পরিচয় : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিক্ষোভের বেশ কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া ‘আইডিয়াল কলেজ শিক্ষার্থী’ ইয়ামিনকে তাঁর সহপাঠীরা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। আগেও তাঁকে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।
নেপথ্যে রাজনৈতিক হিসাব : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ভিত নষ্ট করার একটি অপচেষ্টা। এর ফলে আবারও ১/১১-এর মতো সংকট সৃষ্টি হতে পারে। রাজনৈতিক দলে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ বাড়ছে। সোহাগ, যিনি আগে হাজি সেলিমের সঙ্গে ছিলেন, এখন বিএনপির কর্মী। বিএনপি যদি নিজেকে রক্ষা করতে চায়, তাহলে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদারের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে ডিএমপি উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই মিছিলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের উপস্থিতির বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে নিষিদ্ধ যেকোনো দলের কার্যক্রম রুখে দিতে পুলিশ সব সময় প্রস্তুত রয়েছে। এর আগেও রাজধানীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে যারা ঝটিকা মিছিল করেছে, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এই বিষয়টিও আমরা খতিয়ে দেখব।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম খলীল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা গুপ্ত রাজনীতি করে এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করতে চায় তারা জল ঘোলা করতে এমন কর্মকাণ্ড করছে। তারা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারমান তারেক রহমানকে নিয়ে কটূক্তিমূলক ভিডিও করেছে। তাদের ব্যানার পদদলিত করে আগুন জ্বালিয়েছে। যারা স্বৈরাচারের আমলে তাদের লুঙ্গির নিচে ছিল, তারাই এখন ঘোলা জলে মাছ শিকার করা চেষ্টা করছে। জনগণের কাছে তাদের অবস্থান না থাকার কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পেছনে থেকে গুপ্ত হামলা করার চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, “পুলিশের তদন্তে এসেছে ‘ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্ব’ থেকে সোহাগ হত্যাকাণ্ড। এর পরও আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে শোক জানিয়েছি, এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছি। একই সঙ্গে দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জোর দাবিও জানিয়েছি।”

বড় ধরনের সহিংস অপরাধের সংখ্যা বাড়েনি : প্রেস উইং
১০ মাসে ৩৫৫৪ খুন, ৪১০৫ ধর্ষণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

গত ১০ মাসে (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত) দেশে তিন হাজার ৫৫৪ জন খুনের ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে ডাকাতি হয়েছে ৬১০টি, দস্যুতা এক হাজার ৫২৬টি, দাঙ্গা ৯৭টি, ধর্ষণ চার হাজার ১০৫টি, এসিড নিক্ষেপ পাঁচটি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২ হাজার ৭২৬টি, অপহরণ ৮১৯টি, সিঁধেল চুরি দুই হাজার ৩০৪টি, চুরি সাত হাজার ৩১০টি এবং এই সময়ে রুজুকৃত মামলার সংখ্যা এক লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৫টি।
গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত ১০ মাসের অপরাধ পরিসংখ্যানে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে।
অপরাধ পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৭টি, খুন হয়েছে এক হাজার ৯৩৩টি এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দুই হাজার ৭৪৪টি। এ সময় নারী নির্যাতন ছয় হাজার ১৪৪টি এবং শিশু নির্যাতনের দুই হাজার ১৫৯টি ঘটনা ঘটেছে।
এর আগের বছর ২০২৪ সালে ডাকাতি হয়েছিল ৪৯০টি, খুন চার হাজার ১১৪টি, ধর্ষণ চার হাজার ৩৯৪টি, নারী নির্যাতন ১০ হাজার ১৯৮টি এবং শিশু নির্যাতন দুই হাজার ৯৬৪টি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, চলতি বছর দেশে অপরাধের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে জনমনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছর বড় ধরনের অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে—এমন দাবি সঠিক নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে বড় ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল রয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, পরিসংখ্যানে বড় ধরনের অপরাধের দ্রুত বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। বাস্তবে বেশির ভাগ গুরুতর অপরাধের হার কমছে বা একই পর্যায়ে রয়েছে।
প্রেস উইং নাগরিকদের প্রতি সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে বলেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে হবে। কারণ অপরাধের হার মোটামুটি স্থিতিশীল, যাতে বোঝা যায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

