শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্য (ভিসি) ও উপ-উপাচার্যকে (প্রোভিসি) দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। গতকাল বুধবার মধ্যরাতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মামুন অর রশিদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সংকট নিরসন এবং শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। অবিলম্বে একটি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ দুটি পদে নতুন নিয়োগ প্রদান করা হবে।
অন্তর্বর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের মধ্য থেকে একজনকে সাময়িকভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কুয়েট ক্যাম্পাসে ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গতকালও অনশনের পাশাপাশি চলেছে বিক্ষোভ। গতকাল সিন্ডিকেট সভা চলাকালে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা উপদেষ্টা ও ইউজিসির সদস্যদের সামনেও শত শত শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেন। গতকাল শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন থেকে সরে আসার অনুরোধ জানালে তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। কুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসেও গতকাল কর্মসূচি পালিত হয়। এরই মধ্যে গতকাল মধ্যরাতে কুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা আসে।
গতকালের সিন্ডিকেট সভায় আগের সভায় যে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সন্ধ্যায় কুয়েট জনসংযোগ দপ্তর থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
এদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও দুপুরে কুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে জিরো পয়েন্ট এলাকায় ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেন। এর আগে নগরীর শিববাড়ী মোড়ে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়। সন্ধ্যায় কুয়েট ক্যাম্পাসে কাফন মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
তবে ভিসির পক্ষে অবস্থান নিয়ে ‘কারো চাপের মুখে পদত্যাগ করলে মেনে নেওয়া হবে না’ বলে ঘোষণা দেন কুয়েট শিক্ষক সমিতির নেতারা।
এদিকে ৫৭ দিনের মাথায় গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে হলগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কুয়েটের সিন্ডিকেট সভায়। যদিও গত ১৫ এপ্রিল ছাত্রদের ছয়টি এবং ২২ এপ্রিল ছাত্রীদের একটি হল নিজেরাই খুলে প্রবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
কুয়েট উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান অনশন কর্মসূচির তৃতীয় দিন ছিল গতকাল। সকাল পৌনে ১০টায় অনশনস্থলে পৌঁছে শিক্ষার্থীদের অনশন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার। আধাঘণ্টা ধরে তিনি অনুরোধ জানালেও শিক্ষার্থীরা দাবিতে অনড় থেকে বলেন, ‘আমরা মরব, তবু ভিসির পদত্যাগ ছাড়া অনশন ছাড়ব না।’ সকাল সোয়া ১০টায় শিক্ষা উপদেষ্টা সেখান থেকে বের হয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হন। পরে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দুই সদস্য এবং বাংলাদেশ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন যুগ্ম সচিব এসেও তাঁদের অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। শিক্ষার্থীরা তাঁদের অনুরোধও উপেক্ষা করেন।
গণমাধ্যমকর্মীদের শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর জন্য এসেছিলাম। অনুরোধ করেছি। তারা শোনেনি। ঢাকায় ফিরে যত দ্রুত সম্ভব এর একটি সমাধান করা হবে।’
এ সময় খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, কুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিষদের পরিচালক অধ্যাপক মো. আব্দুল্লাহ ইলিয়াছ আক্তার উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা কুয়েট ত্যাগ করার পর অনশনস্থলে গিয়ে একই অনুরোধ করেন ইউজিসির দুই সদস্য অধ্যাপক তানজীম আহমেদ ও অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন যুগ্ম সচিব। তাঁরাও শিক্ষার্থীদের অনশন থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালে শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
ভিসির পক্ষে শিক্ষক সমিতি : কুয়েট শিক্ষার্থীদের ভিসির পদত্যাগের এক দফাকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে কুয়েট শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কারো চাপের মুখে ভিসি পদত্যাগ করলে কুয়েট শিক্ষক সমিতি তা মেনে নেবে না।
‘মার্চ টু কুয়েট’ কর্মসূচি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, কুয়েট উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। দাবি আদায় না হলে ‘মার্চ টু কুয়েট’ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তাঁরা।
গতকাল বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে উপাচার্য চত্বরে গিয়ে শেষ হয়।
কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বুয়েট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
চুয়েটেও অনশন : চুয়েট প্রতিনিধি জানান, কুয়েট শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে অনশনে বসেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর ১টা ৩০ মিনিট থেকে ১২ ঘণ্টার জন্য প্রতীকী অনশনে বসেন তাঁরা।
নিজস্ব প্রতিবেদক (চট্টগ্রাম) জানান, কুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে চট্টগ্রামে অনশন পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা কুয়েট ভিসি মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
শিক্ষার্থীদের সমর্থনে শিক্ষক নেটওয়ার্ক : সরকার বরাবরই কুয়েট শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করেছে, যা শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্ত বলেই প্রতীয়মান হয়। অনশনরত কুয়েট শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে।