তুচ্ছ ঘটনায় প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ (২৩) খুনের ঘটনায় আটজনকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ২০ থেকে ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পারভেজ ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন উল্লেখ করে এই হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। ছাত্রদল এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের দায়ী করেছে।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধীদের কোনো সম্পর্ক নেই। সংগঠনটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেছেন, ছাত্রদল অপপ্রচার চালিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে।
গত শনিবার বিকেলে রাজধানীর বনানীতে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছুরি মেরে হত্যা করা হয় পারভেজকে। গতকাল রবিবার মামলার বিষয়টি কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন বনানী থানার ওসি রাসেল সরোয়ার।
তিনি বলেন, নিহত পারভেজের ভাই হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে শনিবার রাতে একটি হত্যা মামলা করেন। নিহত শিক্ষার্থী পারভেজ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২২৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী।
মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বহিরাগত আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন—মাহাথি, মেহেরাব, আবুজর গিফারী, সোহান তুষার নেয়াজ, হৃদয় মিয়াজী, রিফাত, আলী ও ফাহিম।
পুলিশ বলছে তাঁরা বিষয়টি তদন্ত করছে। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। নিহত শিক্ষার্থী পারভেজ ওই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
জানা গেছে, গত শনিবার বিকেল ৪টার পর বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগ ও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা নিয়ে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ছুরিকাঘাতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী পারভেজ নিহত হন।
পারভেজ ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বিরুনিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা।
পারভেজকে হত্যা ছিল পূর্বপরিকল্পিত : ছাত্রদল
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শনিবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছে, পারভেজকে হত্যা পূর্বপরিকল্পিত। ঘটনাস্থলে কী হয়েছিল সে বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জাহিদুল ইসলাম পারভেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দুই-তিনজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসে শিঙাড়া খাচ্ছিলেন। এমন সময় ছাত্র মেহেরাজ ইসলাম এবং আরো দুজন ছাত্রীসহ কয়েকজন ওই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁরা পারভেজকে উদ্দেশ্য করে ‘এদিকে তাকাচ্ছ কেন?’, ‘এদিকে তাকালে চোখ তুলে দেব’—এ ধরনের উসকানিমূলক মন্তব্য করতে থাকেন।
জবাবে পারভেজ বলেন, ‘কী দোষ করেছি ভাই?’ এতে তাঁরা পারভেজের ওপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। বিষয়টি মীমাংসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আব্দুস সালাম হস্তক্ষেপ করেন এবং উভয় পক্ষকে মিলিয়ে দেন।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ‘দুঃখজনকভাবে মেহেরাজ ইসলাম গং এই মীমাংসা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে লাশ ফেলার হুমকি দিয়ে বহিরাগতদের ডেকে এনে হামলা চালায়। এই হামলায় মেহেরাজ ইসলামের সঙ্গে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানী থানা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সোহান তুষার নেয়াজ এবং বৈষম্যবিরোধী কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব হৃদয় মিয়াজীর নেতৃত্বে বেশ কিছু উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসী জড়িত ছিল। তারা পারভেজকে ছুরি দিয়ে বুকের ওপর আঘাত করে হত্যা করে। আমরা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী, ইন্ধনদাতা, হুকুমদাতা এবং হামলাকারী সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’
সরাসরি আক্রমণকারীদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
গত রাতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেছেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, হামলার প্রথম সিসি টিভি ফুটেজে যাদের সরাসরি আক্রমণ করতে দেখা যায় তাদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। ঘটনাস্থলে প্রদর্শিত দ্বিতীয় ফুটেজে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।’
রাজধানীর বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। উমামা ফাতেমা বলেন, “ঘটনার সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানী থানা কমিটির সঙ্গে যুক্ত ও প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্র হৃদয় মিয়াজী (২২১) ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সোহান তুষার নেয়াজ (২৩১) ছিলেন। একই সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রদলকর্মী তাওহিদ, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ইমতিয়াজ জাহিদ এবং আরো কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী। তবে তদন্তের আগে আমরা কোনোভাবেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাই না যে কারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই ছাত্রদল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালিয়ে ‘মিডিয়া ট্রায়ালে’ লিপ্ত হয়েছে, যা নিন্দনীয় ও অনভিপ্রেত।”
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দেখছি এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘিরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একটি ঘৃণ্য রাজনৈতিক অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। হত্যার প্রকৃত কারণ, প্রকৃত অপরাধী ও ক্যাম্পাসে সহিংসতা ছড়ানোর পেছনে থাকা বাস্তব চিত্রকে আড়াল করে তারা ঘটনার রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদে মনোযোগী হয়েছে। এমনকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গণ-অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে এই হত্যার মদদদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করে যাচ্ছে। আমরা এই রাজনৈতিক অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
জাহিদুল ইসলাম পারভেজের জানাজা
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পারভেজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানাজা শেষে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এরপর বিকেলে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে দাফনের জন্য লাশ গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রক্টর মোশাররফ হোসেন বলেন, এটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও থানা পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশের ফেসবুক পোস্টে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী হামলায় পারভেজ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়।
পারিবারিক গোরস্থানে দাফন
ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পারভেজের লাশ ভালুকা উপজেলার বিরুনীয়া ইউনিয়নের কাইচান পাঠকবাড়িতে পৌঁছার পর আত্মীয়-স্বজনসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ওই বাড়িতে এসে ভিড় জমায়। ওই সময় পরিবার ও স্বজনদের কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ওই পরিবারে চলছে শোকের মাতম। রাতে জানাজা শেষে তাঁর লাশ পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।
পারভেজের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে জনসমক্ষে ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন তাঁর বাবা মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘তুচ্ছ একটি ঘটনায় ওরা আমার ছেলেকে হত্যা করল কেন? ওরা আমার ছেলের একটি হাত নয়তো একটি পা ভেঙে দিত। সে অন্তত আমাকে বাবা বলে ডাকতে পারত। আমি ছেলের মুখে অন্তত বাবা ডাক শুনতে পরতাম।’
মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
পারভেজ হত্যার প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে গতকাল ময়মনসিংহের ভালুকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয় উপজেলা ছাত্রদল। পরে স্থানীয় পুলিশের হস্তক্ষেপে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দিয়ে অবরোধ তুলে নেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।