মা-সন্তানসহ ৫ জেলায় সাতজনকে হত্যা
কালের কণ্ঠ ডেস্ক

ময়মনসিংহের ভালুকায় দুই সন্তানসহ মাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জে শিশুকে হত্যা করে ঘরে লুকিয়ে রেখেছে সত্মা। এ নিয়ে দেশের পাঁচ জেলায় সাতজনকে খুন করা হয়েছে। আর তিন জেলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে চারজনের লাশ।
ভালুকা (ময়মনসিংহ) : পৌর এলাকার পনাশাইল রোডে এক ভাড়া বাসায় মা ও দুই সন্তানকে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলো নেত্রকোনার কেন্দুয়ার রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ময়না বেগম (২৫), মেয়ে রাইসা (৭) ও ছেলে নীরব (২)।
স্থানীয় ও থানা সূত্রে জানা যায়, রফিকুল ইসলাম এখানে ভাড়া থেকে ভালুকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। রবিবার রাত ৮টার সময় তিনি কর্মস্থলে যান এবং গতকাল সকালে ফিরে বাসার বারান্দার দরজা তালাবদ্ধ দেখেন।
রফিকুলের ভাই নজরুল ইসলাম একই বাসায় পাশাপাশি কক্ষে থাকেন। নিজ এলাকার একটি হত্যা মামলায় জামিনে থাকা আসামি নজরুল ভালুকায় অটো চালাতেন। ঘটনার পর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ, তাঁর মোবাইল ফোনটিও বন্ধ।
সিরাজগঞ্জ : কামারখন্দ উপজেলায় সাত বছর বয়সী এক কন্যাশিশুকে হত্যার পর বস্তাবন্দি করে ঘরে লুকিয়ে রেখে এক সত্মা পালিয়ে যান। রবিবার রাত ১০টার দিকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে ওই রাতেই সত্মাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নিহত শিশু হাজেরা খাতুন উপজেলার কুটিরচর এলাকার হারুনার রশিদের মেয়ে। শিশুটির দাদি মনোয়ারা খাতুন জানান, রবিবার দুপুরে শিশু হাজেরা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এদিকে সিরাজগঞ্জ সদর ও তাড়াশ উপজেলা থেকে গতকাল সকালে দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সদরে উদ্ধার হওয়া আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। সদর থানার এসআই শফিউল আলম জানান, তাঁর মাথা ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে।
অন্যদিকে তাড়াশে নিহত সেলুনকর্মী শান্ত (২০) ঈশ্বরপুর গ্রামের শরিফুল ইসলামের ছেলে। তাড়াশ থানার ওসি জিয়াউর রহমান জানান, সকালে নিজ ঘর থেকে শান্তর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
বারহাট্টা থানার ওসি কামরুল হাসান জানান, আহাদুলের সঙ্গে প্রতিবেশী মনহর আলী ও তাঁর চার ছেলে আলমগীর, অনিক, নির্ঝর ও বাবুর জমিসংক্রান্ত বিরোধ ছিল। তার জেরেই ওরা ঢাকা থেকে এসে হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
চট্টগ্রাম : পতেঙ্গা থানার কাটগড় এলাকায় পারিবারিক কলহের জেরে ছুরিকাঘাতে ফেরদৌসী আক্তার নামের এক নারী খুন হয়েছেন। রবিবার রাত ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত ফেরদৌসী এলাকার লোকমান হোসেনের স্ত্রী। নিহতের স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পারিবারিক কলহের জেরে ফেরদৌসীর দেবর তাঁর ঘাড়, পিঠ ও পেটে ছুরিকাঘাত করে।
নিহতের ভাই মামুন খান বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে আমার বোনকে তাঁর স্বামী, শাশুড়ি পরিবারের লোকেরা নির্যাতন করে আসছিল। আমরা একটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখেছি, লোকমানের বড় ভাই সোলেমান ও ছোট ভাই রনির হাতে ছুরি। আমরা খুনিদের বিচার চাই।’
ঘটনার পর ফেরদৌসীর স্বামী লোকমানকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে। শ্বশুরবাড়ির বাকি লোকজন পলাতক।
বারহাট্টা (নেত্রকোনা) : জমিসংক্রান্ত বিরোধে আহাদুল মিয়া (২৬) নামের এক যুবককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল দুপুরে তাঁর লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে রবিবার রাতে উপজেলার বাউশী ইউনিয়নের শাসনউড়া গ্রামে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। আহাদুল মিয়া ওই গ্রামের সিদ্দিক মিয়ার ছেলে।
নরসিংদী : এক মাদক কারবারির বাড়ি থেকে সাজিদ হোসেন (২২) নামে এক তরুণের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে সদর উপজেলার শিলমান্দী ইউনিয়নের বাগহাটা টেকপাড়া গ্রামে দুলালের বাড়ি থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ বলছে, নিহত যুবকের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। আবার যার বাড়ি থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়েছে তারাও চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তবে নিহতর পরিবারের অভিযোগ, মাদক ব্যবসায়ী দুলালের বাড়িতে নির্যাতন করে সাজিদকে হত্যা করা হয়েছে।
পাবনা : পুকুরে ভাসমান অবস্থায় এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে শহরের লাইব্রেরি বাজার এলাকার কলাবাগান কলোনির মিঠুর পুকুর থেকে এ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত যুবকের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। তবে আনুমানিক বয়স হবে ৪০ বছর।
গাজীপুর : নিখোঁজের ছয় দিন পর এক শিশুর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল বিকেলে মহানগরীর ধীরাশ্রম এলাকা থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। নিহত নাবিলা কানিজ সাবা ধীরাশ্রমের দাখিনখান এলাকার নাসির মিয়ার মেয়ে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার শিশুটি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সন্ধান না পেয়ে রাতে শিশুটির মা খাদিজা বেগম সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। গতকাল বাড়ির পাশে ঝোপের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকলে স্থানীয়রা বস্তাটির সন্ধান পায়। বস্তা খুলে সাবার গলিত লাশ পাওয়া যায়।

