এখনো আলোচনা চলছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নেসেসিটি মেকস ল। আমাদের কাছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। ডকট্রিন অব নেসেসিটি বিবেচনা রেখেই কিছু অপশন রাখা সুবিধাজনক। না হলে রাষ্ট্র এমন কোনো ব্যক্তির হাতে পড়ে যাবে, যা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে পরিচালিত। কিন্তু ওনারা বলেছেন কালেকটিভলি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা কর্তৃক পরিচালিত। এতে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকে না। আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকা উচিত।’
একজন সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির প্রস্তাবে বলা আছে, দুইবারের পরে বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে।
গত রবিবার মুলতবি হওয়া বৈঠকের আলোচনায় একজন সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন—ঐকমত্য কমিশনের এমন প্রস্তাব নিয়ে কথা হয়। বিষয়টি বিএনপিও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে।
এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিকল্প প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করেন। আর তারা (ঐকমত্য কমিশন) ফরমালি প্রস্তাবটি আমাদের দেননি।’
‘সরকারপ্রধান ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি হবেন না’ সুপারিশে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির বক্তব্য, এ ক্ষেত্রে দলের স্বাধীনতা থাকা উচিত। তার মানে এটা না যে সব সময় একই ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। এটা পার্টির স্বাধীনতা; যারা মেজরিটি হবে পার্লামেন্টে, এটি তাদের স্বাধীনতা।
সালাহউদ্দিন আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীই যে পার্টির চিফ হবেন—এমন কথা নাই। এ রকম ইনস্ট্যান্স অনেক আছে, কিন্তু প্রভিশনটা ওপেন রাখা উচিত, অপশন রাখা উচিত। প্রধানমন্ত্রী যিনি হবেন এটা দেখা যায় যে, পার্লামেন্টে এটা একটি ট্র্যাডিশন যে প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা হন। কিন্তু কোনো কোনো দেশে সংসদ নেতাকে আলাদাও করেছে এ রকম নজির আছে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে সংসদ নেতার কোনো এক্সিকিউটিভ পাওয়ার নেই। সংসদ নেতা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো মন্ত্রণালয় লিড করেন, সে রকম নয়। এটা আলাদা এনটিটি, সংসদে কিছু কাজ থাকে। স্পিকার সংসদ নেতার সঙ্গে আলাপ করে সে কাজগুলো করেন।’
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা আরো বলেন, ‘এখানে সংসদ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী এটা অনেকটা অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো। কিন্তু ইন প্র্যাকটিস দেখা গেছে যে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এটা থাকাই সর্বোত্তম। আমাদের রুলস অব প্রসিডিউর অনুসারে কয়েকটা জায়গায় শুধু সংসদ নেতার উল্লেখ আছে। বিধিতে সংশোধনী এনে সংসদ নেতার ফাংশনগুলো রি-অ্যারেঞ্জ করা যাবে, এটা তেমন বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।’
রাষ্ট্রপতির অভিশংসনপ্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের বিষয়ে এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়েও একমত হয়েছে বিএনপি।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা আমরা বলেছি। যেখানে রাষ্ট্রপতির হাতে কী কী ক্ষমতা অর্পণ করা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে রাষ্ট্রপতি কী কী করতে পারবেন আমাদের প্রস্তাবে সেটা বিস্তারিত থাকবে। এটা এই মুহূর্তে আমরা উন্মোচন করছি না।’
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে বিএনপি একমত বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আইনসভার ক্ষেত্রে উনারা (ঐকমত্য কমিশন) নাম রেখেছেন উচ্চ কক্ষের জন্য সিনেট, নিম্ন কক্ষের নাম জাতীয় সংসদ। এটাতে আমরা একমত। নিম্ন কক্ষের ৪০০ আসনের মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে—এটা নিয়ে আমরা একমত, তবে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে আমাদের মধ্যে ভিন্নমত আছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ১৪ জন হবে—এর সঙ্গে একমত। উপদেষ্টামণ্ডলীর কার্যাবলির রুটিন ওয়ার্কের ক্ষেত্রে একমত। প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য থেকে একজনকে মনোনীত করা হবে, সেই বিষয়ে একমত। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে একমত। স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করা হবে না, এই ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ একমত।’
তিনি আরো বলেন, ‘শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আমরা মোটামুটি একমত। তবে এটা আরো বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। কারণ শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বলতে সশস্ত্র বাহিনীর তিন বিভাগসহ পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত আছে। সুতরাং ঢালাওভাবে শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ক্ষেত্রে যদি হঠাৎ করে একটি প্রভিশন (বিধান) রাখি, তাহলে ইমব্যালেন্সড (ভারসাম্যহীন) হয়ে যেতে পারে। সে জন্য এটা আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। একটি (সাধারণ) বিষয়ে ঐকমত্যে আসা যায়। কিন্তু যেটা রাষ্ট্রের বিষয়, সংবিধানের বিষয়, রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়, সেটি গভীরভাবে চিন্তা করে সংবিধানে আনতে হবে।’
বিচার বিভাগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন যাতে আইনানুগ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় যায়, সেই আহ্বান জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘আমরা আলোচনাটিতে দ্রুততার সঙ্গে যাচ্ছি না এ জন্য যে, এটা রাষ্ট্রের বিষয়, এটা রিপাবলিকের বিষয়, এটা সংবিধানের বিষয়; তাড়াহুড়ো কোনো বিষয় নয়। আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুপারিশ গৃহীত হবে। সেটা জাতীয় জীবনে মহান ভূমিকা রাখবে। সুতরাং একটু সময় বেশি নিলেও বিস্তারিত আলোচনা করছি।’
সংলাপের নতুন প্রস্তাব এসেছে : আলী রীয়াজ
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে নতুন নতুন প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, আলোচনায় নতুন প্রস্তাব এসেছে। সেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কারণ এগুলো সংস্কার কমিশনগুলোর কাছ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে এসেছে।
প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় বিএনপির সঙ্গে কিছু বিষয়ে একমত হওয়া গেছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে সামঞ্জস্যতা আছে, বেশ কিছু বিষয়ে মতভিন্নতাও আছে। মতভিন্নতার ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে তারা নীতিনির্ধারকদের কাছে যাবেন, আলোচনা করবেন এবং পরবর্তী সময়ে আমাদের জানাবেন। নিঃসন্দেহে আমরা ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছি। এসব সুপারিশের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধু এই টেবিল (সংলাপ) থেকে হতে পারবে না। কারণ সংশ্লিষ্ট দলগুলোর ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা অংশগ্রহণ করবেন।’
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘অনেক রাজনৈতিক দলের কাছে আমরা অনেক জায়গায় ঐকমত্যের জায়গায় বা সামঞ্জস্যতার জায়গায় আসছি। কোথাও কোথাও ভিন্নমত আছে, সেটাই স্বাভাবিক।’ তিনি বলেন, ‘১৫টি দলের সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ পর্যায়ে এসেছে। বাকি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। আশা করছি, বিএনপির সঙ্গে তৃতীয় দিনে প্রাথমিক আলোচনা শেষ করতে পারব।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হওয়া আলোচনার বিষয়বস্তু কমিশনপ্রধান ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়মিত জানানো হয় উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, ‘প্রতিটি বিষয় প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়। প্রধান উপদেষ্টা দিকনির্দেশনাও দিচ্ছেন।’
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার প্রথম ও গত রবিবার দ্বিতীয় দিনের মতো বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর আগে সংস্কার সুপারিশ চূড়ান্ত করতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ২০ মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে এই সংলাপ শেষ হবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।