ফাঁকিবাজদের আতঙ্ক আয়কর গোয়েন্দা
হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছেন ১৮৩ ভিআইপি
নিজস্ব প্রতিবেদক

যাত্রা শুরুর মাত্র সাত মাসের মধ্যেই কর ফাঁকিবাজদের আতঙ্ক হয়ে উঠেছে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। এ সময় ১৮৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক হাজার ৮৭৪ কোটি টাকার কর ফাঁকি উদঘাটন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে আদায় হয়েছে ১১৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বাকি টাকা আদায়ের প্রচেষ্টাও চলছে বলে জানা গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, এক হাজার ৭৮৮টি বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও অর্থপাচার মামলা তদন্ত করছে আয়কর গোয়েন্দা। এঁদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, অভিনেতা-অভিনেত্রী, ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, শিক্ষক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সব পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি রয়েছেন। এনবিআরের অধীন ৪১টি কর অঞ্চল ও দেশের ৬৪ জেলার করদাতারাও এ কার্যক্রমের আওতায় রয়েছেন।
এয়ার টিকিট সিন্ডিকেট, পরিবহন ব্যবসায়ী, শেয়ারবাজার, আমদানি ও মজুদকারী, চালান জালিয়াতকারী, জুয়াড়ি, ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পাশাপাশি কমেছে জনদুর্ভোগ।
আয়কর গোয়েন্দার প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের ১৮ জানুয়ারি। তবে কর্মচারী নিয়োগ ও ভাড়া অফিসে স্থানান্তরের পর মূল কার্যক্রম চালু হয়েছিল ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর।
কর প্রশাসনে দক্ষ গোয়েন্দা গঠন, কর ফাঁকি, অর্থপাচার, বিভিন্ন আর্থিক অপরাধ শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, রাজস্ব পুনরুদ্ধার করা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, কর ফাঁকির তদন্তে অর্থের উৎস যাচাই করা ও দায়িত্বশীল অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে এই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
জানা গেছে, বিশেষায়িত এই গোয়েন্দা ইউনিট অল্প সময়ের ব্যবধানে সফলতা দেখালেও তার নেই প্রয়োজনীয় জনবল ও স্থায়ী অফিস ভবন। শুরুতে এনবিআর ভবনে অস্থায়ী কার্যালয় থাকলেও পরে ভাড়া করা অফিসে যাবতীয় কাজ করছে রাজস্ব ফাঁকি ঠেকিয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার মো. আবদুর রকিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আয়কর গোয়েন্দা অল্প সময় ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই ইউনিটের সদস্যসংখ্যা কম হলেও তাঁরা মেধাবী ও পরিশ্রমী। তাঁদের কাজের প্রতি একাগ্রতা থাকায় আমরা সামগ্রিকভাবে ভালো করতে পারছি। তবে জনবল সংকট, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট পেলে এই ইউনিট দেশের জন্য আরো অনেক কিছু করতে পারবে। আমরা চাই দেশে একটি নতুন কর সংস্কৃতি। যেখানে কেউ কর ফাঁকি দিতে পারবেন না।’
জানা গেছে, ভবিষ্যতে এই ইউনিটের জন্য ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের চিন্তা করা হচ্ছে। কর ফাঁকি-অর্থপাচার রোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া কর ফাঁকিবাজদের ডেটাবেইস তৈরি, নিয়মিত তল্লাশি-জব্দকরণ অভিযান পরিচালনা, কর নেটের বাইরে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কাজও করবে এই ইউনিট।